E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

নাটোরে জলাবদ্ধতায় ৫’শ হেক্টর জমির বোরো চাষ অনিশ্চিত

২০১৬ জানুয়ারি ২৬ ১৪:৩৪:৫৪
নাটোরে জলাবদ্ধতায় ৫’শ হেক্টর জমির বোরো চাষ অনিশ্চিত

নাটোর থেকে মামুনুর রশীদ : নাটোরের হালতি বিলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার কারণে প্রায় ৫’শ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কৃষকদের অভিযোগ পানি নিষ্কাষনের স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এবারও জলাবদ্ধতায় রুপ নিয়েছে। ফলে বোরোর চারা বীজ রোপণ করতে  পারছেন না কৃষকরা। আবার কেউ কেউ জমিতে বোরো চারা রোপন করেও পানিতে ডুবে যাওয়ায় উপরোন্ত জমিতে পানি সেচ না দিয়ে জমি থেকে পানি অন্যত্র সেচে ফেলে দিচ্ছে।

এ নিয়ে কৃষকদের যেন ভোগান্তির শেষ হচ্ছে না। প্রতিনিয়ত একের পর এক সমস্যা নিয়ে কৃষকরা দিয়েহারা হয়ে পড়েছেন। তাই জলাবদ্ধতা নিরসনে পানি নিষ্কাষনে স্থায়ী সমাধান চায় কৃষকরা। তবে স্থানীয় প্রশাসন এই সমস্যা নিরসনে খুব দ্রুতই ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়েছেন।

এদিকে স্থানীয় কৃষকরা জানান, হালতিবিলের খোলাবাড়িয়া গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়া জিয়া খালের প্রবেশ পথে মাটি ভরাট হওয়ায় এবারও পানি প্রবাহ বন্ধ হওয়ার প্রধান কারন। এতে হালতিবিলের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের দিকে বৃহৎ এলাকা জুড়ে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। ফলে এসমস্ত নিচু জমি থেকে পানি নিস্কাশন না হওয়ার কারণে বোরোর চারা রোপন করতে পারছে না কৃষক।

মাধনগর ইউনিয়নের তেঘড়িয়া, সোনাপাতিল ও বাঁশিলা এলাকা ভুক্তভোগেী কৃষকরা জানান, গত কয়েক দিন আগে তারা নিজেদের উদ্যোগে ওই খালের ভরাট মাটি অপসারন করে পানি বের হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা বিফলে গেছে। একেতো খালের গভীরতার চেয়ে জমির গভীরতা বেশি হওয়ায় পানি নামতে পারছে না। অপরদিকে উচু এলাকার জমি থেকে পানি নেমে সমস্যা আও প্রকট আকার ধারন করছে। কৃষকদেরকে জমিতে পানি সেচের পরিবর্তে পানি নিষ্কাষনে শ্যালো মেশিন ব্যবহার করতে হচ্ছে।

এছাড়া বোরো চাষও বিলম্বিত হচ্ছে। গত বছরও একই বিপত্তিতে ভুগতে হয়েছিল কৃষককে। পরে নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শারমিন আক্তার জাহানের হস্তক্ষেপ পিপরুল ও মাধনগর ইউনিয়নের কর্মসৃজন প্রকল্পের এক’শ জন শ্রমিক খাল খননে অংশ নেয়। দিনব্যাপী এসব শ্রমিকরা জিয়া খাল খনন শেষে হালতি গ্রামে একটি বাঁধ কেটে দেয়। এতে পানি প্রবেশের সকল বাধা অপসারণ হয়। ফলে পানি নেমে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসায় কৃষকদের মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস বাতাস বইতে শুরু করে। কিন্তু জলাবদ্ধতার নিরসনে স্থায়ী সমাধান করায় তাদের সেই সমস্যা এখনও কাটেনি। বরং এবছরও ব্যাপক এলাকা জুড়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হওয়ায় বোরো চাষ নিয়ে বিপাকে পড়েছে কয়েক’শ কৃষক।

কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খুব শীঘ্রই পানি নিষ্কাষনের ব্যবস্থা গ্রহণ না করা গেলে এই এলাকায় কমপক্ষে আরো এক মাস বোরো চাষ বিলম্বিত হবে। এতে কৃষকদের ভোগান্তিসহ বোরো ধান উৎপাদনে বিপর্যয় ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। তবে কৃষি বিভাগ কৃষকদের এই আশঙ্কার কথা নাকচ দিয়েছেন।

এলাকাবাসী জানান, হালতিবিল মুলত নাটোরের শস্য ভান্ডার হিসাবে পরিচিতি। এই বিলে একটি মাত্র ফসল ভাল হয় তা হলো বোরো ধান। তবে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ছোঁয়ায় ইদানিংকালে রবি শস্যও চাষাবাদ হচ্ছে। গত দুই দশক আগে এই বিলেএকমাত্র ফসল হিসেবে আমন ধান চাষ হতো। কালের বির্বতনে ফসলের পরিবর্তন হলেও কৃষকের ভাগ্য বদলায়নি। দুর হয়নি কৃষকের দুর্ভোগ। প্রায় সময় প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও প্রতিকুল পরিবেশের সাথে লড়াই করে চলতে হয় এখানকার কৃষক সমাজকে। বন্যার কারনে বিলের আকার পরিবর্তন হয়েছে অনেকাংশ। পলি জমে কোথাও কোথাও বিল উচঁ হয়েছে। অথবা বিলের মাঝে ছোট-বড় খালগুলো দখল হয়ে গেছে। অনেকে খাল ভরাট করে সমতল জমিতে পরিনত করে চাষাবাদ করছে। ফলে এসব খালে পানি প্রবাহ বন্ধ হওয়ায় বিলের নিচু জমি থেকে বন্যার পানি অপসারণে বিপত্তি বাধে। এ নিয়ে প্রতি বছরই কৃষকদের ভোগান্তি পোহাতে হয়।

