E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ইকোনমিস্টের চোখে যেভাবে বদলে যাচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতির গতিধারা

২০২০ জুন ১২ ১৭:০৬:১০
ইকোনমিস্টের চোখে যেভাবে বদলে যাচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতির গতিধারা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই বিশ্ব অর্থব্যবস্থার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে আসা বিপর্যয়ে বদলে যেতে পারে এ ব্যবস্থা; অর্থনীতির ইতিহাসে শুরু হতে পারে এক নতুন অধ্যায়ের। করোনা মহামারি দেখিয়ে দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের দেশের ভেতরের সমস্যাই ঠিকমতো সমাধান করতে পারছে না। ফলে প্রশ্ন উঠেছে তাদের বৈশ্বিক নেতৃত্ব নিয়ে। আর যুক্তরাষ্ট্রের এমন দুর্বলতম অবস্থার সুযোগ নিতে যাচ্ছে চীন। বেইজিং হয়তো রাতারাতি ওয়াল স্ট্রিটের সমকক্ষ হতে পারবে না। তবে এশিয়ার এ পরাশক্তি বিশ্বকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে তারা কী করতে সক্ষম। চীনের এ দাপট চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বদলে যেতে পারে বিশ্বের অর্থনৈতিক গতিধারা।

পরিবর্তনের শুরু

দীর্ঘদিন ধরেই বৈশ্বিক অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ তারা। বৈশ্বিক অর্থনীতির চারভাগের একভাগই তাদের দখলে। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের হিসাব হয় মার্কিন ডলারে। বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার ৮০ শতাংশেই ডলার ব্যবহৃত হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতার বিশাল এক অংশ ধরা রয়েছে ওয়াশিংটনের হাতে। অর্থের প্রবাহ যাদের নিয়ন্ত্রণে, দিন শেষে তারাই রাজা হবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে করোনা মহামারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার সিংহাসনে ভাগ বসাতে চলছে চীন।

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ভারসাম্য আনা, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরির দাবি দীর্ঘদিনের। ধীরে ধীরে সেই জায়গাটাই দখল করতে যাচ্ছে চীন। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি তাদের। ১০ বছর ধরেই চীনের ব্যাংক খাত এগিয়ে চলেছে স্থিরভাবে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোর অবস্থা স্থিতিশীল, ইউরোপের ব্যাংকগুলোর সম্পদ কমছে, সেখানে বিপরীত গতিতে চীনা ব্যাংকগুলো। তাদের সম্পদ এখন ইউরোপ-আমেরিকার ব্যাংকগুলোর চেয়েও বেশি। তবে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এখনও অনেকটাই চীনকেন্দ্রিক। আন্তর্জাতিক লেনদেনের মাত্র ৭ শতাংশ রয়েছে চীনা ব্যাংকের হাতে। ফলে বিপুল সম্পদ সত্ত্বেও বিশ্ব অর্থনীতির গতিধারায় তাদের ততটা প্রভাব নেই।

তবে এ দৃশ্য পাল্টাতে শুরু করেছে। চীনের ব্যাংকগুলো বাইরের দেশেও কার্যক্রম বাড়াতে শুরু করেছে। বিশ্ববাজারে নিজেদের মুদ্রার গুরুত্বও বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে চীন। বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ইউয়ানে লেনদেনে উদ্বুদ্ধ করছে তারা। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম মাইনিং কোম্পানি রিও টিন্টো গত বছর প্রথমবারের মতো তাদের চুক্তি ইস্যু করেছে ইউয়ানে।

করোনা মহামারির কারণে চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব আরও বাড়ছে। বিশ্বের সঙ্গে মহামারি নিয়ন্ত্রণে নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছে, বিভিন্ন দেশে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য উপকরণ পাঠাচ্ছে তারা। ইতালিকে ৩০ টন স্বাস্থ্য সরঞ্জাম, স্পেনকে পাঁচ লাখ সার্জিক্যাল মাস্ক পাঠিয়েছে চীন। উহানে সংক্রমণ শুরুর পর থেকেই করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে অন্যতম নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে চীন। বেশকিছু দেশকে ঋণের কিস্তি পরিশোধে বাড়তি সময় দিয়েছে তারা। করোনার ভ্যাকসিন তৈরির গবেষণায়ও বহুদূর এগিয়েছে দেশটি।

মহামারি নিয়ন্ত্রণে চীনের দারুণ সক্ষমতা এবং তাদের অর্থনীতির আকার বৃদ্ধির গতি দেশটিকে নিরাপদক্ষেত্র হিসেবে বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করছে। মহামারির কারণে বিশ্বের অন্যান্য শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে, বন্ডের দরপতন হয়েছে ব্যাপকহারে, সেখানে অনেকটাই স্থিতিশীল চীনের বাজার।

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্ড বাজার চীনের। করোনা প্রমাণ করে দিয়েছে, বড় ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা রয়েছে এর, যা উদীয়মান বাজারগুলোতে সম্ভব নয়। ফলে বিনিয়োগকারীরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, চীনা অর্থনীতির এত সহজে পতন হচ্ছে না।

