E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শেরপুরে পর্যটক কেন্দ্রগুলোতে ভরা মৌসুমেও নেই পর্যটক

২০১৫ ফেব্রুয়ারি ০৩ ১৭:৫৬:২৭
শেরপুরে পর্যটক কেন্দ্রগুলোতে ভরা মৌসুমেও নেই পর্যটক

শেরপুর প্রতিনিধি : শেরপুরে গারো পাহাড়ের পাদদেশে ঝিনাইগাতীর গজনী অবকাশ ও নালিতাবাড়ী সীমান্তে মধুঠিলা ইকোপার্ক সহ গড়ে ওঠা বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে চলতি মৌসুমে পর্যটকের হাহাকার চলছে। যে স্থানগুলো বছরের অধিকাংশ সময় বিশেষ করে শীতের মৌসুমে প্রতিদিনই দর্শনার্থীদের আগমনে মুখর থাকে, রমরমা হয়ে ওঠে ভ্রমণ পিয়াসীদের পদচারনায়। সে স্থানগুলোতে এখন তেমন কোন প্রাণচাঞ্চল্য নেই। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অবরোধ, হরতালের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী ও কর্তাব্যক্তিরা। একেতো সুষ্ঠু পরিবহন সমস্যা, দ্বিতীয়ত ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রমণ। যে কারণে পর্যটকরা ভ্রমণে আসার সাহস করছেন না। এতে করে স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা খাবার হোটেল ও বিনোদন কেন্দ্রগুলোর ইজারা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও প্রতিনিয়ত লোকসান গুনতে হচ্ছে।

শেরপুর জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ঝিনাইগাতী উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষা গজনী এলাকায় জেলা প্রশাসন প্রায় ৮০ একর জায়গা জুড়ে ১৯৯৩ সালে ‘গজনী অবকাশ কেন্দ্র’টি গড়ে তোলে। নালিতাবাড়ীর পোড়াগাঁও ইউনিয়নে বন বিভাগ ১৯৯৮ সালে প্রায় ১০০ একর জায়গা জুড়ে মধুটিলা ইকোপার্ক নির্মাণ করে। প্রতিবছর শীতকালে ভ্রমণ পিপাসু মানুষ এসব বিনোদন কেন্দ্রে ছুটে আসেন। এ দুটি বিনোদন কেন্দ্রে পাহাড়, পাহাড়ী টিলা ও টিলার খাঁজে প্রাকৃতিক নৈসর্গিক দৃশ্যাবলী উপভোগের মনোমুগ্ধকর আয়োজন রয়েছে। তাছাড়া উঁচু-নিচু, আঁকা-বাকা পাহাড়ী টিলা পথ, সাত তলা পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, কৃত্রিম লেক, লেকের ওপর পেডেল বোট, আদিবাসী নারী ও মৎস্য কুমারী ভাস্কর্য, বিভিন্ন বন্য প্রাণীর ভাস্কর্য, মিনি চিড়িয়া খানা, শিশু পার্ক, পাতালপুরির রোমাঞ্চকর গুহাপথ, কৃত্রিম জলপ্রপাত ও রেস্টহাউস। পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে উঠে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সবুজ বনানী, লাল পাহাড়ের সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়।

প্রকৃতির সাথে আধুনিকতার মিশেলে গজনী অবকাশ ও মধুঠিলা ইকোপার্ক বিনোদন পিয়াসীদের নিকট অন্যতম আকর্ষনীয় স্পট হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। তাছাড়া রাজধানী ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন এলাকার সাথে শেরপুরের সহজ ও ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে প্রতিবছর শত শত পর্যটক বাস-ট্রাক, মাইক্রেবাস, সিএনজি অটোরিক্সা, মোটর সাইকল সহ বিভিন্ন গাড়ীতে নিয়ে এসব বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে ভীড় জমান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এ সময় বার্ষিক শিক্ষা সফর, পিকনিক এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বনভোজন ও আনন্দ ভ্রমনে আসে। কিন্তু এবার শীতের ভরা মৌসুমে অবরোধ-হরতাল ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে গজনী অবকাশ ও মধুটিল ইকোপার্কে পর্যটক আগমনের হার একেবারেই কমে গেছে।

গজনী অবকাশ কেন্দ্রের কয়েকজন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী জানান, প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত পিকনিকের ভরা মৌসুম। এসময় স্থানীয়রা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিদিন শত শত ভ্রমণ পিপাসু মানুষ বেড়াতে আসেন এ স্পটে। বিনোদন কেন্দ্রটি দুই শতাধিক পরিবারের উপার্জনের একমাত্র পথ। টানা অবরোধ-হরতাল ও দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য এবার অবকাশ কেন্দ্রটি ফাঁকা হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যেই লোকসানের কারণে বিভিন্ন খাবার হোটেল সহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধের উপক্রম হয়েছে। এতে করে তারা ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন।

