E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

নতুন আইনে উচ্চ আদালতের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা

২০১৪ আগস্ট ১৯ ১৫:২২:০১
নতুন আইনে উচ্চ আদালতের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা

সিনিয়র রিপোর্টার : উচ্চ আদালতের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতেই বিচারপতিদের অভিশংসন (অপসারণ) ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকা উচিত। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রীসভা। এখন জাতীয় সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে বিষয়টি কার্যকর হবে।

কিন্তু এই পদক্ষেপের ফলে আদৌ জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে, না কি উচ্চ আদালতে স্বাধীনতা মারাত্মকভাব ক্ষুণ্ণ হবে তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। এর মধ্য দিয়ে বিচারপতিরা জাতীয় সংসদ তথা সরকারের অনুগত ও আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারে বলেও শঙ্কা রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকার বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে দেয়ার পেছনে যেসব যুক্তি দেখাচ্ছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো -জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে গড়া জাতীয় সংসদ রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গের মতো বিচার বিভাগ তথা বিচারপতিদের জবাবদিহি করতে পারবে।

সরকারের পক্ষ থেকে আরও দাবি করা হচ্ছে এই নীতিভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও শ্রীলংকাসহ পৃথিবীর অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অনুসৃত হচ্ছে।

এর ব্যাখ্যায় আরও বলা হয়েছে, এ বিধান পুনঃপ্রবর্তিত হলে স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা আরও বৃদ্ধির পাশাপাশি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কাছে এর জবাবদিহিতা থাকা-সংক্রান্ত সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সমুন্নত থাকবে।

সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের অধিকতর সংশোধনের জন্য প্রস্তুত করা বিলে বলা হয়েছে, সংবিধানের৯৬ অনুচ্ছেদের পরিবর্তে 'বিচারকদের পদের মেয়াদ'শিরোনামে চারটি অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপিত হবে।

অনুচ্ছেদগুলো হচ্ছে-১. ৬৭ বছর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত বিচারক নিজ পদে বহাল থাকবেন;২. প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে দেওয়া রাষ্ট্রপতির আদেশ ছাড়া কোনো বিচারককে অপসারণ করা যাবে না; ৩. এই অনুচ্ছেদের ২ নম্বর দফার অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে; ৪. কোনো বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে পদত্যাগ করতে পারবেন।

গত ২৬ জুন উচ্চ আদালতের বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের পরিবর্তে জাতীয় সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিতে আইন কমিশন- আইন,বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সুপারিশ করে। এতে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অভিশংসনের বিষয়ে বর্তমান সংবিধান সংশোধন করে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে।

মহাজোট সরকারের আমলে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা ফের সংসদের হাতে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১২ সালে সংসদের তৎকালীন স্পিকার ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের একটি রুলিংকে কেন্দ্র করে কয়েকজন এমপি হাইকোর্টের একজন বিচারপতিকে অভিশংসনের দাবি তোলেন। এতে বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনার দাবি জোরালো হয়।

গত ২৬ জুলাই গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন,একজন সামরিক শাসক (জিয়াউর রহমান) সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করেছিলেন। গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার সঙ্গে এটি খাপ খায় না।

গত ৩১ মার্চ মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিচারকদের অভিশংসন ক্ষমতা জাতীয় সংসদে ফিরিয়ে আনতে বিলের খসড়া প্রস্তুত করতে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হককে নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

আইনমন্ত্রীবলেন,'উন্নয়নশীল অনেক দেশেই এ ক্ষমতা জাতীয় সংসদকে দেওয়া আছে। বেশ কয়েকটি দেশের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন-বাংলাদেশে সে অধিকার জাতীয় সংসদকে দেওয়া হলে অমূলক কিংবা অবাস্তব কিছু হবে না।'

বর্তমানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদের কাছে দায়বদ্ধ। তাদের নৈতিক স্খলন হলে কিংবা অন্য কোনো কারণে জাতীয় সংসদ তাদের ইমপিচ করতে পারে। কিন্তু বিচারপতিদের ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদ তা করতে পারে না। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনের জন্য গঠিত কমিটির পক্ষ থেকে একই সুপারিশ করা হয়েছিল।

আইন মন্ত্রী আরও বলেন, 'বিচারপতিদের অপসারণ বা অভিশংসনের পদ্ধতি নিয়ে ৩ মাসের মধ্যে নতুন আইন করা হবে।সংবিধানের (ষোড়শ সংশোধন) আইন ২০১৪-এর আলোকেই নতুন এ আইন করা হবে।এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন,‘বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদকে দেওয়ার কারণে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হবে না বলে আমি বিশ্বাস করি।’

আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বলেন, বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদকে দিলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হবে না। গণতন্ত্রের সূতিকাগার ইংল্যান্ডে এই ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত গণতন্ত্রের সব দেশেই এটা আছে। এমনকি ভারতেও এটা আছে।

বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের অবস্থা উন্নত দেশগুলোর মতো না হওয়ার পরও বিচারক অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদকে দেয়া ঠিক হবে কি-না জানতে চাইলে বিচারপতি খায়রুল হক বলেন,সংসদকে এই ক্ষমতা দেয়ার সময় ওই সব দেশের অবস্থাও আমাদের মতোই ছিল।

এই ক্ষমতা সংসদকে ফিরিয়ে দিলে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে-এমন মন্তব্য করে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি খায়রুল বলেন,আমাদের দেশে বাহাত্তরের সংবিধানেও এটা ছিল। কিন্তু কাউকে অভিশংসন করা হয়নি।

প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এইচ টি ইমাম বলেন, রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করা গেলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের কেন করা যাবে না? বিচারকরা তো সবকিছুর ঊর্ধ্বে নন।

তবে, প্রবীণ আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন,'বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদকে দেওয়া হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। কারণ রাজনৈতিক ইস্যুতে বিচারাধীন মামলার ক্ষেত্রে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকার সব সময়ই সংসদের মাধ্যমে বিচারকদের চাপ প্রয়োগ করার সুযোগ পাবে।'

সুপ্রিম কোর্টের এই সিনিয়র আইনজীবী এবং সাবেক অ্যাটর্ণি জেনারেল র‌্যারিস্টার রফিকুল হক আরও বলেন, বিচার বিভাগকে শক্তিশালী করতেই মূল সংবিধান সংশোধন করে বিচারকদের অপসারণের বিষয়ে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।

সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, 'বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতেই সংবিধান সংশোধন করে বিচারকদের অপসারণের বিষয়ে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিধান করা হয়েছিল। এটা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সুদৃঢ় করে। এখন সরকার বিচারকদের অপসারণের বিষয়ে সংসদকে যে ক্ষমতা দিতে চাইছে, তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করবে।

এই আইন পাস হলে বিচারকরা স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারবেন না বলেও আশংকা প্রকাশ করেন খন্দকার মাহবুব।

উচ্চ আদালতের বিচারকদের অভিশংসন করার ক্ষমতা সংসদের কাছে দেওয়ার উদ্যোগ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, বর্তমান সংসদ নির্বাচিত নয়। এখানে জনমতের প্রতিফলন হয় না। এ সংসদে সঠিক বিচার হবে না। যখন একদলীয় শাসন ছিল,তখন এই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে চলে যায়।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার বলেন,'সংসদের হাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হবে। বিচার বিভাগ এমনিতেই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। এ অবস্থায় এই ধরনের আইন করলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুরোপুরি ক্ষুণ্ণ হবে।'

সংবিধান সংশোধন করে বিচারপতিদের অপসারণ বা অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য ‘সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) আইন-২০১৪’ এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।

সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সভাকক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইয়া প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান।তিনি বলেন,‘ভেটিং সাপেক্ষে আইনের খসড়াটি চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।’

১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অদক্ষতা,অযোগ্যতা,দুর্নীতিসহ অসদাচরণের কারণে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ছিল। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান এক সামরিক ফরমানে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা বাতিল করেন। এ সময় বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে।

উল্লেখ্য, গত মহাজোট সরকারের সময়ে সুপ্রিমকোর্টের জমি নিয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগকে দেওয়া হাইকোর্টের আদেশের বিষয়ে তৎকালীন স্পিকার আবদুল হামিদ ২০১২ সালের ২৯ মে একটি বক্তব্য দেন। তিনি সংসদে বলেছিলেন, ‘দেশের মানুষের বিচারের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর লেগে যাবে আর নিজেদের বিষয় হলে বিচার বিভাগ ঝটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবে, এটি ভালো দেখায় না। আদালতের রায়ে ক্ষুব্ধ হলে জনগণ বিচার বিভাগের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে পারে।’

এর পর হাইকোর্টে এ সংক্রান্ত মামলার শুনানিতে স্পিকারের বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল বলে মন্তব্য করেন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী (মানিক)। এর পরই বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসতে শুরু করে।

(ওএস/এটিআর/আগস্ট ১৯, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test