E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

অভিজিৎ হত্যা : অব্যাহতি পাচ্ছেন সাতজন, আসামি ছয়

২০১৯ ফেব্রুয়ারি ১৮ ১৬:১৪:১২
অভিজিৎ হত্যা : অব্যাহতি পাচ্ছেন সাতজন, আসামি ছয়

স্টাফ রিপোর্টার : লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের সময় ঘটনাস্থলেই উপস্থিত ছিলেন মাস্টারমাইন্ড সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে মেজর (চাকরিচ্যুত) জিয়া। আর কিলিং মিশনে নেতৃত্ব দেন ডিবির সঙ্গে গোলাগুলিতে নিহত মুকুল রানা। ‘বিশ্বাসে ভাইরাস’ ও ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ নামক দুটি বইকে কেন্দ্র করে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের টার্গেটে পড়েন অভিজিৎ। হত্যাকাণ্ডে ১১ জনের সংশ্লিষ্টতা থাকলেও সরাসরি অংশ নেয়া তিনজনসহ মোট ছয়জনের বিরুদ্ধে দাখিল হচ্ছে চার্জশিট। আর র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার ফারাবি বাদে বাকি সাতজনকে এই মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে।

সোমবার দুপুর ১টায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের পরই আমরা কিছুসংখ্যক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করি। যাদের নাম-ঠিকানা আমরা জানতাম না। তাদের ধরতে সাংগঠনিক নাম আর ছবি প্রচার করে আমরা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলাম। ওই সময় একজন মাত্র আসামিকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছিল যার নাম মুকুল রানা। তবে তিনি গ্রেফতারকালে ডিবির সঙ্গে গোলাগুলিতে নিহত হন। এরপর আর কোনো আসামিকে গ্রেফতার করা যায়নি।

তবে কিছু দিন পরে শফিউর রহমান ফারাবিসহ আটজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদেরকেও তৎকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তা অভিজিৎ হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখান।

তিনি জানান, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট মামলার তদন্তভার গ্রহণ করার পর তদন্তে ১১ জনকে চিহ্নিত করা হয়। এদের মধ্যে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার আটজনের মধ্যে একজনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। ফারাবির ফেসবুকে অভিজিৎকে হত্যার জন্য উসকানিমূলক পোস্ট দিয়েছিল। সেজন্য তাকে অভিজিৎ হত্যা মামলায় প্ররোচনাকারী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর বাইরে মোট ১১ জন জড়িত। এদের মধ্যে ছয়জনের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। যাদের অভিজিৎ হত্যা মামলার চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অন্য পাঁচজনের নাম-পরিচয় জানা যায়নি।

মনিরুল ইসলাম বলেন, মোজাম্মেল হুসাইন সায়মন ওরফে শাহরিয়ার, মো. আরাফাত রহমান ওরফে সিয়াম ওরফে সাজ্জাদ ও আবু সিদ্দিক সোহেল বিজ্ঞ আদালতে অভিজিৎ হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

জবানবন্দিতে, ঘটনায় তাদের দায়িত্ব ও অন্য কারা কারা কীভাবে জড়িত ছিল ও কেন ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে অর্থাৎ ঘটনার মোটিভ উঠে এসেছে।

অভিজিৎ হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী মেজর জিয়া

অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ওই তিনজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, অন্যান্য আলামত বিশ্লেষণ ও তদন্তে প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণাদি সবকিছু মিলে স্পষ্ট হয়েছে এই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী- সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত পলাতক মেজর জিয়া। তার নেতৃত্বে মোট ১১ জন এই ঘটনাটি সংঘঠিত করেছে।

কিলিং মিশনে নেতৃত্বে ছিল মুকুল রানা

অভিজিৎ হত্যার মিশনে নেতৃত্ব দিয়েছে মুকুল রানা। যিনি ডিবি পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে নিহত হয়েছেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত বাকি তিনজন সোহেল রানা, সায়মন ও আরাফাত তাদেরকে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট গ্রেফতার করেছে। তবে এখনও গ্রেফতারের বাইরে রয়েছে কয়েকজন। যাদের পূর্ণ নাম-ঠিকানা এখনও জানা যায়নি। তাদের ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। তথ্য পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধেও সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করা হবে।

যে কারণে টার্গেটে পড়ে অভিজিৎ

অভিজিতের লেখালেখি ও ভিন্নমতের জন্য তাকে অনেক আগেই টার্গেট করা হয়। তার ‘বিশ্বাসে ভাইরাস’ ও ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ নামক দুটি বইকে কেন্দ্র করে তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় আনসার আল ইসলাম। তাদের ডিসিশন মেকিং একটা বডি আছে। তারাই তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সম্ভাব্য টার্গেটের তালিকা করে। এরপর মেজর জিয়া ও স্পেচুয়াল লিডারের অনুমোদন দেয় কাকে হত্যা করা যাবে আর যাবে না। তাদের দুটি গ্রুপ কাজ করে। একটি রেকি বা ইনটেলিজেন্স গ্রুপ আরেকটি কিলিং গ্রুপ।

অভিজিৎ রায় যুক্তরাষ্ট্রে থাকতেন। তাই তিনি কবে দেশে আসবেন তা তালাশ করেন। অভিজিতের বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে গোপনে খোঁজ করতে থাকেন কবে দেশে ফিরবেন তিনি। তারা প্রকাশনী ও পরিবার সূত্রে জানতে পারে যে, অভিজিৎ বইমেলার সময় অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে ফিরতে পারেন।

