চাঁদপুর প্রতিনিধি : চাঁদপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নতুন কাজ, সংস্কার কাজের নামে কোটি কোটি টাকা হরিলুটের অভিযোগ ওঠেছে। এখানকার নির্বাহী প্রকৌশলী শুভ্রত দত্তের স্বেচ্ছাচারিতা, আত্মীয়করণ, অফিস অনিয়মিত  করা, সঠিকভাবে ফিল্ড ভিজিট না করার কারণেই এ লুটপাট হয়েছে বলে জানান বেশ কয়েকজন ঠিকাদার। মতলব সেতু, সাচার সেতু, মতলব সেতুর বাইপাস সড়ক নির্মাণে যথাযথ তদারকির অভাবে বহুবিধ অমার্জনীয় ত্রুটি ও ক্ষতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

দেখা যাচ্ছে নির্বাহী প্রকৌশলী শুভ্রত দত্ত মাসে সর্বোচ্চ ৭ থেকে ৮ দিন অফিস করেছেন। তার অনুপস্থিতির কারণে অধিনস্তদের অনেকেই ঠিকমতো অফিস করেন না। এসওগণও ঠিকমতো তাদের সাইড ভিজিট করেন না। অনেক কর্মকর্তা অফিসের কাজ বাদ দিয়ে নিজেরাই ঠিকাদারি শুরু করেছেন।

সড়ক বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে ফিল্ড ভিজিট ছাড়া নির্বাহী প্রকৌশলী সুভ্রত দত্তকে কখনোই চলমান বিভিন্ন কাজ পরিদর্শনে খুব একটা দেখা যায়নি। নির্বাহী প্রকৌশলীর কথিত বেকার নিকটাত্মীয় নারায়ণকে ২ বছরে ঠিকাদারিতে এনে কোটিপতি বানিয়েছেন। ক্ষুদ্র মেরামত এবং সাপ্লাই মালের অধিকাংশই হরিলুট হয়েছে। ওই আত্মীয়কে কাজ দেয়া নিয়ে স্থানীয় ঠিকাদারদের সাথে দ্বন্দ্ব থামাতে একাধিক ঠিকাদারের সাথে যৌথভাবে কাজ দিয়ে সরকারের লাখ লাখ টাকা লুটপাটের সুযোগ দেয়া হয়েছে বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কজন ঠিকাদার জানান।

ব্যাপক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নির্বাহী প্রকৌশলী এত বেশি অফিস ফাঁকি দিয়েছেন যে, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সভাতেও তাঁর অনুপস্থিতি ছিল দৃশ্যমান। অফিসে খোঁজ করলে প্রায়দিনই অন্যরা বলতেন, স্যার ঢাকা, কুমিল্লায় মিটিংয়ে কিংবা বাসায় বসে অফিসের কাজে ব্যস্ত আছেন। অবশ্য শুভ্রত দত্তকে নিয়মিত অফিসে গরহাজিরের বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলতেন, মানুষের যন্ত্রণায় তিনি অফিসে কাজ করতে পারেননি; তাই বাসায় বসে কাজ করতেন ।

এছাড়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কাজের মধ্যে জেলা সড়ক উন্নয়নে কুমিলøা জোনের আওতায় চাঁদপুর অংশে ১০ কোটি ১২ লাখ ১৫ হাজার টাকা বরাদ্দের সমুদয় টাকা ব্যয় করা হয়ে গেছে। মতলব-মেঘনা-ধনাগোদা বেড়িবাঁধ সড়কে ১৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকার কাজ সমাপ্ত করা হয়েছে। বাবুরহাট-মতলব পেন্নাই সড়কের দ্বিতীয় পর্যায়ে চাঁদপুর অংশে ১৭ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ব্যয়ে কাজ সমাপ্ত দেখানো হয়েছে। অথচ এসকল রাস্তার বর্তমান অবস্থাও খুব একটা ভাল না। কাজ শেষ হতে না হতেই এ সকল রাস্তার বিভিন্ন অংশে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। শাহরান্তি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান মিন্টু বলেন, দোয়াভাঙ্গা গেট হতে কালিবাড়ি পর্যন্ত পর পর দুইবার সড়কের সংস্কার কাজ করা হয় কিন্তু সে কাজ এতো দায়সারা ও কাজের নামে লুটপাট করা হয়েছে যে, কাজের দুই মাসের মাথায় সড়কের বেহাল অবস্থায় যান চলাচল অনেকটা অনুপযোগী হয়ে গেছে। নতুন করে এই সড়কে ৮৪০ মিটারে কাজের জন্য ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। সওজ বিভাগের যোগসাজসে আবারো এই কাজে লুটপাট হবার আশঙ্কা করেন তিনি।

বিগত দিনে সাপ্লাইয়ের মালামাল সড়ক ভবনের সামনের স্ট্যাকইয়ার্ডে ঠিকাদাররা এনে সওজ কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিতেন। সেখান থেকে ট্রাকে করে ইট, বালি, খোয়া, পাথর, বিটুমিন নিয়ে রাস্তার ক্ষুদ্র মেরামত কিংবা গর্ত ভরাট করা হতো অথচ বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী আসার পর ওই সিস্টেম উঠে যায়। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে লাখ লাখ টাকার মালামাল স্ট্যাকইয়ার্ডে আনতে দেখা যায়নি। গত অর্থবছর এবং চলতি অর্থবছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যেসকল ঠিকাদার ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সাপ্লাইয়ের মাল কেনা হয়েছে তাদের মধ্যে প্রগতি ট্রেডার্সের মাধ্যমে ৯/১১/১৬ তারিখে ২৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকার মাল ক্রয়, মেসার্স মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নামের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হাজীগঞ্জ সাবডিভিশনের জন্য ২১/৬/১৭ তারিখে ১৮ লাখ টাকার মাল ক্রয় করা হয়। এই ফার্মের নামে কাজটি করেন নির্বাহী প্রকৌশলীর আতœীয় নারায়ণ। ২/৩/১৭ তারিখে তানিয়া এন্ড কোং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মাল কেনা হয় ২৬ লাখ ৯৩ হাজার টাকার। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ওই মাল ক্রয় করেন নির্বাহী প্রকৌশলীর আত্মীয় নারায়ণ।

একই ফার্মের নামে জুলাই ২০১৭ মাসে আরো ২৬ লাখ টাকায় মাল ক্রয়ের কাজও নেয় নারায়ণ। আগস্ট ২০১৭ মাসে মেসার্স কনটেমপোরারি নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৯ লাখ টাকার ইট সাপ্লাইর কাজ নেন জনৈক রেজা মাহমুদ। সেপ্টেম্বর ২০১৭ মাসে বলাখালের জনৈক শিশিরের মাধ্যমে পাথর ক্রয়ের জন্য ১৭ লাখ টাকার ওয়ার্ক অর্ডার দেয়া হয়। অথচ সড়ক ভবনের সামনের স্ট্যাকইয়ার্ডে ১টি ইট কিংবা ১ টুকরো পাথরও আসেনি।

এ ব্যাপারে নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, টাকাপয়সা ছাড়া ঠিকাদার ডেকে এনে বুঝিয়ে সুজিয়ে তাদের দিয়ে তাