E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ইতিহাসের সাক্ষী ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ’ : এশিয়ার বৃহত্তম রেল সেতু

২০১৫ জানুয়ারি ০১ ১৯:৩৩:০৫
ইতিহাসের সাক্ষী ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ’ : এশিয়ার বৃহত্তম রেল সেতু

ঈশ্বরদী(পাবনা) প্রতিনিধি : এশিয়ার বৃহত্তম রেলসেতু ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ’ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সেতু বন্ধন ২০১৫ সালে শতবর্ষে পদার্পণ করছে। ইতিহাসের সাক্ষী ঈশ্বরদীর পাকশীতে পদ্মা নদী বক্ষে ১৯৭১ সালে সেলের আঘাত সহ্য করে আজো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ’। শত বছর আগে অবিভক্ত ভারতের পূর্ব বাংলার সাথে কলকাতা এবং অন্যান্য স্থানের যোগাযোগের মূল লক্ষ্যই ছিল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। সময়ের গতিধারায় ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও ঐতিহাসিক হার্ডিজ্ঞ ব্রিজ প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ‘যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক  সমৃদ্ধি’র ক্ষেত্রে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ আজও তার উজ্জ্বল ভূমিকায় মহিমান্বিত। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কারণেই আগামীতে আরো আঞ্চলিক সহযোগিতার দ্বার উন্মোচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বৃটিশ শাসনামলেরও আগে থেকে কলকাতার সাথে পূর্ব বাংলার যোগাযোগ ব্যবস্থার মূল মাধ্যম ছিল জলপথ। নৌপথে নারায়নগঞ্জ ঘাট হতে জাহাজ ছেড়ে ঈশ্বরদীর সাঁড়া ঘাট, রায়টাঘাট হয়ে কলকাতা বন্দরে পৌঁছাতো। পদ্মার সুস্বাদু ইলিশ মাছ থেকে শুরু করে শাক-সবজি সহ বিভিন্ন পণ্য দ্রব্য পূর্ব বাংলা হতে জাহাজে করেই কলকাতা চালান হয়ে যেত। এভাবেই কলকাতার সাথে পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কারণে আঞ্চলিক অর্থনীতি প্রবৃদ্ধি লাভ করে। তদানিন্তন বেনিয়া বৃটিশ সরকার ব্যবসা-বানিজ্য, পর্যটক তথা অবিভক্ত ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরা, আসাম, নাগাল্যান্ড ও উত্তরবঙ্গের সাথে কলকাতা ও দিল্লির যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কথা বিবেচনা করে ১৮৮৯ সালে ভয়াল পদ্মা নদীর উপর এই সেতু তৈরীর প্রস্তাব করে।

