E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

রাজাকার কমান্ডার সেকেন্দারের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ

২০১৫ জুন ১৬ ১৫:৫৭:১৯
রাজাকার কমান্ডার সেকেন্দারের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ

আঞ্চলিক প্রতিনিধি, বরিশাল : স্বাধীনতা যুদ্ধচলাকালীন সময় মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী, তরুণ, যুবক ও শরণার্থীসহ ১২ জনকে হত্যার সাথে সরাসরি জড়িত থাকাসহ হামলা, লুটপাট, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ এনে চিহ্নিত রাজাকার কমান্ডার এবং তৎকালীন শান্তি কমিটির সভাপতি সেকেন্দার বাহিনীর প্রধান সেকেন্দার মল্লিকের (৬৭) বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলাসহ আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। বরিশালের শহীদ বুদ্ধিজীবী জিতেন্দ্র লাল দত্তের পুত্র সাংবাদিক তিমির দত্ত বাদি হয়ে মামলাসহ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করেছেন।

তিমির দত্ত জানান, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ১২জন দেশ প্রেমিককে হত্যার সাথে জড়িত রাজাকার কমান্ডার সেকেন্দার মল্লিক ও তার বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে দুইটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সুযোগে রাজাকার সেকেন্দার ওইসময় রেহাই পেয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের মতো এখনও তার (সেকেন্দারের) কাছে অসহায় ঝালকাঠীর নলছিটি উপজেলার সিদ্ধকাঠী ইউনিয়নের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরেও সে (সেকেন্দার) এখনো দাপটের সাথে এক শহীদ বুদ্ধিজীবীর পৈত্রিক ভিটা দখল করে রেখেছে। তিনি আরও জানান, যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর মানবতাবিরোধী রাজাকার কমান্ডার সেকেন্দার মল্লিক ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে পুনরায় যুদ্ধাপরাধের মামলাসহ আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। যা বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে।

সূত্রমতে, মুক্তিযুদ্ধকালে নলছিটির সিদ্ধকাঠী ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সভাপতি ছিলো সেকেন্দার মল্লিক। তার পিতা মুজাহার মল্লিক ছিলো মুসলিম লীগের নেতা। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর নিজ নামে সে “সেকান্দার বাহিনী” নামের একটি রাজাকার বাহিনী গঠন করে। সরাসরি তারা পাকিস্তান সরকারের পক্ষে মাঠে নেমে প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সব কর্মকান্ড করতে থাকে। ওইসময় সিদ্ধকাঠীর বিরাট গ্রামের বর্ধিষ্ণু ছিল “দত্ত পরিবার”। পরিবারের অন্যতম কর্তা জিতেন্দ্র লাল দত্ত তখন বরিশাল বারের আইনজীবী। পরিবার নিয়ে তিনি বসবাস করতেন বরিশাল শহরের আগরপুর রোডের বাসায়।

সেকেন্দার মল্লিক ও তার বাহিনীর হাতে শহীদ জিতেন্দ্র লাল দত্তের পুত্র তিমির দত্ত বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতের পর নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে বরিশাল শহর ছেড়ে ঝালকাঠীর নলছিটি উপজেলার সিদ্ধকাঠী ইউনিয়নের বিরাট গ্রামের বাড়িতে চলে যান। ৫ এপ্রিল সেকেন্দারের নেতৃত্বে তার অন্যতম সহযোগী মোকতার মোল্লা ওরফে জাকির হোসেন, রব খান তোতাসহ ৩০/৩৫ জনে তাদেরসহ (দত্ত বাড়ি) বিরাট গ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘরে হামলা চালায়। একপর্যায়ে গণধর্ষণ ও ব্যাপক লুটপাটের পর দত্ত বাড়ির বেশ কয়েকটি ঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সূত্রে আরও জানা গেছে, ওই বছরের ১ জুন বিরাট গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা, তরুণ, যুবক, শরণার্থীসহ ৪০ জন নিরিহ ব্যক্তিকে রাজাকার কমান্ডার সেকেন্দার মল্লিক তার সহযোগীদের নিয়ে তুলে দেয় পাক সেনা ও পুলিশের হাতে।

এদের মধ্যে ছিলেন বুদ্ধিজীবী জিতেন্দ্র লাল দত্ত এবং তার দুই পুত্র সুবীর দত্ত ও সাংবাদিক মিহির দত্ত। পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন আজমলের নির্দেশে ৩ জুন ঝালকাঠীর সুগন্ধা নদীর তীরে নিয়ে সুবীর দত্ত, মৃত রাজেন্দ্র নাথ দুয়ারীর পুত্র ধীরেন্দ্রনাথ দুয়ারী, নরেন্দ্রনাথ দুয়ারী, মৃত অশ্বিনী বিশ্বাসের পুত্র লক্ষ্মন বিশ্বাস, কৃষ্ণ দাসের পুত্র বিজয় দাসসহ ১১ জনকে গুলি করে হত্যা করে তৎকালীন ঝালকাঠী পুলিশের ইন্সপেক্টর শাহ আলম। সুবীর দত্তসহ ১১ জনকে হত্যার পর জিতেন্দ্র লাল দত্ত ও তার আরেক পুত্র সাংবাদিক মিহির দত্তকে টানা ১২ দিন পাকসেনাদের ঝালকাঠী ক্যাম্পে আটক করে রাখা হয়। পরবর্তীতে প্রথমে বরিশাল গোয়েন্দা অফিস এবং পরে তাদের বরিশাল শহরের তৎকালীন ওয়াপদা আর্মি ক্যাম্পে পাঠানো হয়।

