E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

‘উচ্চ আদালতে বাংলার জন্য আর কত অপেক্ষা লাগবে’

২০১৮ ফেব্রুয়ারি ২৪ ১৮:২০:৪১
‘উচ্চ আদালতে বাংলার জন্য আর কত অপেক্ষা লাগবে’

স্টাফ রিপোর্টার : বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলেও উচ্চ আাদলতে এর চর্চা না করার কঠোর সমালোচনা করেছেন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এমিরেটাস রফিকুল ইসলাম।

শহীদ মিনার এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে শনিবার রাজধানীতে আওয়ামী লীগের এক আলোচনায় এই বিষয়টি তুলে ধরেন রফিকুল।

নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘রাষ্ট্রভাষা অর্থ রাষ্ট্রের ভাষা, রাষ্ট্র যন্ত্রের ভাষা। রাষ্ট্রযন্ত্র বলতে আমরা কী বুঝি? সরকার, বিচার বিভাগ, সংসদ ইত্যাদি ইত্যাদি।’

‘সরকারি কাজকর্ম, নথিপত্র বা যে সমস্ত টিকা, ভাষ্য ইত্যাদি যে বাংলাতে দেয়া হয়, ভুল শুদ্ধ মিশ্র বাংলাতে দেয়া হয়। যখন বঙ্গভবনে কেউ শপথ গ্রহণ করে তখন বাংলায় শপথনামাটি পাঠ করা হয়। নিম্ন আদালতে বাংলা ভাষা মোটামুটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা এখনও স্থান পায়নি।’

‘অথচ সংবিধানের রক্ষক নাকি উচ্চ আদালত। ... আমার জিজ্ঞাসা, উচ্চ আদালতে বাংলা স্থান পাওয়ার জন্য আমাদের আর কত শত বছর অপেক্ষা করতে হবে?’

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু বলেন, ‘উচ্চ আদালতে বাদী, বিবাদী, সাক্ষী, কথোপকথন সব হয় বাংলায়, অথচ রায় হয় ইংরেজিতে। এটা বললে তারা বলেন, রেফারেন্স ইংরেজিতে। কিন্তু এটা কোনো কথা না। এটা মানসিকতার বিষয়।’

‘আমরা চীনে গিয়ে দেখেছি চীনারা অনেক ভালো ইংরেজি জানে, রাশিয়ানরা অনেক ভালো ইংরেজি জানে, তারা বলে না, তারা এটা কীভাবে পারে?

সমাজেও বাংলা ভাষা কার কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা পায়নি বলেও মনে করেন রফিকুল ইসলাম। বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে আমরা আন্দোলন করে বাংলাদেশের সমস্ত স্থাপনার নামফলক বাংলায় পরিবর্তিত করেছিলাম। এমনকি গাড়ির নামফলকও পর্যন্ত। ৭৫ এর রক্তাক্ত পট পরিবর্তনের পর দেখলাম রাতারাতি সব ইংরেজি হয়ে গেল। মনে হলো বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা পরিবর্তিত হয়ে গেছে। বাংলাদেশ বেতারের নাম পরিবর্তিত হয়ে গেল, রেডিও বাংলাদেশ। এমনকি সমস্ত নামফলক ইংরেজিতে পরিবর্তিত হয়ে গেল এবং এখনও সেটা চলছে।’

‘যখনই আমরা দাওয়াতপত্র পাই, সেটা পাই ইংরেজি ভাষায়। কেমন হীনমন্যতা? যেখানে কোনো বিদেশিদের কোনো সম্পর্ক নেই, সেখানে ভুল শুদ্ধ ইংরেজিতে আমরা সমাজে দাওয়াতপত্র, আমন্ত্রণপত্র, নিমন্ত্রণপত্র পাই।’

‘শুধু জন্মদিন নয়, বিবাহবার্ষিকী, বিবাহ উৎসব এবং বিভিন্ন সমস্ত আমন্ত্রণপত্র ইংরেজিতে। কেন? কার জন্য? ’

