E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

নিম্নমানের গুঁড়ো দুধ আমদানি নিষিদ্ধের দাবি

২০১৯ জুন ৩০ ১৭:৩১:৩৫
নিম্নমানের গুঁড়ো দুধ আমদানি নিষিদ্ধের দাবি

স্টাফ রিপোর্টার : নিম্নমানের গুঁড়ো দুধ স্বাস্থ্য ও দেশীয় দুগ্ধশিল্পের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর; তাই এ দুধ আমদানি নিষিদ্ধ কিংবা উচ্চ শুল্ক আরোপের দাবি জানানো হয়েছে।

রবিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে মিল্ক ভিটা আয়োজিত ‘ইম্পের্টেড পাউডার মিল্ক : থ্রেটস ফর ডেইরি ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড পাবলিক হেলথ’ বিষয়ক সেমিনারে এ দাবি জানান বক্তারা।

সেমিনারে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ও এনিম্যাল হাজেন্ডারি ফ্যাকাল্টির ডিন ড. মো. নুরুল ইসলাম মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব কামাল উদ্দিন তালুকদার সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন।

নুরুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশে যে পাউডার মিল্ক তৈরি হয় এর মেজর অংশই মিল্কভিটা, প্রাণ ও আড়ং ডেইরি উৎপাদন করে থাকে। ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে পাউটার মিল্কের উৎপাদন ছিল ৫ হাজার টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা হয়েছে ১১ হাজার টন। অপরদিকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আমাদের দেশে এক লাখ ৩০ হাজার টন পাউডার মিল্ক আমদানি করা হয়। স্থানীয় উৎপাদন ও আমদানির মধ্যে বড় গ্যাপ রয়েছে। আমাদের স্থানীয়ভাবে পাউডার মিল্ক করার মতো ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপ করতে হবে।’

নুরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘পাউডার মিল্ক আনার কারণে আমদানিকারকরা লাভবান হচ্ছেন। স্থানীয় দুধ উৎপাদকরা তাদের জন্য দিশেহারা। তারা দুধ বিক্রি করতে পারে না। আমদানি করা কমদামি পাউডার মিল্ক বিক্রির কারণে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বেশিদামের পিওর দুধ মানুষ কিনতে চায় না। আমদানি হয়ে আসা বেশির ভাগ পাউডার মিল্ক নিম্নমানের। এজন্য এগিয়ে যাওয়া ডেইরি সেক্টর এখন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।’

‘মিম্নমানের (ডাম্পিং লো কোয়ালিটি) পাউডার মিল্ক আমদানি করতে প্রতি বছর দেশ থেকে ২ থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা চলে যাচ্ছে। মিল্কভিটা এক কেজি গুঁড়ো দুধ উৎপাদনের খরচ হয় ৪৫০ থেকে ৪৮০ টাকা, তা বাজারে বিক্রি হয় ৫২৫ থেকে ৫৫০ টাকা। কিন্তু আমদানি করা গুঁড়ো দুধ ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে,’ যোগ করেন নুরুল ইসলাম।

শুল্ক সুবিধা নিতে বেশিরভাগ গুঁড়ো দুধ শিশুখাদ্য নামে আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কিন্তু দেখা গেছে আমদানি করা গুঁড়ো দুধের মাত্র ১০ শতাংশ শিশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আমাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাকি ৯০ শতাংশ গুঁড়ো দুধ ব্যবহৃত হয়।’

আমদানি করা গুঁড়ো দুধের স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এতে রেডিও অ্যাকটিভ ম্যাটেরিয়াল থাকে। কোনো ক্ষেত্রে এর পরিমাণ বেশি থাকলে ও নিয়মিত তা গ্রহণ করলে তা ক্যান্সারসহ বিভিন্ন সমস্যা হয়। এ ছাড়া ওই দুধে পার ক্লোরাইড, হেভি মেটালস, হাই নাম্বার অব কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া, মেলামাইন থাকে। মাত্রাতিরিক্ত থাকলে তা শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।’

তিনি আরও বলেন,‘প্রত্যেক দেশ রেডিও অ্যাকটিভ ম্যাটেরিয়ালের একটা সেফটি লেভেল নির্ধারণ করে নিয়েছে। এ মাত্রা ভারত ও পকিস্তানে ৩০, ফিলিপাইনে ২২, থাইল্যান্ডে ২১, শ্রীলঙ্কায় ২০, যুক্তরাজ্যে ৩০, অস্ট্রিায় ১২, পোল্যান্ডে ৭ ডেনমার্কে ১০। কিন্তু এ রেডিয়েশন মাত্রা বাংলাদেশের জন্য ৯৫।’

