সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : পাঁচ লাখ টাকা দিতে অপরাগতা প্রকাশ করায় বাবু লাল মণ্ডল নামের এক যুবককে দু’ চোখ বেঁধে অমানুষিক নির্যাতন করেছে গোয়ন্দা পুলিশ। পরে স্বজনদের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে তাকে শনিবার দুপুর দু’ টোর দিকে মুক্তি দেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি আশঙ্কাজনক অবস্থায় শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি রয়েছেন।

নির্যাতিত বাবুলাল মণ্ডল(২৮) সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ভুরুলিয়া ইউনিয়নের সোনামুগারী গ্রামের অসিত কুমার মণ্ডলের ছেলে।

শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন বাবুলাল মণ্ডল জানান, ২০০৮ সালে তিনি কাজের জন্য বাহারাইনে যান। দেড় বছর আগে তিনি বাড়িতে এলে একই গ্রামের ছফেদ আলী গাজীর ছেলে আবু ছালাম ও জুলমত গাজীর ছেলে রবিউল ইসলাম তার বাড়িতে আসে। তাদেরকে বাহারাইনে যাওয়ার ব্যাপারে ভিসা দিতে পারবেন কিনা তার কাছে জানতে চান। তিনি অপারগতা প্রকাশ করে বাহারাইনে কর্মরত একই গ্রামের আবু মুছার সঙ্গে কথা বলার জন্য পরামর্শ দেন। আবু মুছা তাদেরকে ভিসা দেওয়ার শর্তে চার লাখ টাকা নেন। টাকা লেনদেনের সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন। শর্ত অনুযায়ি ভিসা পেয়ে আবু ছালাম ও রবিউল ইসলাম ২০১৬ সালের আগষ্ট মাসে বাহারাইনে যান। তবে অধিক গরম ও অধিক ঠাণ্ডা সহ্য করতে না পেরে কয়েক মাস কাজ করার পর তার দেশে ফিরে আসে। দেশে ফিরে তারা পুলিশের দালাল উপজেলার বাধঘাটা গ্রামের আব্দুল মাজেদের ছেলে এরশাদ শিকদার হিসেবে পরিচিত রেজাউল ইসলামের পরামর্শে চলতি বছরের আগষ্ট মাসে কোন কারণ ছাড়াই আবু মুছার কাছে টাকা ফেরৎ চান। আবু মুছা টাকা ফেরৎ দিতে রাজী না হওয়ায় স্বাক্ষী হিসেবে তার (বাবুলাল) কাছে টাকা দাবি করে আবু সালাম ও রবিউল।

বাবুলাল আরো জানান, তিনি জাল ভিসা দিয়েছেন আবু সালাম ও রবিউলের অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২৬ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে শ্যামনগর থানার উপপরিদর্শক আশরাফুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশ, থানার দালাল রেজাউলসহ কয়েকজন তাদের বাড়িতে আসে। এ সময় দরজা খুলতে দেরী হওয়ায় দালাল রেজাউলসহ কয়েকজন তাদের বারান্দায় থাকা লোহার এ শাবল দিয়ে দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকে। মা গীতা রানী মণ্ডল ও স্ত্রী মৌসুমীকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে তাকে টেনে হিঁচড়ে ঘরের বাইরে এনে বেতের লাাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটায় রেজাউল ও পুলিশ। পরে তাকে চোখ বেঁধে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। উপপরিদর্শক আশরাফুল তার কাছে আবু সালাম ও রবিউলের জাল ভিসা দেওয়ার অভিযোগে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেন। পরদিন সকালে ৩৫ হাজার টাকা দিয়ে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান রেজাউল ইসলামের জিম্মায় দেওয়া হয়। তার উপর নির্যাতন ও টাকা নেওয়ার ঘটনায় মামলা করতে চাইলে এ নিয়ে আর কোন সমস্যা হবে না বলে অনুরোধ করায় তারা আর বেশিদূর এগোতে চাননি।

বাবুলাল আরো অভিযোগ করে বলেন, গত শুক্রবার দিবাগত রাত দু’ টোর দিকে পুলিশের দালাল রেজাউলসহ সাতক্ষীরা গোয়েন্দা পুলিশের(ডিবি) একটি দল তাদের বাড়িতে ঢোকার কাঠের দরজা ভেঙে ফেলে। মা গীতা রাণী ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করায় পুলিশ ও দালাল চক্রটি ভিন্ন পথে ছাদের উপর উঠে সিঁড়ির টিনের দরজা ভেঙে তাদের ঘরের বারান্দায় আসে।

এ সময় পুলিশ পরিচয় পেয়ে মা দরজা খুলে দেয়। ঘরে ঢুকেই গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা তার মায়ের মুখের মধ্যে পিস্তলের নল ঢুকিয়ে দিয়ে অকথ্যভাষায় গালিগালাজ করে মোবাইল ফোনটি কেড়ে নেন। তাকে টানতে টানতে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার পর উঠানে এনে পুলিশ ও দালাল রেজাউল তার কাছে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে। দিতে রাজী না হওয়ায় তাকে বেতের লাঠি দিয়ে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে জখম করে চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে তোলা হয়। মাইক্রোবাসের মধ্যে কথাবার্তার একপর্যায়ে তিনি জানতে পারেন যে গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক নবাগত কামাল হোসেনের নির্দেশে উপপরিদর্শক রোকনউজ্জামান শুক্রবার দিবাগত গভীর রাতে তাদের বাড়িতে অভিযান চালায়।