উচ্চ শিক্ষাতেও বাংলা অবহেলিত বলে জানান এই বুদ্ধিজীবী। বলেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্স না নিলে তাহলে বাংলা পড়ার সুযোগ নেই। অধিকাংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার কোনো প্রবেশাধিকার নেই। এর চেয়ে লজ্জার বিষয় আর কী হতে পারে?’।

‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আমাদের দিয়ে সিলেবাস তৈরি করে ম্যানুয়েল তৈরি করে তাদের দিয়েছি। কিন্তু তারা বাংলা পড়াতে চায় কি না আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ আছে।’

‘সরকারিভাবে বাংলা রাষ্ট্রভাষা, কিন্তু সামাজিকভাবে আমাদের হীনমন্যতার কারণে... বাংলাকে নিয়ে সমাজের মধ্যে আবেগটি নেই।’

অভিভাবকদেরও সমালোচনা করেন রফিকুল ইসলাম। বলেন, ‘আমরা যে মাধ্যমেই সন্তানদেরকে পড়াই, তাদেরকে কি মাতৃভাষা শেখাব না?’।

রফিকুল বলেন, ‘আমরা সংগ্রাম করছি রোমান হরফে বাংলা লেখব না, আমাদের সন্তানরা সব রোমান হরফে ফেসবুকে কী সব করছে।’

এ সময় উপস্থিত জনতা ‘সেইম’ বলে চিৎকার দিলে রফিকুল ইসলাম তাদেরকে বলেন, ‘সেইম’ করবেন না, আপনারাও লেখেন। ফেসবুকে আপনারা যে ভাষা ব্যবহার করেন, সেটা কোন ধরনের ভাষা?’

বর্তমানে নাটকে বাংলা ভাষার যে ব্যবহার করা হয়, তারও কঠোর সমালোচনা করেন রফিকুল ইসলাম। বলেন, ‘আমাদের মধ্যে ভাষার প্রতি কোনো যত্ন নেই। টেলিভিশনে নাটকগুলো দেখুন কী ভাষা দেখানো হচ্ছে। দেখানো যায় এসব নাটক?’

বাংলা ভাষা কমিশনের দাবি

প্রধানমন্ত্রীকে ভাষা কমিশন গঠন করতে আহ্বানও জানান রফিকুল ইসলাম। বলেন, ‘যে ভাষা কমিশনের প্রধান হবেন একজন কোনা একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, তিনি যদি অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হয়ে থাকেন, তাহলে আরও ভালো। কারণ, এর সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টে বাংলা প্রচলনের সম্পর্ক আছে।’

‘তারা প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন দেবেন, গত এক বছরে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা কতটা কার্যকর হয়েছে, কতটা কার্যকর হয়নি, কেন হয়নি, কারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া যেতে পাবে অথবা বাংলাকে যথার্থ মাতৃভাষা করতে কী করা দরকার, সেটা তারা স্থির করবে।’

বাংলা ভাষা চর্চা না হওয়ায় কী ক্ষতি হয়েছে, সেটাও তুলে ধরেন রফিকুল। বাংলা ভাষার স্বনামধন্য লেখকদের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘১৯৫২ থেকে ১৯৭১ এর মধ্যে বাংলাদেশে যে সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে, ওই সময়ের মধ্যে যেসব কবি, সাহিত্যিক, লেখক জন্ম দিয়েছি, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার চেয়ে দ্বিগুণ সময় অতিবাহিত হয়েছে, ওই মাপের আমরা কাউকে সৃষ্টি করতে পারিনি কেন?’

রফিকুল বলেন, ‘আমরা যদি ব্যর্থ হই বাংলাকে যথাযথ মর্যাদা দিতে, তাহলে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ধরে রাখতে পারব না।... আমরা কেবল বিদেশি ভাষার দ্বারা পদানত হবো না, বিদেশিদের দ্বারাও পদানত হবো ‘

‘বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে, বাংলা ভাষা পিছিয়ে থাকতে পারে না।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আবদুর রাজ্জাক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন প্রমুখ এ সময় বক্তব্য রাখেন। আলোচনা সভায় সঞ্চালনা করেন আওয়ামী লীগর প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ।

(ওএস/এসপি/ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

০৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test