সেখানে আইনজীবী হিসেবে পরিচয়পত্র দেখিয়ে জিতেন্দ্র লাল দত্ত মুক্তি পেলেও তার পুত্র সাংবাদিক মিহির দত্তকে পাঠিয়ে দেয়া হয় যশোর ক্যান্টনমেন্টে। টানা দু’মাস আটক থাকার পর কৌশলে সেখান থেকে মিহির দত্ত পালিয়ে আসেন। সূত্রটি আরও জানিয়েছেন, আগস্টের প্রথম দিকে বরিশালে আসেন মিহির। ১৪ অক্টোবর সেকেন্দার মল্লি¬কসহ তার অন্যান্য সহযোগীরা বরিশাল শহরের বাসা থেকে জিতেন্দ্র লাল দত্ত ও তার পুত্র মিহির দত্তকে ধরে নিয়ে যায়। ১৫ অক্টোবর শহরের সিঅ্যান্ডবি পুলে নিয়ে রাজাকার কমান্ডার সেকেন্দার ও তার সহযোগীরা বাবা-ছেলেকে গুলি করলে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন বুদ্ধিজীবী জিতেন্দ্র লাল দত্ত। আর খালের পানিতে মরার ভ্যান করে ভাসতে ভাসতে জীবনে রেহাই পান মিহির লাল দত্ত।

স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে (১৯৭৩ সালের ২২ জুলাই) এ লোমহর্ষক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শহীদ বুদ্ধিজীবী জিতেন্দ্র লাল দত্তের পুত্র মিহির লাল দত্ত বাদি হয়ে রাজাকার কমান্ডার সেকেন্দার মল্লিক, তার অন্যতম সহযোগী মৃত হাতেম মোল্লার পুত্র মোকতার মোল্লা ওরফে জাকির হোসেন, মৃত চাঁন খানের পুত্র রব খান তোতাসহ ৩০/৩৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে নলছিটি থানায় মামলা নং-৫ (১৭৩) ও বরিশাল কোতয়ালী থানায় মামলা নং-৪৩ (৯৭২) দুটি মামলা দায়ের করেন। এরইমধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়। ওই বছরের ১৪ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের ৩০৩৪ স্মারকে ২০১১৭৬ নং আদেশে মিহির লাল দত্ত বাদি হয়ে দায়ের করা উভয় মামলায় সেকেন্দার মল্লিক ব্যতিত অন্যসব আসামিদের অব্যাহতি দেয়া হয়। পরবর্তীতে তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ধারাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় রাজাকার কমান্ডার সেকেন্দার মল্লিক। একপর্যায়ে সে দখল করে নেয় শহীদ বুদ্ধিজীবী জিতেন্দ্র লাল দত্তের বিরাট গ্রামের পৈত্রিক ভিটা।

শহীদ বুদ্ধিজীবীর পুত্র সাংবাদিক তিমির দত্ত জানান, ২০০৯ সালের ৫ মে তিনি বাদি হয়ে রাজাকার কমান্ডার সেকেন্দার মল্লিকসহ তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে নলছিটি থানার মামলা দায়ের করেন (যার নং-৪)। ওইবছরের ২৮ জুন তৎকালীন বরিশালের ডিআইজি (১৪/২০০৯/৩২২৩ স্মারকে) ২৪ ঘন্টার মধ্যে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নলছিটি থানার ওসিকে নির্দেশ দিলেও রহস্যজনক কারনে তা আর আলোর মুখ দেখেনি। পরবর্তীতে হতাশাগ্রস্থ হয়ে তিনি (তিমির দত্ত) আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করেছেন। যা বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজনৈতিক উত্থান-পতনে কতিপয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ম্যানেজ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজের কু-কর্ম আড়াল করতে রাজাকার কমান্ডার সেকেন্দার মল্লিক প্রথমে বিএনপিতে পরে ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে জাতীয়পার্টি, আবার বিএনপি এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগে যোগদান করেছে।

মুক্তিযুদ্ধকালীন নলছিটি থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. সেকান্দার আলী উল্লেখিত অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, পাক-বাহিনীর ঘনিষ্ঠ সহচর, গণহত্যার নায়ক ও ধর্ষণ, লুটপাট এবং দখলবাজ রাজাকার কমান্ডার সেকেন্দার মল্লিক যখন সামনে দিয়ে হেঁটে যায়, তখন আমিসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের লজ্জা পাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।

তিনি (মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সেকান্দার আলী) আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তাদের কাছে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী রাজাকার কমান্ডার সেকেন্দার মল্লিকের কু-কর্মের সঠিক তদন্ত করে অনতিবিলম্বে গ্রেফতারপূর্বক ফাঁসির দাবি করেন।

উল্লেখিত সকল অভিযোগ অস্বীকার করে রাজাকার কমান্ডার সেকেন্দার মল্লিক বলেন, যুদ্ধকালীন সময়ে আমি মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছি। মুক্তিযুদ্ধের পর আমার বিরুদ্ধে দুইটি মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছিলো।

১৯৭৫ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সহযোগীতায় উভয় মামলা থেকে আমাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তবে শহীদ বুদ্ধিজীবী জিতেন্দ্র লাল দত্তকে হত্যা ও তার পৈত্রিক সম্পত্তি দখল করে রাখার ব্যাপারে তিনি কোন সদূত্তর দিতে পারেননি।

(টিবি/এএস/জুন ১৬, ২০১৫)

পাঠকের মতামত:

১৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test