E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সুন্দরবন রক্ষায় জরুরি অবস্থা জারি ও সেনা মোতায়েনের প্রয়োজনীয়তা

২০১৫ সেপ্টেম্বর ৩০ ১৫:৫৩:৫১
সুন্দরবন রক্ষায় জরুরি অবস্থা জারি ও সেনা মোতায়েনের প্রয়োজনীয়তা

আশীষ কুমার দে: বাংলাদেশের অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ সুন্দরবনকে বাঁচাতে মংলা-ঘষিয়াখালী নৌপথের গুরুত্ব নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয় থেকে বিশ্বঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত বিশ্বের একক বৃহত্তম এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্টকে রক্ষায় এর ভেতর দিয়ে সব ধরনের বাণিজ্যিক নৌযান চলাচল বন্ধের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দর মংলাকে অধিক গতিশীল ও কর্মচঞ্চল করতে স্বল্প দূরতের নৌপথ ‘মংলা-ঘষিয়াখালী’ শতভাগ সচলকরণের কোনো বিকল্প নেই। এ কারণে ২০১১ সালে নৌপথটি বন্ধের পর সৃষ্টি হয় জাতীয় সংকট। জ্বালানি তেল সরবরাহে মারাত্মক সংকটের মুখোমুখি হয় বিপিসি। একই সংকট সৃষ্টি হয় মংলা বন্দরের পণ্য পরিবহন ব্যবস্থায়ও। এছাড়া ভারত থেকে পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রেও সংকট ঘনীভুত হয়।

এ অবস্থায় বিপিসির অনুরোধে এবং পণ্যবাহী জাহাজ মালিকদের দাবির মুখে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিআইডব্লিউটিএ ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল তেলবাহী জাহাজসহ সব ধরনের বাণিজ্যিক নৌযান চলাচলের জন্য সুন্দরবনের শ্যালা নদীর ওপর দিয়ে বগী-রায়েন্দা-শরণখোলা-জয়মনিরগোল নৌপথটি উন্মুক্ত করে দেয়।

তবে নৌপথটি বন্ধের পর থেকেই সুন্দরবন রক্ষার তাগিদের পাশাপাশি পণ্য পরিবহন ব্যয় সংকোচনের লক্ষ্যে দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ, পরিবেশবাদী ও প্রকৃতিপ্রেমীসহ সচেতন নাগরিকেরা বিকল্প নৌপথটি পুনরায় চালুর দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কারণ, শ্যালা নদী দিয়ে সব ধরনের ভারি নৌযান চলাচলের কারণে প্রতিনিয়ত মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয়-হুমকি মোকাবিলা করতে হচ্ছে সুন্দরবনকে। সব মহলের দাবির মুখে এবং বাস্তবতা উপলব্ধি করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২০১৪ সালের ১ জুলাই শুরু হয় এর খনন কাজ। এরপর গত বছরের ৯ ডিসেম্বর অয়েলট্যাংকারডুবির পর সৃষ্ট ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে দেশের গন্ডি ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও এই নৌপথের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পের তালিকাভুক্ত হওয়ায় এর খনন কাজ বেশ জোরেশোরেই চলতে থাকে এবং দ্রুত নৌপথটি চালু হবে ভেবে সব মহল আশান্বিত হয়। কিন্তু ১৫ মাসেও সে আশা পূরণ হয়নি। বরং প্রকল্পের শতভাগ সাফল্য মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে।

কারণ, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এক কোটি ঘনমিটার মাটি খনন ও পলি অপসারণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ২৩০ কোটি টাকার চলমান এ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতিনিয়ত বাধার সম্মুখিন হতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে।

প্রধান বাধা পাউবো ও চিংড়িঘের, মংলা-ঘষিয়াখালী নৌপথ খনন প্রকল্প শতভাগ বাস্তবায়ন ও সাফল্যের পথে প্রধান বাধা- পরিবেশবিনাশী অবৈধ চিংড়ি চাষ এবং অপরিকল্পিত ফয়লাহাট স্লুইসগেটসহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বিতর্কিত কর্মকান্ড। পাউবোর অপরিকল্পিত বাঁধ, স্লুইসগেট, খাল খননে অনীহা এবং স্থানীয় এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী জনপ্রতিনিধিসহ রাজনৈতিক লেবাসধারী প্রভাবশালীদের চিংড়িঘের। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এই নৌপথের দু’ধারের ২৩৩টি খালের মধ্যে ৩২টি সরাসরি সংযুক্ত এবং বাকি ২০১টি শাখা খাল। অপরিকল্পিত বাঁধ ও স্লুইসগেট অপসারণ এবং সরাসরি সংযুক্ত খালগুলো খননের দায়িত্ব পাউবোর। এর মধ্যে রামপাল উপজেলার ফয়লাহাটের স্লুইসগেটটি মংলা-ঘষিয়াখালী নৌপথের নাব্যতা রক্ষায় মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। কিন্তু পাউবো ওই স্লুইসগেট ও অপরিকল্পিত বাঁধগুলো অপসারণ এবং বগুড়া খাল, দাউদখালী নদী ও বিষ্ণু নদীসহ ৩২টি খাল খননে এ পর্যন্ত কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