শুধু বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণই নয়, চীন বদলে দিতে শুরু করেছে বৈশ্বিক লেনদেন ব্যবস্থাও। বর্তমান ব্যবস্থায় একচ্ছত্র আধিপত্য যুক্তরাষ্ট্রের। এর পেছনে বড় অবদান সুইফটের। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থ ট্রান্সফারিং নেটওয়ার্ক হিসেবে এটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। তবে যেহেতু সুইফটের বেশিরভাগ লেনদেনই হয় ডলারে, তাই সেগুলো নিউইয়র্কের ব্যাংক ঘুরে তারপর যায় মূল গন্তেব্যে। বিশ্ব অর্থনীতিতে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে এ পদ্ধতির ফায়দা নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ক্রিমিয়া আক্রমণের পর থেকেই সুইফট সিস্টেম থেকে বাদ পড়ার শঙ্কায় রয়েছে রাশিয়া। ২০১৮ সালে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে বাদ পড়েছে ইরানি ব্যাংকগুলো।

বেলজিয়ামভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুইফট নিরপেক্ষ কাজ করার কথা থাকলেও তাতে বাধ সেধেছে যুক্তরাষ্ট্র। কথামতো না চললে সুইফটের ওপরই নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়ে রেখেছে ওয়াশিংটন। এটি মিত্র দেশগুলোর জন্য আপত্তিকর হলেও তাতে থোড়াই কেয়ার যুক্তরাষ্ট্রের।

চীন সুইফটের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ জানাতে না পারলেও বিকল্প লেনদেন পদ্ধতি বের করে নিয়েছে তারা। বেশিরভাগ গ্রাহকই লেনদেনের ক্ষেত্রে মার্কিন জায়ান্ট ভিসা ও মাস্টারকার্ডের ওপর নির্ভরশীল। তবে চীনা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো বেশ কয়েকটি অ্যাপ তৈরি করেছে; যা গোটা লেনদেন ব্যবস্থাকেই বদলে দেবে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের বদলে গ্রাহকরা ‘ডিজিটাল ওয়ালেট’-এ লেনদেন করতে পারবেন। পার্কিংয়ের জরিমানা থেকে শুরু করে ট্যাক্সির বিল পর্যন্ত যেকোনও কিছুই পরিশোধ করা সম্ভব এর মাধ্যমে। ফলে ব্যাংকিংয়ের বদলে এক বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল ওয়ালেটের মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের বৈশ্বিক গতিবিধি বদলে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে কিছু কোম্পানির হাতে এত বেশি ক্ষমতা চলে যাচ্ছে যে চীন সরকারও তাদের ভয় করছে। গত বছর চীনা ভোক্তারা মোবাইলের মাধ্যমে ৪৯ ট্রিলিয়ন ডলার বিল পরিশোধ করেছে। আর প্রধান দু’টি চীনা কোম্পানি- টেনসেন্ট ও অ্যান্ট ফিন্যান্সিয়াল তাদের এ সুবিধা পৌঁছে দিয়েছে। দু’টি কোম্পানিরই গ্রাহক সংখ্যা শত কোটির বেশি। করোনা মহামারিতে তাদের চাহিদা আরও বেড়েছে। মানুষজন এখন ভিড় এড়িয়ে চলছে। তারা আরও বেশি বেশি অনলঅইনে কেনাকাটা সারছেন। আর এটি সম্ভব হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক পেমেন্টে সিস্টেমের কারণেই।

টেনসেন্ট ও অ্যান্ট ফিন্যান্সিয়াল ইতোমধ্যে চীনের বাইরে বাণিজ্যিক কার্যক্রম বাড়াতে শুরু করেছে। অ্যান্টের অ্যাপ ‘আলিপে’ অন্তত ৫৬টি দেশ ও অঞ্চল সাদরে গ্রহণ করেছে। অন্যান্য ডিজিটাল ওয়ালেট কোম্পানিগুলোও তাদের প্রযুক্তির সাহায্য নিচ্ছে। ইতোমধ্যে ছয়টি ইউরোপীয় মোবাইল ওয়ালেট কোম্পানি আলিপে’র কিউআর ফ্যরম্যাট ব্যবহার করছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন প্রভাববৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট চিন্তার কারণ রয়েছে। তারা দিনে দিনে আরও বড় হচ্ছে। এছাড়া চীন এমন এক আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তুলছে; যা মার্কিন কোম্পানি, মুদ্রা বা ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল নয়। দিনশেষে দেখা যাচ্ছে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ধীরে ধীরে দু’টি পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছে; যুক্তরাষ্ট্র-শাসিত ও চীন-শাসিত। এ দুই ব্যবস্থাকে সবসময় একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে হবে এমনটা নয়। বরং তারা একে অপরের পরিপূরকও হতে পারে। আর এমনটি হলে তো ভালো, নাহলে বিশ্বে অর্থনৈতিক লেনদেন আরও কঠিন হয়ে উঠবে।

(ওএস/এসপি/জুন ১২, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

২০ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test