E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

হবিগঞ্জের ‘মঞ্জুরী ভবন’ এখন যেন কোনো যুদ্ধের ধ্বংসস্তুপ

২০২১ এপ্রিল ২২ ০০:২৭:২২
হবিগঞ্জের ‘মঞ্জুরী ভবন’ এখন যেন কোনো যুদ্ধের ধ্বংসস্তুপ

উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ ডেস্ক :  অমূল্য দাশ একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। সারাজীবনের সঞ্চিত অর্থে শখ করে হবিগঞ্জ শহরে বানিয়েছিলেন  একটি বাড়ি, জীবনের ঠিকানা। স্ত্রীর নামে বাড়ির নাম রেখেছেন ‘মঞ্জুুরী ভবন’। মেয়ের জামাইয়ের উপর ক্ষোভের জের ধরে একদল উৎশৃঙ্খল যুবকের আক্রমনে ৩ তলা ভবনটির পুরো জায়গা জুড়ে আছে শুধু তাণ্ডবের চিহ্ন। অমূল্য দাশের স্ত্রী মঞ্জুরী দাশ পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপক।

এই দম্পত্তির দুই কন্যা। দুইজনই লন্ডন প্রবাসী। শেষ বয়সে স্বামী স্ত্রী শান্তিতে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গত ১৯ এপ্রিল সোমবার পরিকল্পিত হামলায় সবকিছু তচনছ হওযায় সাবেক অডিটর অমূল্য দাশ অনেকটা বাকরুদ্ধ। স্ত্রী মঞ্জুরী দাশ মাসখানেক আগে ষ্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে এখন শয্যাশায়ী। চোখের সামনে বাসার দরজা জানালা আসবাবপত্র ভাংচুর, লুটপাট হলেও ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার শক্তিই ছিল না তার। এদিকে ভবনটির অন্যান্য ফ্লাটের ভাড়াটিয়ারা সর্বস্ব হারিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাদের চোখে মুখে এখনো অজানা ভীতি। নিরাপত্তার জন্য এখনও সেখানে পুলিশ মোতায়েন রাখা হয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্থ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রবিবার শাহ আরজু নামে এক ব্যক্তি ফেসবুকে দৈনিক আমার হবিগঞ্জের বিরুদ্ধে সোমবার বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেন। ঘটনার দিন সোমবার বেলা ১২টার দিকে শহরের চিড়াকান্দি ও আশপাশ এলাকা ঘিরে রাখে প্রায় দুই তিন শ যুবক। এলাকাটিতে অধিকাংশই হিন্দু পরিবারের বসবাস। আতংক ছড়িয়ে পড়ে শতাধিক বাসা বাড়িতে। পুলিশ নিরাপত্তার জন্য ঘটনাস্থলে অবস্থান নেয়। দুপুর একটার দিকে সমবেত যুবকেরা প্রথমেই পত্রিকার অফিস লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। দফায় দফায় ইটপাটকেল নিক্ষেপের এক পর্যায়ে পুলিশের বেষ্টনি ভেঙ্গে এরা পত্রিকার অফিসের পাশে থাকা ‘মঞ্জুরী ভবনে’ হামলা চালায়। এরা কলাপসিবল গেট ও ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে প্রবেশ করে। দলবদ্ধ হয়ে চালায় ভাংচুর , লুটপাট। ভয়ভীতি দেখিয়ে নারীদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নেয় স্বর্ণালংকার। তালা ভেঙ্গে আলমিরা থেকে টাকা পয়সা দামি জিনিসপত্র লুটে নেয়। এসময় হামলাকারিদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে সুশান্ত দাশ গুপ্ত, তার ভাগ্নে হরি , শুভ আহত হন। ওই ভবনটি দৈনিক আমার হবিগঞ্জ সম্পাদক সুশান্ত দাশ গুপ্তের শ্বশুরের বাসা। পুলিশ এসময় ১১ রাউন্ড টিয়ার গ্যাস ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ততক্ষনে লন্ডভন্ড হয়ে যায় বাসার পানির ট্যাংক, ফুল বাগান থেকে শুরু করে সব কিছু। আতঙ্কিত নারী পুরুষদের গগনবিদারী আর্তনাদে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠে। পরবর্তীতে র‍্যাব ও বিজিবি ঘটনাস্থলে পৌছলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আসে। বাসার ভাড়াটিয়া পংকজ দেব রায় বলেন, বৃস্টির মতো ইটপাটকেল ছুড়া হয়েছে বাসাকে লক্ষ্য করে। পুলিশ থাকার পরেও এরা বিল্ডিংয়ে ঢুকে যে যেভাবে পারে জিনিসপত্র লুটে নিয়েছে। হবিগঞ্জে ধরনের ঘটনা কখনও ঘটেছে বলে মনে হয় না। লকডাউনের কারণে বাসায় ছিলাম। নইলে আমার বৌ বাচ্চাদের কি হতো ভগবানই জানেন।

হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের একজন শীর্ষ নেতার নির্দেশে হবিগঞ্জ পৌর মেয়র ও জেলা যুবলীগের সভাপতি আতাউর রহমান সেলিমের উপস্থিতিতে যুবলীগ, ছাত্রলীগের কিছু কর্মীরা এই ঘটনা ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন দৈনিক আমার হবিগঞ্জ সম্পাদক সুশান্ত দাশ গুপ্ত।

তিনি বলেন, ওই দুই নেতাসহ কয়েকজন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করায় তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন। সোমবারের ঘটনার মধ্যদিয়ে তারা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছেন। তাদের প্রত্যক্ষ মদদে এর আগে একাধিকবার পত্রিকা বন্ধের জন্য মিছিল, মানব বন্ধন, জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে । সাংসদ আবু জাহিরের দুর্নীতির খবর প্রকাশ করায় গত বছর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আমাকে সহ ৩ সহকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। আমাদেরকে বেশ কিছুদিন জেলে থাকতে হয়েছে। তিনি বলেন সোমবার রাতে পত্রিকা না ছাপার জন্য ১০/১৫টি মোটরসাইকেলে কিছু যুবককে দিয়ে প্রেসের কর্মচারিকে মারধর ও প্রেস আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলার হুমকী দেয়া হয়েছে । এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার ও বুধবারের সংখ্যা জেলা সদরের বাইরে থেকে পত্রিকা ছাপাতে হয়েছে।

অভিযোগ প্রসঙ্গে হবিগঞ্জের নবনির্বাচিত মেয়র ও জেলা যুবলীগের সভাপতি আতাউর রহমান সেলিম বলেন, আমার হবিগঞ্জ হবিগঞ্জের বিশিষ্টজনদের বিরুদ্ধে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করছে। এর জের ধরেই এই ঘটনাটি ঘটেছে বলে তিনি ধারনা করছেন। জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমার দায়বদ্ধতা রয়েছে। তাই ঘটনাস্থলে গিয়ে সংঘর্ষ থামানোর চেষ্টা করি। হ্যান্ডমাইক দিয়ে আমি রমজান মাসের দোহাই দিয়ে দু’পক্ষকে থামাতে চেষ্টা করি। বিক্ষুব্ধ যুবলীগ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সেখান থেকে ফিরিয়ে না আনলে খুনখারাপি হয়ে যেত। হবিগঞ্জ থানার ওসি মাসুক আলী পত্রিকার বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সংবাদকে কেন্দ্র করে এই হামলা হয়েছে বলে জানান। পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা গনমাধ্যমকে জানান, পুলিশের চোখ ফাকি দিয়ে হামলাকারিরা পাশের একটি ভবনের ছাদে দিয়ে মঞ্জুরী ভবনে ঢুকে পড়ে। ঘটনার তদন্ত চলছে। এখনও মামলা হয়নি। এই ঘটনায় পুলিশ আহত হওয়ায় মামলার প্রস্তুতি চলছে।

ঘটনার পর দিন মঙ্গলবার জেলা প্রশাসক ইসরাত জাহান,পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যাসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ক্ষতিগ্রস্থ মঞ্জুরী ভবনে পরিদর্শনে যান। এসময় তাদের সাথে ছিলেন হবিগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোতাচ্ছিরুল ইসলাম, সাবেক পৌর মেয়র মিজানুর রহমান, আওয়ামীলীগ নেতা অনুপ কুমার দেব মনা, মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি সামছু মিয়া প্রমুখ। তারা ক্ষতিগ্রস্থদের সমমর্মিতা জানান। দোষিদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে জানান জেলা প্রশাসক।

এদিকে বাসাবাড়িতে সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছে কমিউনিষ্ট পার্টি, বাসদ(মার্কসবাদী), গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতি , উদীচী। মঙ্গলবার ওই সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ হামলার শিকার বাসভবনটি পরিদর্শন করেন। তারা ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। অবিলম্বে হামলাকারিদের গ্রেফতারের দাবি জানান। সুশাসনের জন্য নাগরিক ও বিশিষ্ট হিন্দু কমিউনিটি নেতা এডভোকেট ত্রিলোক কান্তি চৌধুরী বিজন বলেন, চামচামিতে আমরা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছি যে, হিন্দুদের বাসাবাড়িতে এতো বড় সন্ত্রাসী হামলা হয়ে গেল, তার প্রতিবাদে এখন পর্যন্ত হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, পূজা উদযাপন পরিষদের মতো সংগঠনগুলো মানব বন্ধন, মিছিল তো দূরের কথা, একটি বিবৃতি দেওয়ার দায়িত্বও পালন করেনি।

(ওএস/পিএস/২২ এপ্রিল, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

২৩ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test