বিলের নিম্নাঞ্চলের কোথাও কোথাও বোরো চাষ বিঘ্নিত অথবা বিলম্বিত হয়। হালতিবিলের বন্যার পানি যথাসময়ে অপসারণ এবং চাষ মৌসুমে পানি প্রবাহ বজায় রাখতে আশির দশকে পানা উল্লাহ খাল এবং জিয়া খাল খনন করা হয়। নব্বইয়ের দশকে জিয়া খাল পুনঃ খনন কাজ করা হয়। কিন্তু এসব খালের উৎস মুখে স্থানীয় দখলদাররা ভরাট করে বসতি কিংবা বাঁধ দিয়ে পুকুর বানিয়ে মাছ চাষ করছে। ফলে এসব খালে আর পানি প্রবাহ নেই। তবে হালতি বিলের মাঝে জিয়া খাল কিছুটা সচল থাকলেও শুস্ক মৌসুমের আগেই শুকিয়ে যায়। কার্যত এই খাল কৃষকের তেমন কোন উপকারেই আসে না।

মাধনগর ইউপি চেয়ারম্যান মতিউর রহমান জানান, এসব খালের উৎসমুখ এবং খালের অভ্যন্তরে দখল মুক্ত করে পুনরায় খনন কাজ করা হলে কৃষকদের দুর্ভোগ অনেকাংশে লাঘব হবে। এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরী।

সোনাপতিল গ্রামের কৃষক সাইদুর রহমান জানান, জলাবদ্ধতার কারনে তার ১২ বিঘা জমি এখনও পানির নিচে। এতে তিনি সময় মত বোরো চাষ করতে পারছেন না। অথচ বোরো চাষের সময় পার হয়ে যাচ্ছে। বিলম্বে চাষ হলেও তাদের ফলনে বিপর্যয় ঘটে। গত কয়েক বছর ধরে এই সমস্যায় ভুগছেন তারা। একই কথা শোনালেন বাঁশিলা গ্রামের সিদ্দিক মোল্লা, তেঘড়িয়া গ্রামের নুরুজামান, মকসেদ আলী, আতিকুর রহমান সহ অনেকে।

এদের অনেকেই ২০ থেকে ২৫ বিঘা করে জমিতে বোরোর চারা রোপন করতে পারেননি। তেঘড়িয়া গ্রামের সামসুল ইসলাম জানান, গত কয়েকদিন আগে পানি কিছু পানি নামার কারনে জমিতে বোরো চারা রোপন করেছেন। কিন্তু উজানের নেমে আসা পানির কারনে ৯ বিঘা জমির ধান তলিয়ে গেছে। এখন জমি থেকে সেচ দিয়ে পানি অপসারন করে ধান গাছকে রক্ষা করতে হচ্ছে। তাদের দাবী, খুব শীঘ্রই খালের দখলমুক্ত করে বিলের পানি অপসারন না করা হলে সময়মত বোরো চাষ করতে পারবেন না। তাদের মত কয়েক হাজার কৃষক এই উদ্ববেগ ও উৎকন্ঠায় আছেন। হালতি বিলের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্তত ৫ ’শ হেক্টর জমি পানিতে তলিয়ে আছে।

নলডাঙ্গা উপজেলা কৃষি অফিসার আমিরুল ইসলাম জানান, সম্প্রতি উপ-পরিচালকসহ তিনি হালতিবিলে জলাবদ্ধ স্থান পরিদর্শন করে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছেন। প্রায় এক থেকে দেড়’শ বিঘা জমি জলাবদ্ধতার শিকার। বৃষ্টিপাতের কারনে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। তার্র মতে বিলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলে বোরো চাষ কিছুটা বিলম্বিত হতে পারে, তাতে কৃষকদের শঙ্কার কারন নেই। কারন এখনও বোরো চাষের অনেক সময় আছে। দেরিতে হলেও কোন জমি অনাবাদি থাকবে না।

নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শারমিন আক্তার জাহান জানান, কৃষকদের অভিযোগের ভিত্তিতে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে খোজ খবর নিয়েছেন। গত বছর তিনি নিজে উপস্থিত থেকে পানি নিষ্কাষনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। এসব সমস্যা স্থায় ভাবে নিরসনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে ইতিমধ্যে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। চলতি অর্থ বছরেই প্রকল্প গ্রহণ করে এসব সমস্যা দুর করা হবে। ভবিষ্যতে এই খাল আর কেউ যাতে মাটি ভরাট করতে না পারে সে ব্যাপারে স্থানীয় চেয়ারম্যানদের সজাগ থাকতে বলা হয়েছে।

নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বাবুল আহমেদ জানান, হালতিবিলের জলাবদ্ধতা সর্ম্পকে তিনি অবগত আছেন। গত বছর সরজমিনে পরিদর্শন করেছেন। এই পরিস্থিতি উত্তরণে স্থানীয়দের আবেদন পেলেই প্রকল্প তৈরী করে পরিকল্পণা কমিশনে প্রেরণ করা হবে।

(এমআর/এএস/জানুয়ারি ২৬, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

০৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test