E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

যমুনার চরের কৃষকের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ‘বাদাম’

২০২২ ফেব্রুয়ারি ১৮ ১৬:৫২:৪৮
যমুনার চরের কৃষকের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ‘বাদাম’

মোঃ সিরাজ আল মাসুদ, টাঙ্গাইল : “বাদাম বাদাম কাঁচা বাদাম” –ভূবনের এ গানটি ভারতের পশ্চিম বঙ্গ ছাড়িয়ে পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল। এ গানটি একজন বাদাম বিক্রতার। আজ জানুন এই কাঁচা বাদাম উৎপাদনে জড়িত চির যৌবনা যমুনা চরের মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন এই কাঁচা বাদাম চাষীদের জীবনের গল্প কাহিনী।

টাঙ্গাইলের যমুনা নদীর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় বর্ষায় দু’কূল ছাপিয়ে জল আর জল। এ যেন এক অপরিচিত ,অচেনা এক নদী। নাম তার যমুনা। তার অনেক ক্ষমতা। নিমিষেই বিলিন করে মাইলের পর মাইল। নদী পাড়ের মানুষগুলোকে সে ইচ্ছে করলেই কাঁদাতে পারে আবার হাসাতেও পারে। তার ইচ্ছেতেই হাসে যমুনা পাড়ের অবহেলিত মানুষ। যমুনার বুকে হঠাৎ জেগে ওঠা বালুচর এই মানুষগুলোর বেঁচে থাকার অন্যতম অবলম্বন। বর্ষা চলে গেলে যমুনার জলে ভেসে আসা বেলে-দোআঁশ মাটি আর নতুন নতুন বালু চরে কৃষক-কৃষাণীর মনে রঙিন স্বপ্ন দোলা দেয়। সদ্য জেগে উঠা এক একটি বালুচর যেন এক একটি গুপ্তধনের ভান্ডার। বাদামের সবুজ চারাগাছে রুপালী বালুচর যেন সবুজে মোড়ানো কার্পেট। বিভিন্ন জাতের বাদাম রয়েছে।

এর মধ্যে বাসন্তী বাদাম (ডিজি-২), ঝিংগা বাদাম (এসিসি-১২), ত্রিদানা বাদাম (ডিএম-১), বারি চীনাবাদাম-৫, বারি চীনাবাদাম-৬, বারি চীনাবাদাম-৭, বারি চীনাবাদাম-৮ ও বারি চীনাবাদাম-৯। তবে জাত ভেদে উৎপাদন বিভিন্ন পরিমাণে হয়ে থাকে।তবে চীনাবাদাম একটি স্বল্পমেয়াদি অর্থকরী ফসল হিসাবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছে। এপ্রিল মাস থেকে জুন মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত চীনাবাদাম বপনের উপযুক্ত সময়। রবি মৌসুমে আশ্বিনের মাঝামাঝি থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত চীনাবাদাম বপন করা যায়।চলতি মৌসুমে বাদামের দাম ও ফলন ভালো হওয়ায় কৃষক অনেকটাই উৎফল্ল। তাই চরের কৃষক বাদামকে ভালোবেসে নাম দিয়েছেন গুপ্তধন।

সরেজমিনে জেলার যমুনা বিধৌত বিভিন্ন চর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, যমুনার বুকজুড়ে অসংখ্য ছোট-বড় বালুচরে মাইলের পর মাইল চাষ হচ্ছে চিনা বাদাম।সবুজ বাদামে ছেয়ে গেছে রূপালী বালুর চর । বাদাম গাছের মুঠি ধরে টান দিলেই উঠে আসে থোকা থোকা সোনালী রঙের চিনা বাদাম। এ যেন বালুর নিচে লুকিয়ে থাকা গুপ্তধন ভান্ডার। বছরের এ সময়টা বাদাম তোলার মৌসুম। তবে পুরোপুরি ভাবে বাদাম তোলার শুরু না হলেও কোথাও কোথাও বাদাম তোলা হচ্ছে। ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি চরাঞ্চলের চাষীরা বাদাম চারা পরিচর্যা বা বাদাম তোলার কাজ করছেন। পরিবারের নারী ও শিশুরাও এ কাজে সহযোগিতা করছে।। কৃষাণি ও কিশোর-কিশোরিরা গাছ থেকে বাদাম ছাড়িয়ে স্তুপ করে রাখছে। প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষিরা জমি থেকে বাদাম হাটে নিয়ে বিক্রি করছেন। জোতদার ও বিত্তবান চাষিরা বাদাম শুকিয়ে গোলাজাত করে রাখছেন যাতে পরবর্তীতে বেশি দামে বিক্রি করতে পারেন ।

