E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

চলনবিলে ‘সাদা সোনা’ লাগানোর ধুম

২০১৬ ডিসেম্বর ০৭ ১৬:০৯:১৭
চলনবিলে ‘সাদা সোনা’ লাগানোর ধুম

শামীম হাসান মিলন, চাটমোহর : বিল থেকে বর্ষার পনিও নেমে গেছে নদীতে। বোনা আমন ধান কাটাও প্রায় শেষের পথে। এখন চলনবিল অঞ্চলের কৃষকদের কাছে অতি জনপ্রিয় ফসল বিনাহাল চাষে রসুন আবাদের ধুম লেগে গেছে। খরচ কম-ফলন ও দামও বেশি, যে কারণে নাম হয়েছে ‘সাদা সোনা’। প্রতিবছরের মতো এবারও আমণ ধান কেটেই সেই কাদা জমিতেই চলছে বিনাহালে রসুনের কোয়া রোপণ (সাদা সোনা)-এর কাজ। 

রসুন চাষীদের হাতে সময় বেশি নেই। কারণ নরম মাটি রোদে শক্ত হলে ফলন ভালো হবে না। তাই মজুরদের সঙ্গে নিয়ে পরিবারের সবাই মিলে রসুন চাষে মাঠে নেমেছেন চলনবিলের কৃষাণ-কৃৃষাণীরা।

চলনবিলের ‘সাদা সোনা’ হিসেবে পরিচিত দ্বিতীয় প্রধান অর্থকরী মসলা জাতীয় ফসল হিসেবে ইতোমধ্যেই পরিচিতি লাভ করেছে রসুন। রসুনের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে এই অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বিনাহালের এই রসুন চাষ। বর্তমানে যে দামে রসুন বিক্রি হচ্ছে, সে দাম রসুন ওঠার সময় থাকলে বিঘায় লাখ টাকা লাভের মুখ দেখবে কৃষক। উৎপাদন খরচ বাদে এতো লাভ অন্যকোন ফসলে অকল্পনীয়। চলনবিল এলাকার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, নাটোর জেলার সিংড়া, বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিরাজগঞ্জ উপজেলার তাড়াশ, উল্লাপাড়া এলাকার মাঠ জুড়ে চোখ মেললেই চোখে পড়ছে রসুনের বীজ বোপনের দৃশ্য।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, চাটমোহর উপজেলার ছাইকোলা, নিমাইচড়া ও হান্ডিয়াল ইউনিয়নের মাঠ জুড়ে জেগে উঠা পলি ধোয়া উর্ব্বর ফসলি জমিতে আমন ধান কাটার পাশাপাশি চলছে খড় পরিস্কারের কাজ। অপরদিকে যেসব জমিতে আগে ধান কাটা হয়েছে সেসব জমিতে রসুন লাগাচ্ছেন কৃষাণ-কৃষাণীরা।

এ সময় জমি নতুন করে চাষের প্রয়োজন নেই, এমনকি জমিতে হাল দেয়ারও প্রয়োজন নেই। অল্প কাদা মাটিতে রসুনের কোয়া রোপণ করলেই হয়। এরপর ধানের নাড়া (খড় বিচালি) অথবা কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে রসুনের ক্ষেত। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলছে রসুন বোনা। আর এ রসুন বোনার কাজে পুরুষ শ্রমিকদের চেয়ে নারী শ্রমিকদের কদরই বেশি। একসঙ্গে ধানকাটা-মাড়াই আর রসুন বোনার কারণে দেখা দিয়েছে মজুর সংকট। এমনিতে দৈনিক ২৫০ টাকা হলেই মজুর পাওয়া যায়। কিন্তু এখন নারীমজুর ৩০০ টাকা এবং পুরুষ মজুর ৪০০ টাকাতেও মিলছে না। তবে নারীরা মজুরী বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন।

এ অঞ্চলের কৃষকেরা কয়েক বছর আগেও ইরি-বোরো ধান, গম, সরিষা, কালাই, মসুর ও সবজির আবাদ করেছেন বেশী। অতি বন্যা, খড়া, শিলাবৃষ্টি ও কালবৈশাখীসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি এসব ফসল রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।