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা যদি ৯৫ মাত্রা অ্যালাউ করি তবে আমরা কোন ধরনের গুঁড়ো দুধ আমদানি করছি বাংলাদের জন্য? আমাদের লেভেল কেন ৯৫ থাকবে এটা দেখার বিষয়।’

গুঁড়ো দুধ আমদানি ট্যাক্স বাড়ানোর সুপারিশ করে তিনি আরও বলেন, ‘আমদানি করা নিম্নমানের দুধের কুফল সম্পর্কে মানুষ সচেতন করতে হবে।’

মূল প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এ সামাদ বলেন, ‘আমরা মরে যাচ্ছি, সামনে আরও মরব; শুধু এই পাউডার মিল্কের জন্য। আমি সব সময় বলি গুঁড়ো দুধ আমদানি শতভাগ বন্ধ করে দেয়া যায় কিনা? বন্ধ করে দিলে আমরা না খেয়ে থাকব, একটা উপায় হবে। কৃষকরা বেনিফিটেড হবে। আসুন আমরা সবাই মিলে এ বিপদজনক বিষয়টি (আমদানি করা গুঁড়ো দুধ) এড়িয়ে চলি।’

প্রাণ ডেইরি লিমিটেডের চিফ ডেইরি এক্সটেনশন মো. রাকিবুর রহমান বলেন, ‘প্রাণ ১৩ হাজার খামারির কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে। খামারিদের দুয়ার থেকে ন্যায্যমূল্যে দুধ কিনে নিতে পারলে খামারিরা গজিয়ে (স্বনির্ভর) উঠবে।’

তিনি বলেন, ‘আমদানি করা গুঁড়ো দুধ সাধারণ খামারির জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। গুঁড়ো দুধ আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া উচিত। আমরা চ্যালেঞ্জ নিলেই সম্ভব, দেশের মধ্যেই প্রয়োজনীয় গুঁড়ো দুধ উৎপাদন করব।’

‘দুধ নিয়ে অপপ্রচারের ক্ষেত্রে আমরা কার কাছে যাব, কে আমাদের গার্ডিয়ান? বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ডেইরি সায়েন্সের লোক। তারা জানিয়ে দিতে পারেন দুধে যে অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেলে তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর কিনা অথবা যখন পাস্তুরিত হচ্ছে তখন এই অ্যান্টিবায়োটিক অ্যাকটিভ থাকছে কিনা। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এসব সময়ে রেসপন্স করলে তাহলে ক্রেতারা স্বস্তিবোধ করি’ বলেন রাকিবুর রহমান।

বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ ইমরান বলেন, ‘গত কয়েক দিনে বিভিন্ন পত্রিকায় দেশের দুগ্ধ শিল্প নিয়ে যে চক্রান্ত চলছে তা আমাদের দেশ ও মানুষের জন্য লজ্জাজনক। আমি গত কয়েক দিতে কয়েকশ খামারির ফোন রিসিভ করেছি, যারা দুধ বিক্রি করতে সমস্যায় পড়ে গেছেন। তারা দুধ বিক্রি করতে পারছেন না।’

তিনি বলেন, ‘আমদানি করা দুধ যত ভালো হোক বা খারাপ হোক-কথা হচ্ছে আমরা আমদানি করা দুধ চাই না। আমরা চাই দেশীয় শিল্প উন্নত হোক।’

মিল্কভিটার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘পাউডার মিল্ক আমদানি বন্ধ করলে আমরা দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ হব। দুধ নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণার কারণে দুধের চাহিদা অনেক কমে গেছে। আমরা কৃষকদের কাছ থেকে দুধ নিতে পারছি না।’

মূল প্রবন্ধ তুলে ধরার সময় নুরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘দুধ নিয়ে নানা ধরনের কথা হচ্ছে- কেউ বলছেন, দুধে সীসা, দুধে রাসায়নিক। যারা রিসার্চ করছেন তারা....তারা স্যাম্পল কখন কোথা থেকে নিলেন, কী পরিমাণ নিলেন...এই জিনিসগুলো। আমি দোকান থেকে পাস্তুরিত দুধ নিলাম, সেখানে ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেল, পাস্তুরিত দুধে তো ব্যাকটেরিয়া থাকবেই।’