জানা গেছে, বাদামের মৌসুমে প্রতিদিন চরের কৃষকরা নৌকায় করে মোকামে বাদাম বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন। বাদাম বিক্রি করে তারা সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরেন। বাদাম কেনা-বেচার জন্য গড়ে উঠেছে ছোট বড় অনেক আড়ৎ বা মোকাম । দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাদাম ব্যবসায়ীরা বাদাম কেনার জন্য এই মোকামে আসেন। ব্যবসায়ীরা স্থানীয় আড়ৎদারের মাধ্যমে বাদাম কিনে এখান থেকে নিজ নিজ গন্তব্যে নিয়ে যান। আবার কিছু কিছু বড় ব্যবসায়ী বাদাম কিনে মেশিনে খোসা ছাড়িয়ে সরাসরি প্রাণ, আকিজ, স্কয়ারসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ কওে থাকেন।

টাঙ্গাইল জেলা কৃষি সম্পাসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে টাঙ্গাইলের চরাঞ্চলসহ ১২টি উপজেলায় ২হাজার ২শ’ ১ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ করা হয়েছে। টাঙ্গাইল সদরে ৩৭৫ হেক্টর, ভুঞাপুরে ১৭২২ হেক্টর, গোপালপুরে ২৮ হেক্টর, নাগরপুরে ৭ হেক্টর, বাসাইলে ২০হেক্টর,কালিহাতীতে ২০ হেক্টর, ঘাটাইলে ৯ হেক্টর, সখীপুওে ৫ হেক্টর, দেলদুয়ারে ১৪ হেক্টর ও মির্জাপুরে ১ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ করা হয়েছে।

স্থানীয় বাদাম চাষীরা জানান, যমুনা চরের মাটি চিনা বাদাম চাষের জন্য খুবই উপযোগী। এ মাটিতে অন্য কোনো ফসল উৎপাদন করে বাদামের সমপরিমাণ লাভ হয় না। অন্যান্য ফসল উৎপাদনের চেয়ে চিনা বাদাম উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় চরাঞ্চলের আমরা সবাই বাদাম চাষ করেছি। বাদাম রোপণের পর অন্য ফসলে ন্যায় কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। নেই রাসায়নিক সারের ব্যবহারও। বীজ রোপণ আর পরিপক্ব বাদাম উঠানোর শ্রমিক খরচ ছাড়া তেমন কোনো খরচ নেই বললেই চলে। একটি ফসলেই আমাদের সারা বছরের সংসার চলে। বালুচরের এ ফসলটি আমাদের বেঁচে থাকার অন্যতম মাধ্যম। তাছাড়া ১২০ থেকে ১৫০ দিনের মধ্যে বাদাম তোলা যায়। প্রতি মণ কাঁচা বাদাম বিক্রি হচ্ছে ১৪০০ থেকে ১৬০০ টাকায় এবং প্রতি মণ শুকনো বাদাম বিক্রি হচ্ছে ১৮০০ থেকে ২২০০ টাকায়। এবার ফলন ভালো হওয়ায় এক বিঘা জমিতে ৮ থেকে ১০ মণ বাদাম পাওয়া যাচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর বাদামের ফলনও হয়েছে। উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে প্রতি বিঘায় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা লাভ হবে। এছাড়া বাদাম গাছগুলো গো-খাদ্য ও জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। এ বছর বাদাম চাষ করে অনেক লাভ হবে বলে আশা করছি।

কাকুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়াম্যান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, আমার কাকুয়া ইউনিয়টি যমুনা নদীর পাড়ে। এ ইউনিয়নের বেশীর ভাগ এলাকা নদীগর্ভে। কিছু জায়গায় চর জেগে উঠায় নদী পাড়ের মানুষগুলো বাদাম চাষ করে থাকে। চরাঞ্চলে বেশির ভাগ বারি চিনাবাদাম-৭ ও ৮এর চাষ হচ্ছে। এছাড়াও বিনা-৪ ও বিজি-২ এর ফলন করে থাকে। তিনি মনে করেন, চাষিদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ,আর্থিক সহায়তা প্রদান ও কৃসি অফিসের সঠিক দিকনির্দেশনা পেলে চাষিরা বাদাম চাষ করতে আরও বেশি অনুপ্রাণিত ও লাভবান হবেন।

এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো.আহসানুল বাসার বলেন, টাঙ্গাইল জেলায় চলতি বছরে ২২০১ হেক্টর জায়গা বাদাম চাষ করা হয়েছে। এ বছর আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় ৪ হাজার ৮০১ মে.টন ফলন পাবেন বলে আশাবাদী। এছাড়া টাঙ্গাইলে বড় অংশ বাদাম চাষের জন্য যমুনা চর। এ চরে কৃষকরা বাদামের লাভ পাওয়ায় প্রতিবছর বাদাম চাষের জমি বৃদ্ধি করছেন। এছাড়া আমরা বাদাম চাষীদের প্রতিবছরই বীজ ও পরামর্শ দিয়ে সহযোগীতা করে থাকি।

(এসএম/এসপি/ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২২)

পাঠকের মতামত:

১৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test