E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ধনবাড়ীতে ধান গবেষণা প্রকল্পের ধানে ব্লাস্টের থাবা!

২০২০ মে ২৯ ১৮:৫৩:৫৮
ধনবাড়ীতে ধান গবেষণা প্রকল্পের ধানে ব্লাস্টের থাবা!

রঞ্জন কৃষ্ণ পন্ডিত, টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে প্রান্তিক চাষিদের গ্রুপ ভিত্তিক ধান রোপন ও হার্ভেষ্টিংয়ের মাধ্যমে বাড়তি উৎপাদন প্রকল্পের ধানে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ দেখা দিয়েছে। এতে পুরো প্রকল্পের ধান চিটা হয়ে গেছে। ফলে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে সিনক্রোনাইজড ফার্মিং প্রজেক্টের সফলতা নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। 

জানা যায়, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে প্রান্তিক চাষিদের নিয়ে খামার পদ্ধতিতে বোরো আবাদে ‘সিনক্রোনাইজড ফার্মিং প্রজেক্ট’ বা ‘সমকালীন খামার প্রকল্প’ গ্রহণ করে। ধনবাড়ী উপজেলার পাইস্কা ইউনিয়নের ভাতকুড়া গ্রামের ৫৪ জন চাষির ৬০ বিঘা জমিতে চলতি মৌসুমে বোরো চাষের এ পরীক্ষামূলক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। ধান গবেষণা ইনস্টিউিটের এ ব্যতিক্রমধর্মী ফার্মিংয়ের মূল উদ্দেশ হলো- রাইসট্রান্সপ্লাণ্টার দিয়ে ধানের চারা রোপন এবং কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে ধান কর্তন। এতে জমির সদ্ব্যবহার হবে, ধানের উৎপাদন দ্বিগুণ হবে। কৃষকরাও আধুনিক কৃষিযন্ত্রপাতির সাথে পরিচিত হবেন।

প্রকল্পভুক্ত কৃষকদের সার্বিকভাবে সহায়তার আশ্বাস দেয়া হলেও পরে স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন ও তদারকি করেন নাই। ফলে প্রকল্পের ধানে ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে সব ধান চিটা হয়েছে। প্রকল্পে ব্লাস্ট রোগে আক্রমণসহ নানা অনিয়ম-অব্যস্থাপনায় সফল না হওয়ার পরীক্ষামূলক ওই প্রকল্পের ভবিষ্যত নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এতে স্থানীয় কৃষক পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা হতাশায় ভুগছেন। কৃষকরা রাগে-ক্ষোভে ক্ষেতের ধান হারভেস্টার মেশিনে কাটতে দিতে রাজি হচ্ছেন না।

জানা গেছে, গত জানুয়ারিতে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক এমপি, তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান, কৃষি সচিব নাছিরুজ্জামান, কৃষি সম্প্রসাধণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আব্দুল মুঈদ, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক আবুল কালাম আযাদসহ কৃষি বিভাগের উর্ধতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে এ প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কারিগরী সহযোগিতা ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বাস্তবায়নে ওই প্রকল্পে ব্রি-৮৮, ব্রি-৮৯ (নতুন) ও ব্রি-২৯ জাতের ধানের আবাদ করা হয়েছিল। ওই ধান চাষাবাদে সংশ্লিষ্ট বিভাগের বীজ, সার ও কীটনাশকসহ অন্যান্য উপকরণ বিনামূল্যে দেয়ার কথা থাকলেও কৃষক পর্যায়ে তা সরবরাহ নিয়ে নানা অভিযোগ ওঠেছে। ধান কাটা নিয়েও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।

যান্ত্রিক ত্রুটিযুক্ত কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কাটার সময় এলামেলো হয়ে মাড়াই কাজে সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় কম্বাইন হারভেস্টারে ধান কাটায় কৃষকের উৎসাহ নেই। তারা শ্রমিক দিয়ে কাঁচিতে ধান কেটে মাড়াই করার ব্যবস্থা নিচ্ছেন। মাড়াইয়ের পর ধানের পরিমাণ দেখে কৃষকরা হতভম্ব হয়ে পড়েছেন। তবে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা তা স্বীকার করেন নি।

ভাতকুড়া গ্রামের ঘটু পাগলা নামে এক দরিদ্র কৃষকের প্রকল্পে ২৫ শতাংশ জমি ছিল। তার ছেলে চান মিয়া জানান, ক্ষেতে ঘাস আবাদ করলেও এমন প্রকল্পে আর কখনো ধান চাষ করবেন না। সামান্য জমিতে তাদের খাদ্যের সংস্থান হত। প্রজেক্টে জমি দিয়ে সে পথ বন্ধ হল। খাওয়া নিয়ে দুঃশ্চিস্তগ্রস্ত চান মিয়ার অভিযোগ, প্রজেক্টের শুরুতে বলা হয়েছিল- কোন টাকা লাগবে না। সার-কীটনাশক সব দিবে। ২৫ শতাংশ জমিতে ৭০০ টাকা দিয়েছে। কীটনাশক দেয়া হয়নি। সামান্য সার দিয়ে বাকি সার গোপণে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে।

