E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার

টোল আদায়সংক্রান্ত মামলায় ওরিয়ন গ্রুপের হার!

২০১৪ আগস্ট ০১ ১২:৩৫:৪৮
টোল আদায়সংক্রান্ত মামলায় ওরিয়ন গ্রুপের হার!

বিশেষ প্রতিনিধি : বহুল আলোচিত গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী (মেয়র মোহাম্মদ হানিফ) ফ্লাইওভারের অতিরিক্ত টোল আদায়সংক্রান্ত মামলায় হেরে গেল ওরিয়ন গ্রুপ। নির্মাণ ব্যয় নিয়ে করা আরবিট্রেশন মামলার পক্ষেও পর্যাপ্ত কাগজপত্র সরবরাহ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। ফলে নির্মাণ ব্যয় বেশি দেখিয়ে এখন বিপাকে রয়েছে ওরিয়ন গ্রুপ। পাশাপাশি ব্যাংকঋণ নিয়েও জটিলতা ক্রমাগত বাড়ছে।

জানা যায়, ফ্লাইওভারটি নির্মাণে ৬৬৮ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেয়া হয় ২০০৫ সালে। পরে তা কয়েক দফা বাড়িয়ে ২ হাজার ১০৮ কোটি টাকা করা হয়। ২০১২ সালে ফ্লাইওভার নির্মাণ ব্যয় আরো ৩০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ২ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা করার দাবি জানায় ওরিয়ন। তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) তা অনুমোদন না করায় আরবিট্রেশনে মামলা করে প্রতিষ্ঠানটি। গত সপ্তাহে মামলাটির শুনানিতে ওরিয়নের দাখিলকৃত কাগজপত্র ভুল প্রমাণ হয়। এতে মামলার আর্জি সংশোধনের জন্য সময় প্রার্থনা করে প্রতিষ্ঠানটি।

ডিএসসিসি বলছে, ব্যয়বৃদ্ধির পক্ষে ওরিয়ন যেসব যুক্তি দেখাচ্ছে, তা সঠিক নয়। ব্যয়ের যেসব খাত দেখানো হয়েছে, সেগুলোও ভুয়া। আরবিট্রেশন মামলার শুনানিতে তাদের দাবির সপক্ষে উপস্থাপিত কাগজপত্র ভুল প্রমাণ হয়েছে। ফলে আর্জি সংশোধন করলেও ব্যয়বৃদ্ধির মামলায় ওরিয়নের জয়ের সম্ভাবনা নেই। আর ব্যয়বৃদ্ধির মামলায় হারলে আরবিট্রেশনে করা টোল বাড়ানোর মামলায়ও হারতে পারে ওরিয়ন।

এমনটা হলে ফ্লাইওভারের মালিকানা ডিএসসিসির কাছে ফিরিয়ে দেয়ার প্রস্তাব করা হতে পারে বলে জানান ফ্লাইওভার নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ওরিয়নের একাধিক কর্মকর্তা। তারা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে প্রাথমিক আলোচনাও হয়েছে।

ওরিয়ন গ্রুপের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের আদর্শ উদাহরণ হতে পারত মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার। কিন্তু ডিএসসিসির অসহযোগিতায় তা সম্ভব হচ্ছে না। তাই ফ্লাইওভারের মালিকানা ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে মামলার রায় না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ওরিয়ন গ্রুপের মুখপাত্র চৌধুরী খালেদ মাসুদ বলেন, ফ্লাইওভার নিয়ে মামলা চলছে। আইন বিভাগ বিষয়টি দেখছে। মামলা শেষ হওয়ার আগে এ বিষয়ে কিছুই বলা সম্ভব নয়।

ওরিয়ন ফ্লাইওভারের মালিকানা ছেড়ে দিতে চাইলে আইনি প্রক্রিয়াই তা হতে হবে বলে জানান ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনছার আলী খান। ডিএসসিসি এজন্য প্রস্তুত আছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ডিএসসিসির অভিযোগ, ফ্লাইওভার নির্মাণে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেছে ওরিয়ন। ২০০৫ সালে বেলহাসা-একম অ্যাসোসিয়েটস নামের প্রতিষ্ঠানকে ফ্লাইওভার নির্মাণে কার্যাদেশ দেয়া হয়। এর মধ্যে ওরিয়নের শেয়ার ছিল মাত্র ৫ শতাংশ। বিদেশ থেকে অর্থ এনে ফ্লাইওভারটি নির্মাণের কথা ছিল। তবে পাঁচ বছর বন্ধ থাকার পর ২০১০ সালে বিদেশী অংশীদারকে বাদ দিয়ে ওরিয়ন একাই ফ্লাইওভার নির্মাণ শুরু করে। আর ঋণ নেয় স্থানীয় বিভিন্ন ব্যাংক থেকে। এর সবই হয়েছে চুক্তির শর্ত ভেঙে।