ঈশ্বরদীর পাকশীতে রেলওয়ের বিভাগীয় দপ্তরের ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ার কার্যালয়ে রক্ষিত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায়, ১৯০৮ সালে ব্রিজ নির্মাণের মঞ্জুরী পাওয়ার পর ব্রিটিশ প্রকৌশলী স্যর রবার্ট উইলিয়াম গেইলস হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রধান প্রকৌশলী রবার্ট শুধু ব্রিজের নকশা প্রণয়ন করেন। ব্রিজের প্রথম প্রকল্প প্রণয়ন করেন স্যর এস এম রেলডলস। এই ব্রিজে রয়েছে ১৫টি মূল স্প্যান। যার প্রতিটি বিয়ারিং-এর মধ্যবর্তী দৈর্ঘ্য ৩৪৫ ফুট এবং উচ্চতা ৫২ ফুট। একেশটি স্প্যানের ওৎন ১ হাজার ২’শ ৫০ টন। রেল লাইন সহ মোট ওজন ১ হাজার ৩’শ টন। ব্রিজে ১৫টি স্প্যান ছাড়াও দু’পাশে রয়েছে ৩টি করে অতিরিক্ত ল্যান্ড স্প্যান। এছাড়াও দু’টি বিয়ারিং-এর মধ্যবর্তী দৈর্ঘ্য ৭৫ ফুট। অর্থাৎ ব্রিজের মোট দৈর্ঘ্য ৫ হাজার ৮’শ ৯৪ ফুট, এক মাইলেরও কিছুটা বেশী। ব্রিজ নির্মাণে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ছিল রেইথ ওয়ালটি এন্ড ক্রিক। এই সময় পদ্মা ছিল যেমন প্রমত্তা তেমনি রূপও ছিল ভয়াল। ব্রিজ নির্মাণের চেয়েও বড় সমস্যা ছিল নদীর গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে স্থায়ীভাবে নীচ দিয়ে যাওয়া। ব্রিজ নির্মাণের শত বছর পরেও পৃথিবীর প্রকৌশলীদের নিকট আজো বিস্ময় ব্রিজ নির্মাণের কাজ বা রিভার ট্রেনিং ওয়ার্ক। ১৯১২ সালে ব্রিজের গাইড ব্যাংক নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ৪ থেকে ৫ মাইল উজান হতে ব্রিজের গাইড ব্যাংক বেঁধে আনা হয়। এ বছরই গার্ডার নির্মাণের জন্য ৫টি কূপ খনন করা হয় এবং পরবর্তী বছরে ৭টি কূপ খনন করা হয়। এরপর লোহা ও সিমেন্টের কংক্রিটের সাহায্যে নির্মিত হয় বিশাল আকৃতির পায়া গুলো। ব্রিজ নির্মাণের জন্য পদ্মার উপর ষ্টিমার ও বার্জ আনা হয়। ব্রিজ নির্মাণ ও রক্ষা বাঁধের জন্য ১.৬ কোটি ঘনফুট মাটি এবং নদী শাসনে প্রয়োজন হয় ৩ কোটি ৮৬ লাখ ঘনফুট মাটি। ৩ কোটি ৮ লাখ ঘনফুট পাথর ব্যবহারের পাশাপাশি ২ লাখ ৯৯ হাজার টন ইটের গাঁথুনির কাজ হয়। মোট সিমেন্ট ব্যবহারের পরিমান ছিল ১ লাখ ৭০ হাজার ড্রাম ফিল্ড। সেই সময়ের হিসেব অনুযায়ী মূল স্প্যানের জন্য ব্যয় হয় ১কোটি ৮০ লাখ ৫৪ হাজার ৭৯৬ টাকা। স্থাপনের জন্য ৫ লাখ ১০ হাজার ৮৪৯ টাকা, নদী শাসনের জন্য ৯৪ লাখ ৮ হাজার ৩৪৬ টাকা এবং দু’পাশের রেল লাইনের জন্য ৭১ লাখ ৫৫ হাজার ১৭৩ টাকা। অর্থাৎ একশ বছর আগেই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণে মোট ব্যয় হয় ৩ কোটি ৫১ লাখ ২৯ হাজার ১৬৪ টাকা। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের বিশেষ বিশেষত্ব হলো ভিত্তির গভীরতা। ব্রিজ নির্মাণে ২৪ হাজার ৪’শ শ্রমিক কর্মচারী ৫ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে। ১৯১৫ সালে ব্রিজের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকবাহিনী যখন খুলনা ও যশোরে পরাজয়ের পর পিছু হটে ঈশ্বরদীতে সমাবেত হওয়ার উদ্দেশ্যে একটি ট্রেনে আসছিল। এসময় ১৩ই ডিসেম্বর পাকবাহিনীকে কোনঠাসা করার লক্ষ্যে মিত্র বাহিনী বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ করলে ১২ নম্বর স্প্যানটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। স্বাধীনতার পর যথারীতি ব্রিজটিকে মেরামত করে পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা হয়।

হার্ডিঞ্জ সেতুকে ঘিরে ঈশ্বরদীর পাকশী দেশের একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিত। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ইতিমধ্যেই ভূগোল-ইতিহাস-সাধারণ জ্ঞানের পাঠ্য পুস্তকের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের পর এই আশ্চর্য কির্তি দেখার জন্য দেশের দূর-দূরান্ত হতে অতীতেও যেমন দর্শকের সমাগম হতো এখনও প্রতিদিনই নতুন প্রজন্মের সমাগম ঘটে। শীত মৌসুমে বিভিন্ন স্থান হতে আসে পিকনিক পার্টি। হাডিঞ্জ ব্রিজের কারণেই রেলের বিভাগীয় দপ্তর পাকশী সবুজে ঘেরা অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত।

আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত সময়ে হার্ডিঞ্জ সেতুর পাশে আরেকটি সড়ক সেতু বর্তমান লালন শাহ সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়। এ সময় যোগাযোগ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেন। পাশে সড়ক সেতু নির্মাণ হলেও হার্ডিঞ্জ ব্রিজের গুরুত্ব কমেনি। বরঞ্চ এখন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতিমধ্যেই উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের সাথে রাজধানী ঢাকার সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। দেশীয় পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি রেলপথে ভারতের সাথে আমদানি-রপ্তানী বাণিজ্যে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে। যাত্রী পরিবহনে ভারতের সাথে রেল যোগাযোগে ‘মৈত্রি এক্সপ্রেস’ ট্রেন হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর দিয়ে চলাচল করছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে ট্রানজিট এবং ট্রান্সশিপমেন্ট ব্যবস্থা জোরদার করতে বর্তমান সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন করেছে। রেলওয়ের মাধ্যমে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর দিয়ে ট্রানজিট চালু হলে দেশীয় ও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক আরও সুদৃঢ় হবে।

(এসকেকে/পি/জানুয়ারি ০১, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test