গত শনিবার গজনী অবকাশ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, মাত্র ৭ টি বাস বনভোজনের জন্য পর্যটক নিয়ে এসেছে। তন্মধ্যে জেলা কুড়া ব্যবসায়ী সমিতির ৫ টি এবং মডেল গার্লস স্কুলের ২ টি বাস দেখা যায়। এছাড়া কয়েকজন ব্যক্তিগত গাড়ীতে এসেছেন। জেলার বাইরে থেকে কোন ভ্রমনকারী আসেনি। অবকাশের প্রবেশপথের ইজারাদারের দায়িত্বপালনকারী সেলিম হোসেনের নিকট থেকে জানা যায়, শুক্রবার এসেছিলো মাত্র ৮ টি পর্যটকবাহি গাড়ী। অথচ আগে শুক্র-শনিবার সবচেয়ে বেশী পর্যটক আসতো। অবকাশ কেন্দ্রে পর্যটক আর তাদের বহনকারী গাড়ীর কারণে তিল ধারনের ঠাঁই থাকতো না। এবার সে অবস্থা নেই।

গজনী অবকাশ কেেেন্দ্রর খেলানা সামগ্রী বিক্রেতা হাবিবুর রহমান বলেন, এ সময়ে অন্যান্য বছর এখানে প্রতিদিনি ৫০/৬০ টাক করে গাড়ী আসতো। ছুটির দিনে দেড়শ’/দুইশ’ গাড়ীও আসতো। আমাদের প্রতিদিন ৮/১০ হাজার ট্যাকা ইনকাম হতো। কিন্তু ইবার অবরোধ-হরতালে আমগরে খুব ক্ষতি অইতাছে। মানুষ-জনই নাই। তিনি বলেন, আমি কৃষি ব্যাংক থাইক্কা ঋণ নিয়া এখানে ব্যবসা করছি। অহনতো বেচাকিনিই নাই, ১০০/১৫০ টাকাও বেচা অয়না। ক্যাশ ভাইঙ্গা খাওয়া লাগতাছে। আমগরে খুব ক্ষতি অইতাছে। কাপড়ের দোকানী শামীম মিয়া বলেন, মনে করেন আমাদের এখানে ব্যবসা অইলো ৩ মাস। ইতোমধ্যে দুই মাস চইল্লা গেছে। অবরোধ-হরতাল দেশের পরিস্থিতি খারাপের কারণে মানুষ আসতে পারতাছে না। বেচাবিক্রীও নাই। আমরা এনজিও থাইক্কা ঋণ নিয়া এহানে দোকান করছি। যি অবস্থা ঋণের কিস্তি শোধ করাতো দুরের কথা, পেটের খাবার যোগাড় করাই দুঃসাধ্য। আর একমাস সিজন আছে। এর মধ্যে যুদি দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে, তাইলে কিছুটা ব্যবসা হতে পারে, নাইলে আমগর অবস্থা কাহিল।

গজনী অবকাশ কেন্দ্রের চুকোলুপি চিলড্রেনস পার্কের ব্যবস্থাপক সিরাজুল আলম খান নাসের জানান, আমাদের বন সুন্দরী রেস্ট হাউস, বন কন্যা কনফারেন্স সেন্টার কোনোটারই এবার কোন বুকিং হয়নি। শিশু পার্কেও দর্শনার্থী নাই। এবার খুব বাজে অবস্থা। হরতাল-অবরোধের কারণে কোন ট্যুরিস্ট নাই। আমাদের এখানে ৮ জন স্টাফ আছে। এবার তাদের বেতনও ওঠবেনা। তিনি বলেন, এ সময়টাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লেখাপড়ার চাপ কম থাকে। শিক্ষা সফর, পিকনিকের তোড়জোড় হয় বেশী। কিন্তু সিজনের এই পিক সময়টাতে অবরোধ-হরতাল, রাজনৈতিক অস্থিরতায় সব শেষ। জানিনা সামনে কি হবে। নারী শ্রমিক হাজেরা খাতুন বলেন, ১০ বছর যাবত শীতের মৌসুমে এখানে পিকনিক করতে আসা মানুষের রান্নার কাজে সহযোগিতা ও পানি বিক্রী করে কিছু অর্থ আয় করি। যা দিয়ে ৪ জনের সংসার ভালোভাবেই চলে যেতো। এ বছর লোকজন না থাকায় কোনো আয় রোজগার নেই। খুব সমস্যার মধ্যে আছি।

শেরপুর কালেক্টরেটের নাজির মুরাদুল হক বলেন, গজনী অবকাশ কেন্দ্রের রেস্ট হাউস এবং যানবাহন প্রবেশ ফি বাবদ প্রতি বছর প্রায় ৬০/৬৫ লাখ টাকা আয় হতো। যা দিয়ে অবকাশ কেন্দ্রের উন্নয়ন সাধন, সংস্কার কাজ, চিড়িয়াখানার পশু-প্রাণীদের খাবার এবং স্টাফদের বেতন দেওয়া হয়ে থাকে। অবকাশ কেন্দ্রটি তত্বাবধানের জন্য নিরাপত্তাকর্মী সহ ৬ জন স্টাফ রয়েছে। যাদের পেছনে বছরে প্রায় আট লাখ টাকা ব্যয় হয়। এবার যে অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে ৫/৬ লাখ টাকার বেশী আয় হবেনা। এতে করে এবার স্টাফদের বেতনই ওঠবে না।

(এইচবি/এএস/ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০১৫)

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test