সে লক্ষ্যেই তারা রাজধানীর এলিফেন্ট রোডে তাদের কথিত মারকাজ বা বাড়ি ভাড়া নিয়ে অবজার্ভ করতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা নিশ্চিত হয় অভিজিৎ রায় দেশে ফিরেছে। এরপর থেকে তারা নিয়মিত বই মেলায় যাতায়াত করতে থাকে। ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে তারা অভিজিৎকে রেকি করতে থাকে। ২২ ফেব্রুয়ারি তারা জাগৃতি প্রকাশনীর সামনে তারা অভিজিৎকে দেখতে পায়।

ওই দিন স্ত্রীকে নিয়ে অভিজিৎ রায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে যায় বার-বি-কিউ পার্টিতে। যে কারণে তাদের মিশন সেদিন সাকসেস হয়নি। এরপর ২৩, ২৪ ও ২৫ তারিখেও তারা ফলো করেছে। ২৬ তারিখে তারা হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। সে লক্ষ্যে তারা বই মেলায় গিয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়। সেখানকার সিসিটিভি ফুটেজেও সেটা নিশ্চিত হওয়া গেছে।

ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন মেজর জিয়াও

তাদের আরও মারকাজ ছিল উত্তরাতে। তবে তাদের অপারেশনাল হাউস ছিল ধানমন্ডিতে। ওই ঘটনার রেকি করার দায়িত্ব ছিল সায়মন ও সোহেল রানার। ঘটনার সময় ঘটনাস্থলের আশেপাশে উপস্থিত ছিলেন মূল মাস্টারমাইন্ড মেজর জিয়া ও সেলিম নামে এক সহযোগী। প্রয়োজনে তারাও এগিয়ে আসতো। তবে তারা অপারেশনে অংশগ্রহণ করেনি।

অনুমোদনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মামলার চার্জশিট

আনসার আল ইসলামের ইনটেলিজেন্স ও কিলার গ্রুপের তিনজন গ্রেফতার হয়েছে। আর প্ররোচনাকারী হিসেবে ফারাবিও গ্রেফতার আছে। মেজর জিয়া আর আকরাম নামে আরেকজনের নাম-পরিচয় জানা গেছে। এ দুজনকে গ্রেফতার করা গেলেও পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট প্রস্তুত করা হয়েছে। খসড়া চার্জশিট অনুমোদনের জন্য আজই (সোমবার) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

ফারাবি সরাসরি জড়িত না হলেও প্ররোচনা দিয়েছিল

মনিরুল ইসলাম বলেন, র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার ফারাবি সরাসরি অভিজিৎ হত্যায় জড়িত ছিল না। তবে তিনি অভিজিতের ফেসবুকে বলেছিল, একে (অভিজিৎ) কেউ কোপায় না কেন? দেশে আসলে একে কুপিয়ে কুপিয়ে খণ্ড খণ্ড করতে হবে। তবে যে গ্রুপটি অভিজিৎকে হত্যা করেছে তাদের সাথে ফারাবির সরাসরি যোগাযোগ ছিল না। তবে তার প্ররোচনামূলক ফেসবুক পোস্ট কিলারদের প্ররোচিত করেছে বলে তাকে ক্যাটালিস্ট হিসেবে দেখা হচ্ছে।

কোথায় মাস্টারমাইন্ড মেজর জিয়া?

অভিজিৎ হত্যার মাস্টারমাইন্ড মেজর জিয়ার অবস্থান সম্পর্কে কাউন্টার টেররিজম প্রধান বলেন, তার অবস্থান সম্পর্কে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে আমরা নিশ্চিত হয়েছি- সেই অর্থে তিনি আর আগের মতো সক্রিয় নেই। আমাদের ইনটেলিজেন্স বিস্তৃত রয়েছে। তিনি সক্রিয় হলেই একটিভিটি চালালে তার অবস্থান আমরা টের পাব।

২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে জুলহাস-মান্নান হত্যার পরে তারা কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারেনি। পুরো সংগঠনটি এখন নিষ্ক্রিয়। তাদের অপারেশন করার মতো, অর্গানাইজড হবার মতো অবস্থা নেই।

পেনাল কোডে মামলা, সন্ত্রাসবিরোধী আইনে চার্জশিট

অভিজিৎ হত্যা মামলা রুজু হয়েছিল সন্ত্রাস বিরোধী আইনে। তবে যেহেতু ঘটনাটি আনসার আল ইসলাম নামে একটি নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠনের কাজ সেজন্য আমরা সেটি সন্ত্রাসবিরোধী আইনে চার্জশিট দেয়া হচ্ছে।

র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার ফারাবি বাদে বাকিরা অব্যাহতি পাচ্ছেন

অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছিল ফারাবিসহ আটজন। তবে প্ররোচনাকারী হিসেবে ফারাবিকে এই মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হলেও বাকি সাতজন অব্যাহতি পাচ্ছেন। তবে তাদের বিরুদ্ধে অন্য মামলা থাকায় সেসব মামলায় তারা গ্রেফতার থাকছে। এসব মামলায় তদন্ত চলবে।

উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে একুশের বইমেলা চলাকালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে বের হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির কাছে ফুটপাতে কুপিয়ে হত্যা করা হয় অভিজিৎ রায়কে। ওই সময় তার সঙ্গে থাকা স্ত্রী বন্যা আহমেদও হামলার শিকার হয়ে একটি আঙুল হারান।

পদার্থবিদ অধ্যাপক অজয় রায়ের ছেলে অভিজিৎ থাকতেন যুক্তরাষ্ট্রে। বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে লেখালেখির পাশাপাশি মুক্তমনা ব্লগ সাইট পরিচালনা করতেন তিনি। জঙ্গিদের হুমকির মুখেও বইমেলায় অংশ নিতে দেশে এসেছিলেন তিনি।

(ওএস/এসপি/ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৯)

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test