মারপিটে বাধা দেওয়ার তার অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া ভাগ্নীকেও মারপিট করা হয়। এরপর রাতভর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানোর পর শনিবার ভোর পাঁচটার দিকে তাকে সাতক্ষীরাা গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। শনিবার সকালে তাকে গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক রোকনউজ্জামান দীর্ঘ ১০ বছর বিদেশে থাকার কারণে প্রথমে ১০ লাখ টাকা চান। পরে পাঁচ লাখ টাকার কথা বলা হয়। কোন টাকা দিতে পারবেন না বলায় উপপরিদর্শক রোকনুজ্জামানের নির্দেশে তাকে দ্বিতীয় দফায় নির্মমভাবে পিটিয়ে জখম করা হয়।

এ সময় মায়ের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন থেকে বাড়িতে রাখা তাদের একটি মোবাইল ফোনে টাকা আনার জন্য বলা হয়। নইলে চিরজীবনের জন্য তাকে পঙ্গু করে দেওয়ার কথা বলা হয়। শনিবার দুপুর দু’ টোর দিকে তার ভগ্নিপতি বিভুতি রপ্তান,শ্বশুর সুশান্ত মণ্ডল ও নূরনগর এলাকার এক জেলা পরিষদ সদস্যকে ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে অলিখিত কাগজে তাদের চারজনকে সাক্ষী হিসেবে নাম সাক্ষর করিয়ে নিয়ে ছেড়ে দেন উপপরিদর্শক রোকনউজ্জামান। সন্ধার আগে তারা বাড়িতে ফিরে স্থানীয় এক চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ঔষধ খাচ্ছিলেন। অবস্থার অবনতি হওয়ায় রোববার রাত সাতটার দিকে তাকে তার স্বজনরা শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে।

সরেজমিনে সোমবার দুপুরে শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দোতলায় পুরুষ ওয়ার্ডের বারান্দায় গেলে, গীতা রাণী মণ্ডল, অসিত কুমার মণ্ডল, তাদের মেয়ে চন্দনা রপ্তান, আত্মীয় তপন মণ্ডল, নমিতা মণ্ডল, বিজলী পাল,ভানুকা মণ্ডলসহ কয়েকজন এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা ভরার একপর্যায়ে বাবুলালের পাছা, হাঁটু, দু’ হাতের কনুই,তলপেটসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে কাপড় সরিয়ে পুলিশের বিভৎস্য নির্যাতনের চিহ্ন দেখান। পুলিশের দালালরা তাদেরকে হাসপাতালে এসে হুমকি দিচ্ছে বলেও জানান তারা।

এ ব্যাপারে সোনামুগারী গ্রামের আবু সালামের কাছে সোমবার সন্ধ্যায় তার কাছে জানতে চাইলে তিনি গোয়েন্দা পুলিশের কাছে দায়েরকৃত বাবুলাল মণ্ডলের বিরদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পর্কে কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি।

শৈলখালি গ্রামের বিভুতি রপ্তান জানান, বিশেষ পিপি অ্যাড. জহুরুল হায়দারের মাধ্যে সোমবার গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে যেয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। শ্যালক বাবুলালকে মারপিটের জন্য ক্ষমা চেয়ে ঘুষের জন্য নেওয়া ৩০ হাজার টাকা ফেরৎ দিয়েছেন উপপরিদর্শক রোকন।

শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডাঃ আনিছুর রহমান জানান, বাবুলালকে এলোপাতাড়ি ভারী জিনিস দিয়ে মারপিটের ফলে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ রক্তজখম হয়েছে।

জানতে চাইলে শ্যামনগর থানার উপপরিদর্শক আশরাফুল আলম গত ২৬ সেপ্টেম্বর রাতে বাবুলাল মণ্ডলকে থানায় ডেকে আনার কথা নিশ্চিত করলেও তাকে মারপিট ও তার কাছ থেকে ৩৫ হাজার টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন। তবে আবু সালাম ও রবিউলের অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে থানায় এনে পরদিন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান রেজাউল ইমলামের জিম্মায় দেওয়া হয়। একই অভিযোগের ভিত্তিতে গত শুক্রবার গোয়েন্দা পুলিশ বাবুলালকে ধরে নিয়ে গেছে বলে তিনি নিশ্চিত করেন।

জানতে চাইলে সাতক্ষীরা গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক রোকনউজ্জামান রোববার রাত সাড়ে ৯টার দিকে এ প্রতিবেদককে জানান, বাবুলাল মণ্ডল নামের কোন ব্যক্তিতে শ্যামনগর থেকে তিনি আটক করেননি।

গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক কামাল হোসেন জানান, পুলিশ সুপারের কাছে দায়ের করা আবু সালাম ও রবিউলের অভিযোগ পেয়ে তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উপপরিদর্শক রোকনউজ্জামানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। যদি অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে থাকে তার দায় দায়িত্ব ওই পুলিশ কর্মকর্তার। তবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পিপি বাবু ভাই এর মাধ্যমে তাদের এ নিয়ে কথা হয়েছে বলে জানান।

(আরকে/এসপি/অক্টোবর ১৭, ২০১৭)