E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আলবদর কমান্ডারের মৃত্যুতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শোক!

২০১৬ আগস্ট ২২ ২২:২৪:৩১
আলবদর কমান্ডারের মৃত্যুতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শোক!

বিশেষ প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম : একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানাধীন এলাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর সহায়তাকারি আলবদর বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার আ ন ম মনির আহমদ ওরফে মইন্যা রাজাকার মারা গেছেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বেশ কিছুদিন আত্মগোপনে থেকে ’৭৫ এর পটপরিবর্তনের পরে প্রকাশ্যে আসেন এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকও ছিলেন।

আনোয়ারা উপজেলার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করছেন এমন কয়েকজনের সাথে আলাপকালে এই আ ন ম মনির আহমদ সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। তারা জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামে কর্নফুলী নদীর দক্ষিন তীরে ২০মে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বন্দরগ্রামে যে হত্যাযজ্ঞ, লুটতরাজ, অগ্নিকান্ডসহ নানা ধরনের যে অপকর্ম করেছে তার অধিকাংশের সঙ্গে এই মনির আহমদ ও তার সহযোগিরা জড়িত ছিলেন। একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী এই আলবদর কমান্ডারের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গভার শোক প্রকাশ করেছে।

চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করে তথ্য প্রমাণ দিয়ে বই লিখেছেন এমন একজন জামাল উদ্দিন। তার বাড়িও আনোয়ারা উপজেলায়। তিনি তার ‘আনোয়ারা: একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ’ বইয়ের ২১৯ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘২০ মে বন্দর গ্রামে পাকিস্তানী বাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ড চলাকালে মাদ্রাসা ছাত্র আবু তাহের(পড়ুয়া পাড়া) এবং আ ন ম মনির আহমদ (বারখাইন) আলবদর কমান্ডার ও ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে আত্মপরিচয় দিয়ে নানা অপকর্ম শুরু করে। পাকিস্তানী বাহিনী বন্দর গ্রামে নৃশংষ হত্যাকাণ্ড শুরু করলে মাদ্রাসার কিছু সংখ্যক ছাত্রকে নিয়ে তারা পাকিস্তানী বাহিনীকে সহায়তা করে।’ বন্দর গ্রামের সেই গনহত্যায় কমপক্ষে ২১২ জন বাঙালি শহীদ হন। বন্দরগ্রামেই একটি ছোট টিলার পাদদেশে একটি বধ্যভূমি ও গণকবরও রয়েছে।

সে সময়ের তরুণ মুক্তিযোদ্ধা, পাকবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাতে স্বজন হারানো জগদীশ চন্দ্র সিংহ বলেন, আমিতো যতদূর জানি আ ন ম মনির এরাকায় মইন্যা রাজাকার হিসেবেই পরিচিত, কিন্তু কোন কৌশলে সে পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে গেলো তা বুঝতে পারিনি। অনেক কিছুইতো দেখলাম, হয়তো আরো অনেক কিছু দেখবো। তিনি বলেন, আপনারা বন্দর বধ্যভুমির আশপাশে এসে খবর নেন, জানতে পারবেন তার সম্পর্কে।

আনোয়ারার বারখাইন এলাকার মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম খেদের সাথে বলেন, মইন্যা রাজাকার (আ ন ম মনির আহমদ) আবার চৌধুরী হলো কবে থেকে ? সেতো পশ্চিম চাল মাদ্রাসার ছাত্র ছিল জানতাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ২০/২১ বছর হবে। ইসলামী ছাত্রসংঘ করতো, পরে আলবদর বাহিনীতে যোগ দিয়ে হানাদার পাকিস্তানীদের সহযোগী হিসেবে এমন কোন কুকর্ম নেই যা সে করেনি। পরে ওই অপকর্ম ঢাকার জন্য নামের পরে চৌধুরী লাগিয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, সাংবাদিক ও প্রকাশক জামাল উদ্দিন এ প্রতিবেদককে বলেন, এই আলবদর কমান্ডার আন ম মনিরকে নিয়ে যখন পত্রিকাতে লিখেছি আমি তখন নানাভাবে তা বন্ধ করার জন্য আমার ওপর চাপ দিয়েছে সে। বারখাইনের এই মনিরকেতো বারখাইনসহ আনোয়ারা এলাকার লোকজন চেনে ‘মইন্যা রাজাকার’ হিসেবে। জামাত নেতা আবু তাহের ও যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আরসিহ আরো অনেক যুদ্ধাপরাধীর সঙ্গে তার গভীর সখ্যতা ছিল। দেশ স্বাধীন হবার পর আত্মগোপন করে। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপরিবারে নিহত হবার পর সে প্রকাশ্যে চলে আসে। পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে আ ন ম মনির আহমদ চৌধুরী নাম ধারণ করে। মাদ্রাসা পড়ুয়া এই রাজাকার জিয়ার শাসনামলে নানা সুযোগ সুবিধা নিয়ে এমনকি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কীভাবে শিক্ষকতার পেশায় ঢুকলেন তা নিয়ে নিজ এলাকায় নানা গুঞ্জণ রয়েছে।

তবে যাকে নিয়ে এত বিতর্ক সেই আ ন ম মনির আহমদ এর মৃত্যুতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গভীরভাবে শোক জানিয়ে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছেন। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন চিহ্নিত আলবদর কমান্ডার হিসেবে কুখ্যাত আ ন ম মনির আহমদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের শোক প্রকাশের ব্যাপারে চবি উপাচার্য প্রফেসর ড: ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী এ প্রতিবেদকে অত্যন্ত নির্লিপ্তভাবে বললেন, তিনিতো বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সহকর্মী, তাই শোক প্রকাশ করেছি সবাই। কিন্তু একজন শিক্ষক যখন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দেশের বিরুদ্ধে হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করেছেন, আলবদর কমান্ডার ছিরেন সেই শিক্ষকের জন্য শোক প্রকাশ কতটুকু সঠিক বলে মনে করেন ? এ প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন বলেন, আজকাল চারিদিকেইতো মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারিরা রয়েছেন, সেসব নিয়েতো কোন চিন্তা নেই কারো। আ ন ম মনির আহমদ অমাদের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন, সিন্ডিকেট, সিনেট সদস্য ছিলেন, সহকর্মী ছিলেন তাই আমরা শোক প্রকাশ করেছি নিয়মানুযায়ী। এতে দোষের তো কিছু দেখিনা।

তবে চট্টগ্রাম বিম্ববিদ্যালযের কয়েকজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, তারা যদি আগে এ বিষয়টি জানতেন তাহলে হয়তো বিবৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে আরো সতর্ক হওয়া যেতো। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধীতাকারি আলবদও কমান্ডারদের ব্যাপারেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আরো সচেতনতা ও সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তিত্ব প্রথিতযশা এ শিক্ষাবিদ ও রাজনীতি বিজ্ঞানীর অকাল ও আকস্মিক মৃত্যুতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার, চ.বি. শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর ড. এ এফ এম আওরঙ্গজেব ও সাধারণ সম্পাদক জনাব সুকান্ত ভট্টাচার্য, রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কামরুল হুদা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম শহরস্থ জমিয়তুল ফালাহ জামে মসজিদ প্রাঙ্গনে ও পরে আনোয়ারা উপজেলার বারখাইন গ্রামে দুপুর ২ টায় দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে বলেও জানানো হয় ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।

(ওএস/এএস/আগস্ট ২২, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

৩০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test