অপর কৃষক একই গ্রামের শফিকুল ইসলামের প্রকল্পে ২৪ শতক জমি। তার জমির ধানও ব্লাস্ট রোগে মরে নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি বলেন, আবাদের শুরুতে বলা হয়েছিল, কৃষি বিভাগ সব খরচ দিবে। সেটা পুরোপুরি দেয়া হয়নি। সুবিধা-অসুবিধা দেখার জন্য দেলোয়ার ও শফিক নামে দুই উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিলেন। তাদের ফোন করে ক্ষেতে আনা যায়নি। নিজেদেরকেই সার কিনে ক্ষেতে দিতে হয়েছে। তবুও ধান মরে নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি আরো জানান, শুধু তার জমি নয়; প্রজেক্টের ৬০ বিঘা জমির প্রায় ৪০ বিঘার একই অবস্থা।

কৃষক বেলাল অভিযোগ করেন, কৃষি বিভাগের কথা বলে কৃষক সমিতির কয়েক নেতা কৃষকদের কাছ থেকে ৭২০ টাকা করে আদায় করেছেন। ধান চাষে এ প্রকল্প তার উপকার তো দূরের কথা উল্টো ব্যাপক ক্ষতি করেছে। চিটা ধান কেটে যাতে আরো ক্ষতির শিকার না হন সেজন্য তিনি ধান কাটতে আগ্রহ হারিয়েছেন। ক্ষেতেই তার আবাদের ধান গাছ দাঁড়িয়ে আছে।

তিনি জানান, চাষ করা ধানে খাদ্যের যোগান এবার তো হচ্ছে না। স্থানীয় এমপি ও কৃষিমন্ত্রীকে ক্ষেতের অবস্থা দেখাানোর প্রত্যয় নিয়ে তিনি বলেন, এটা নিশ্চিত জেনেই বলছি- ভিক্ষা করে খাব, তবুও মরা ধানের ক্ষেতের উপর দিয়ে মেশিন চালাতে দিব না। আগে আমার বুকের উপর দিয়ে চালাতে হবে। একই ধরনের অভিযোগ করেন চাষি কদ্দুছ আলী, টুক্কু মিয়া, শাহজাহান আলী, রেহানা বেগমসহ অনেকে।

ধান মোটামুটি ভালো হয়েছে ভাতকুড়া গ্রামের এমন এক কৃষক নাম প্রকাশ না করে জানান, প্রকল্পে অনেক অনিয়ম হয়েছে। দেখভালের দায়িত্বশীলরা উদাসীন ছিলেন। সরকারিভাবে প্রকল্পের জমিগুলো আবাদে সার-কীটনাশকসহ প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দেয়ার ঘোষণায় কৃষকরা আবাদে তেমন যত্নবান ছিলেন না। ফলে অবস্থা অনেকের খারাপ হয়েছে। তার ভালো হওয়ার রহস্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রকল্পের সাপোর্টে নির্ভর না থেকে আমি পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছি। যখন যা দরকার হয়েছে নিজ পয়সায় কিনে ক্ষেতে দিয়েছি।

প্রজেক্টের বাইরে থাকা কৃষক একই গ্রামের শফিকুল আলম জানান, প্রজেক্টে কৃষকরা লাভবান হননি। নানা অনিয়ম হওয়ায় বরং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তিনি নিজেও কৃষকদের জন্য বরাদ্দের সার সমিতির নেতৃস্থানীয় একজনের কাছ থেকে কিনে তার জমিতে দিয়েছেন।

প্রকল্পের আওতাভুক্ত কৃষক সমিতির সভাপতি আনোয়ার হোসেন জানান, স্থানীয় জমির মালিক ওয়াজেদ আলী খানের এক একর বর্গা জমিতে চাষ করে তিনি লাভবান হয়েছেন। নিজস্ব অর্থে কিনে ও ফ্রিতে সারসহ অন্যান্য সামগ্রী পেয়ে ক্ষেতে সময় মত ব্যবহার করেছেন।

অধিকাংশরাই তার মত লাভবান হয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, কেউ কেউ সময় মত সেটা করতে না পেরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে যান্ত্রিক পদ্ধতির চাষে তিনি ধান কেটেছেন শ্রমিক দিয়ে কাঁচিতে। কারণ কম্বাইন হারভেস্টার মেশিনের যান্ত্রিক ত্রুটি থাকায় খর নষ্ট হচ্ছিল। তাই কাঁচিতে কাটা হয়েছে।

ধনবাড়ী কৃষি অফিসের উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন ও শফিকুল ইসলাম অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, পরামর্শ দেয়া সত্বেও কিছু-কিছু চাষি আক্রান্ত জমিতে সময় মত বালাইনাশক প্রয়োগ না করায় ব্লাস্টরোগে ধান চিটা হয়ে গেছে।

ধনবাড়ী উপজেলা কৃষি অফিসার মাহবুবুর রহমান জানান, প্রকল্পটি তাদের না। ধান গবেষণা ইন্সস্টিটিউটের। কাজেই প্রকল্পটি দেখভালের দায়িত্ব ধান গবেষণার। তারা শুধু পরামর্শ দিয়েছেন। পরামর্শ না শুনলে তাদের কী করার আছে বলে প্রশ্ন রাখেন তিনি।

ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষি প্রকৌশলী এবং প্রকল্পের ট্যাগ অফিসার আশরাফ হোসেন জানান, প্রকল্পভুক্ত কৃষকরা সবাই বিনামূল্যে বীজ ও সার পেয়েছেন। তিন-চার জন অসচেতন কৃষক বাদে আর সবাই বিঘা প্রতি ২৪-২৫ মণ করে ধান পেয়েছেন। একটি স্বার্থান্বেষী মহল ব্লাস্ট রোগের জন্য অযথা কৃষিকর্মীদের দায়ী করছেন। তারা করোনার অজুহাতে কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে মাঠে ধান কাটায় বাধাও সৃষ্টি করছেন।

(আরকেপি/এসপি/মে ২৯, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test