গত ১ জুন মাননীয় নৌ পরিবহনমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ও মাননীয় পানি সম্পদমন্ত্রীর উপস্থিতিতে নৌ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ‘মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলে নাব্যতা বজায় রাখা ও চ্যানেল সচল রাখা সংক্রান্ত সভায় গৃহিত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তমূহ হচ্ছে- পাউবো’র ফয়লাহাটের স্লইসগেট জরুরি ভিত্তিতে অবমুক্তকরণ, চ্যানেল সংলগ্ন বগুড়া খাল, দাউদখালী নদী, বিষ্ণু নদীসহ মৃত নদীগুলো এবং চ্যানেলের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত প্রায় ৩২টি খাল খনন, চ্যানেল সংলগ্ন চিংড়িঘেরগুলোর মুখ খুলে দেয়া এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক উপরে বর্ণিত খাল ও নদীগুলো খনন। কিন্তু দীর্ঘ চার মাসেও ফয়লাহাট স্লুইসগেট অপসারণসহ অন্য কোনো সিদ্ধান্তই কার্যকর করেনি পাউবো।

একইভাবে খালের বাঁধ অপসারণ ও চিংড়িঘের উচ্ছেদেও স্থানীয় প্রশাসন এবং স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের ইতিবাচক ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না।

অন্য দিকে, এই প্রকল্পের বিতর্কিত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সিইজিআইএস এর পরামর্শে ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি টাইডাল বেসিন (জোয়ারাধার) নির্মাণের তোড়জোড় করছে পাউবো।

দৃশ্যত: মনে হচ্ছে- পাউবো একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হয়েও সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছে না; বরং আরেকটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিআইডব্লিউটিএর জনগুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রবল বাধা সৃষ্টি করে জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ অবস্থান নিয়েছে।

স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা: শাখা খালগুলোর মুখে ও বিভিন্ন স্থানের অবৈধ বাঁধ অপসারণ, সেখানকার পরিবেশবিধ্বংসী চিংড়িঘের উচ্ছেদ, জাল-জালিয়াতি ও পেশিশক্তির মাধ্যমে সরকারি খাল-জমি জবরদখলকারীদের আইনের আওতায় আনা এবং শাখা খালগুলো খনন করার দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর। কিন্তু এই কাজগুলো করছেন না তারা।

এমন কথাও শোনা যায়, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় লালিত অবৈধ দখলদারদের ক্ষমতার দাপটের কাছে স্থানীয় প্রশাসন অসহায়। এ কারণে তাদেরকে উচ্ছেদের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর জনপ্রতিনিধিরাও জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে উদাসীন রয়েছেন। অনেক জনপ্রতিনিধি কিংবা তাঁদের স্বজনেরা এই অবৈধ দখল ও পরিবেশবিনাশী চিংড়িচাষের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত বলেও অভিযোগ রয়েছে।

প্রকল্পের সাফল্য নিয়ে খোদ বিআইডব্লিউটিএর সংশয়: প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ বিআইডব্লিউটিএ নিজেও স্বীকার করছে যে, প্রকল্পের ৮৮ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হলেও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অতিমাত্রায় পলি পড়ায় খনন করার পরও সেসব স্থানে তীব্র নাব্য সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। তাদের ভাষায়- ৮৮ লাখ ঘনমিটার মাটি খনন ও পলি অপসারণ হলেও ইতিমধ্যে ৩০-৪০ শতাংশ এলাকা ভরাট হয়ে গেছে।

তারা বলছে- চ্যানেলটির বিস্তৃতি উত্তর-দক্ষিণ না হয়ে পূর্ব-পশ্চিম হওয়ায় পলি ভরাটের হার অত্যন্ত বেশি। ড্রেজিং পরবর্তী দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ ভরাট হয়ে গেছে।

বিতর্কিত সিইজিআইএস এর পরামর্শে বিআইডব্লিউটিএ-ও বলছে- ড্রেজিং পরবর্তী দীর্ঘমেয়াদী সুফল পাওয়ার জন্য চ্যানেল সংলগ্ন বগুড়া খালের পাশে প্রায় দুই কিলোমিটার অস্বাভাবিক হারে পলি জমা রোধ করার লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে সেখানে টাইডাল বেসিন নির্মাণ করতে হবে।

প্রচলিত আইন প্রয়োগে প্রশাসন ব্যর্থ: মংলা-ঘষিয়াখালী নৌপথ খনন প্রকল্পের ওপর গত ১৫ মাসের পর্যবেক্ষণে এটা স্পষ্ট যে, প্রচলিত আইন ও বিধি বিধানের আওতায় স্বাভাবিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে কাঙ্খিত সুফল আনতে পারেনি সিভিল প্রশাসন। এ অবস্থায় সুন্দরবনকে বাঁচাতে এবং মংলা বন্দরকে অধিক গতিশীলকরণে সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। উদ্ভুত সংকট নিরসনে আমরা ৪ দফা জরুরি দাবি পেশ করছি-

১. অবিলম্বে রামপাল-মংলায় ‘স্টেট এমারজেন্সি’ (রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস্থা) ঘোষণা ও সেনা মোতায়েন।

২. সেনাবাহিনীর সহায়তায় প্রকল্প এলাকার পরিবেশবিনাশী চিংড়িঘের ও ফয়লাহাট স্লুইসগেট উচ্ছেদ এবং সব খালের বাঁধ অপসারণ।

৩. পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপরিকল্প প্রকল্পসমূহ স্থগিত ও প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকান্ড বন্ধ।

৪. প্রকল্প-সংলগ্ন সব নদী ও খাল দ্রুত খনন করে পানিপ্রবাহ সৃষ্টি এবং পাউবো ও স্থানীয় প্রশাসনের সব খনন প্রকল্পে সেনাবাহিনীকে সম্পৃক্তকরণ।

আশীষ কুমার দে
সাধারণ সম্পাদক: নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি (এনসিপিএসআরআর)

(একেডি/এলপিবি/সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৫)

পাঠকের মতামত:

০২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test