জানা গেছে, ফ্লাইওভারের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী গাড়ি চলছে না। ফ্লাইওভার দিয়ে দৈনিক ৪৬ হাজার ৬০০টি গাড়ি চলাচলের লক্ষ্য ধরা হলেও চলছে ৩২-৩৩ হাজার। অর্থাৎ টোল বাবদ আশানুরূপ অর্থ পাচ্ছে না ওরিয়ন। ফলে বিনিয়োগ থেকে মুনাফাও করতে পারছে না তারা। এজন্য ব্যাংকঋণের বিপরীতে ইস্যু করা অগ্রাধিকার শেয়ারের মুনাফাও দিতে পারছে না ওরিয়ন। ব্যাংকগুলোর কাছে এজন্য সময় বৃদ্ধির আবেদন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

ফ্লাইওভার নির্মাণে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে ওরিয়ন। বাকি ২ হাজার ২৫০ কোটি টাকা নেয়া হয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে। এর মধ্যে অগ্রাধিকার শেয়ারের বিনিময়ে ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে। আর ইকুইটির বিপরীতে অগ্রিম নেয়া হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা।

এর আগে গত ৮ জুন ফ্লাইওভারে অতিরিক্ত টোল আদায় মামলায় হারে ওরিয়ন। এক্ষেত্রে ফ্লাইওভার থেকে আদায় করা অতিরিক্ত টোলের অর্থ পৃথক ব্যাংক হিসাবে জমা রাখার নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। স্বচ্ছতার জন্য এ ব্যাংক হিসাব ডিএসসিসির নিয়ন্ত্রণে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। পাশাপাশি আদায়কৃত অতিরিক্ত টোলের হিসাব ডিএসসিসিকে দিতে বলা হয়।

টোলের হার নিয়েও চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেছে ওরিয়ন। চুক্তি অনুযায়ী, ফ্লাইওভার দিয়ে চলাচলকারী মোটরসাইকেলের টোল হওয়ার কথা ৫ টাকা, অটোরিকশা ১০, কার ৩৫, জিপ ৪০, মাইক্রোবাস ৫০, পিকআপ ৭৫, মিনিবাস ও চার চাকার ট্রাক ১০০, বাস ও ছয় চাকার ট্রাক ১৫০ এবং ট্রেইলার ও কাভার্ড ভ্যান ২০০ টাকা। অথচ ৭০-১০০ শতাংশ অতিরিক্ত টোল আদায় করছে ওরিয়ন। উদ্বোধনের পরদিন (১২ অক্টোবর) থেকেই মোটরসাইকেলে ১০ টাকা, অটোরিকশা ১৮, কার ৬০, জিপ ৭০, মাইক্রোবাস ৮৫, পিকআপ ১৩০, মিনিবাস ও চার চাকার ট্রাক ১৭৩, বাস ও ছয় চাকার ট্রাক ২৬০ এবং ট্রেইলার ও কাভার্ড ভ্যানে ৩৪৫ টাকা টোল আদায় করা হচ্ছে।

চুক্তি মোতাবেক ফ্লাইওভারে টোলের হার নির্ধারণ করার কথা সিটি করপোরেশনের। এটা পুনর্নির্ধারণ করার কথা তিন বছর পর পর। তবে ওরিয়ন টোলহার আরো বাড়াতে চায়। এক্ষেত্রে ফ্লাইওভারটির নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধি, নির্মাণ বিলম্বকালীন (পাঁচ বছর) মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংকঋণের সুদ আনুপাতিক হারে যুক্ত করে টোলের হার পুনর্নির্ধারণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এর সঙ্গে যুক্ত হবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট।

এতে টোল দাঁড়াবে মোটরসাইকেলে ২৩ টাকা ৩০ পয়সা, অটোরিকশা ৪৬ টাকা ৬০, কার ১৬৩ টাকা ৭, জিপ ১৮৬ টাকা ৩৯, মাইক্রোবাস ২৩২ টাকা ৯৯, পিকআপ ৩৪৩ টাকা ৪৯, মিনিবাস ও চার চাকার ট্রাক ৪৬৫ টাকা ৯৮, বাস ও ছয় চাকার ট্রাক ৮৭১ টাকা ৪৭ এবং ট্রেইলার ও কাভার্ড ভ্যানে ৯৩১ টাকা ৯৬ পয়সা। গত অক্টোবরে আরবিট্রেশনে এ-সংক্রান্ত পৃথক মামলা করে ওরিয়ন। পাশাপাশি প্রকল্প এলাকা দ্রুত হস্তান্তর না করায় ১ হাজার ৪৩৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণও দাবি করা হয়।

ডিএসসিসির আইন কর্মকর্তা মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে যে অতিরিক্ত টোল আদায় করা হচ্ছে, তা বন্ধে শিগগিরই আপিল বিভাগে আবেদন করা হবে। এক্ষেত্রে সরাসরি অতিরিক্ত টোল আদায় বন্ধের নির্দেশ চাওয়া হবে। তাই টোল আরো বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। চুক্তি অনুযায়ী সিটি করপোরেশনের কাছে ওরিয়নের ক্ষতিপূরণ পাওয়ারও কোনো সুযোগ নাই। ফলে এ মামলায় কোনো ফল পাওয়া যাবে না।

(ওএস/এটিঅার/আগস্ট ০১, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৮ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test