তিনি বলেন, ‘এভাবে হলে আতঙ্ক ছড়াবে। নিউলি গ্রোইং ইন্ডাস্ট্রির জন্য কিন্তু এটা একটা থ্রেট। এটা বিষ, এটা খেলে মনে যাবে, এই জিনিসগুলো, দিস ইজ ভেরি মাচ অ্যামারমিং। কোনো একটা জিনিস পাইলেই যে হেলথ হ্যাজার্ড সেটা নয়, প্রত্যেকটা জিনিসের একটি অ্যাকসেপ্ট্যাবল লেভেল আছে। সেই লেভেল আমাকে জানতে হবে। আমার মুখের লালার মধ্যে মারাত্মক বিষ আছে, এটা আল্লাহ প্রদত্ত, মুখের ভিতর যে ব্যাকটেরিয়া আছে তা মারার জন্য এ বিষ। সব জিনিসের একটা ন্যাচারাল প্রটেকশন আছে। আপনি টেস্ট করেই যদি বলেন এটা পাওয়া গেছে, সেটা বললে হবে না। জাতিকে আপনার বলতে হবে কোন লেভেল আপনি পেয়েছেন, সেটা নরমাল লিমিট থেকে এক্সিড করে এতটুকু গেছে।’

‘এই কাজগুলো যারা করেন তাদের সতর্ক থাকা উচিত। দেখা গেছে যারা করতেছে আমি একটা লোকও দেখিনি তারা ডেইরির লোক। তারা বিভিন্ন অর্গানাইজেশন, বিভিন্ন সংস্থার’ বলেন নুরুল ইসলাম।

ব্র্যাক ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রজেক্টের পরিচালক আনিসুর রহমান বলেন, ‘আমাদের পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। আমাদের দায়িত্বশীল আচরণ দরকার। এখন যেটা হয়ে গেছে বিভিন্ন লোক ব্যক্তিগত প্রচারণার জন্য হোক বা ব্যক্তিগত গবেষণা লব্ধ যেকোনো তথ্য হোক মিডিয়াতে ছড়িয়ে দিচ্ছি, এটার প্রভাব দেশীয় শিল্প ও দেশীয় খামারিদের প্রতি সেটা আমি চিন্তা করি না। সবার দিক থেকে আমরা দায়িত্বশীল আচরণ আশা করি।’

মিল্কভিটার অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপনা ও প্রকল্প পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রেজাল্টের বিষয়ে আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগ জানিয়েছে এ রিপোর্টের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। যিনি করেছেন ব্যক্তিগতভাবে করেছেন। তাই মার্কেট যতটুকু নষ্ট হয়েছে, সেটা কীভাবে ক্যাপচার করা যায়।’ এবং এটার জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া যায় কিনা সে বিষয়ে সমবায় সচিবের সহায্য চান তিনি।

পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় সচিব বলেন, ‘দুধ নিয়ে পত্রপত্রিকায় যে নেতিবাচক খবর আসল। আমরা মিল্কভিটায় মান নিয়ে কোনো খবর কখনও দেখিনি। এর কারণ কী? আমার মনে হয়, গত বাজেটের আগে আমরা একটা উদ্যোগ নিই গুঁড়ো দুধের ওপর ট্যাক্স বাড়ানো হয়। এবার ট্যাক্স ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। আমরা ধারণা এই যে ৫ শতাংশ ট্যাক্স বাড়ানো হয়েছে এজন্য যে আমদানিকারকরা রয়েছেন তাদের যোগসাজশে এ রকম একটি অপপ্রচারের উদ্যোগ নেয়া হতে পারে। এ ছাড়া আর কোনো কারণ তো আমি দেখছি না।’

সচিব আরও বলেন, ‘যে যত অপপ্রচারই করুক আমরা এটা শক্তভাবে মোকাবেলা করব। কীভাবে শক্তভাবে মোকাবেলা করব- আমরা রেগুলেটরি অথরিটি করব। পরীক্ষা ছাড়া যাতে কোনো দুধ দেশে না ঢুকতে পারে আমরা সেই উদ্যোগ নেব। আমরা মান নিশ্চিত করব।’

তিনি আরও বলেন, ‘পুরো মিল্কভিটাকে স্বচ্ছ করার জন্য একটা উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। সেখানে বিভিন্ন প্রকারের অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিদায় করে দেয়ার জন্য আমি এক পায়ে দাঁড়ানো। সেজন্য কিছু ইনিশিয়েটিভ আমরা নিয়েছি সামনে আরও নেব।’

কামাল উদ্দিন তালুকদার বলেন, ‘আমরা সবাই একটি বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হব-সেটা হচ্ছে মানের সাথে কোনো আপস করব না। নিম্নমানের কোনো দুধ আমদানি হয় সেটাকে বন্ধ করার জন্য যা যা করা দরকার সেই বিষয়ে আমরা সরকারের কাছে প্রস্তাব আনব।’

(ওএস/এসপি/জুন ২৯, ২০১৯)

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test