অন্যদিকে সারসহ কৃষি উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় ফসলের উৎপাদন খরচও বেড়ে গিয়েছে। সেদিক থেকে বিনা চাষে রসুন চাষ অনেকদিক দিয়েই লাভজনক বলে কৃষকদের অভিমত। চলতি মৌসুমে চলনবিল এলাকায় ৩৪,৮৫৫ হেক্টর জমিতে রসুন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে । গতবছর লক্ষমাত্রা ছিল ২২,২৪৫ হেক্টর। এর মধ্যে শুধু চাটমোহর উপজেলাতে ৩০০০ হেক্টর জমিতে রসুন চাষের লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে। এটা বেড়ে গিয়ে ৬,৫০০ হেক্টর হতে পারে বলে কৃষি বিভাগ ধারনা করছে। এখানে গত বছর আবাদ লক্ষমাত্রা ছিল ২১০০ হেক্টর জমিতে। আবাদ হয়েছিল ৫,২০০ হেক্টর জমিতে।
রসুনচাষীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি বিঘা জমিতে রসুনের ফলন হয় ২২-২৮ মণ। রসুন আবাদ করতে বিঘাপ্রতি ৩ মণ বীজের জন্য ৮-৯ হাজার টাকা, সার, কীটনাশকের জন্য ৬-৭ হাজার টাকা, শ্রমিক খরচ ৪-৫ হাজার টাকা, আগাছা পরিস্কার বাবদ ৩-৪ হাজার টাকা, সেচ বাবদ ৩ হাজার টাকাসহ প্রায় ২৫/২৭ হাজার টাকা খরচ হয়। যারা জমি লিজ নিয়ে আবাদ করেন তাদের বিঘাপ্রতি অতিরিক্ত ৮/১০ হাজার টাকা খরচ হয়। ১ বিঘা জমি থেকে প্রাপ্ত রসুন বিক্রি হয় প্রায় ৬০/৬৫ হাজার টাকায়। এতে খরচ বাদে বিঘাপ্রতি লাভ থাকছে প্রায় ৩৫-৪০ হাজার টাকা।

বিলের কৃষক ধান বিক্রি করে বোরো আবাদের সময়কার পাওনাদার বিদায় করতে না পারলে তখন এই রসুনের দিকেই তাকিয়ে থাকেন। গ্রামের প্রচলিত প্রবাদে- ‘আর কটা দিন সবুর কর, রসুন বুনেছি’। অর্থাৎ ধান বিক্রি করে ক্ষতি হলে তখন এ অঞ্চলের কৃষকের ভরসা হয়ে ওঠে রসুন। তারা রসুন চাষ করে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। এখন শুধু ধানের ক্ষতিই নয়। লাভের উপরে লাভ এনে দেয় ‘সাদাসোনা’ হিসেবে পরিচিত এই রসুন।

চাটমোহর উপজেলার ছাইকোলা ইউনিয়নের সর্দারপাড়া গ্রামের কৃষক মেজবাহুর রহমান মন্টু, আব্দুল মান্নান জানান, রসুনের বাজার বেশির ভাগ সময়ই অস্থির থাকে। কখনো লাভ হয়, আবার লোকসানও গুনতে হয়। উৎপাদন খরচ অনেক বেশি হওয়ায় ঝুঁকিটাও বেশি। পশ্চিমপাড়ার রসুনচাষী বালি প্রামানিক ও আব্দুর রহিম জানান, এখন রসুনের বাজার ভালেই চলছে। প্রতিমন বীজ রসুন (৪০ কেজি) ৭০০০ এবং খাবার রসুন ৬০০০ থেকে ৬,৫০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। গতবছর এ সময়টাতেও একই দাম ছিল বলে জানান তিনি। এরকম দাম থাকলে আমাদের উৎপাদন খরচ বাদে লাভটা ভালোই থাকেবে।
কাটেঙ্গা গ্রামের আব্দুর রউফ ও কালু প্রামানিক জানান, রসুনের বীজ প্রায় সব কৃষকই সংরক্ষন করে থাকে। তাই আমাদের লাভটা ভালোই হয়। তারা বলেন, রসুনই এখন আমাদের একমাত্র লাভের ফসল। আর সবই প্রায় লোকসানী ফসল।

চাটমোহর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা (তথ্য) আসাদুজ্জামান আসাদ জানান, এবার লক্ষমাত্রার চেয়ে চাটমোহর বিলাঞ্চলে রসুন আবাদ অনেক বেশীই হবে। এখন পর্যন্ত ৪,৫০০ হেক্টর রোপন হয়ে গেছে। এই পদ্ধতির রসুন চাষে রোগ বালাই কম হয়। তবুও পাতায় ছত্রাকের আক্রমণ দেখা দিলে ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হয়। আমরা মাঠ পর্যায়ে নিবিড় ভাবে রসুন চাষ মনিটরিং করছি। প্রায় ৩ মাসের মধ্যেই রসুন ঘরে উঠে যাবে বলে জানান তিনি।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রওশন আলম বলেন, আমন ধান কাটার পর জমি থেকে দ্রুত আগাছা পরিস্কার করে জমিতে কাঁদা মাটি থাকতেই পরিমিত সার ছিটানোর পরের দিনই সারিবদ্ধভাবে রসুনের বীজ রোপণ করে ঐ দিনই খর অথবা বিচালি দিয়ে পুরো জমি ঢেকে দিতে হয়। বীজ রোপণের ১ মাস পর পানি সেচ দিয়ে বিঘাপ্রতি পরিমাণ মতো ইউরিয়া সার দিতে হয়। এ নিয়ম মেনে চললে রসুনের আবাদ ভালো হয়।

(এসএইচএম/এএস/ডিসেম্বর ০৭, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test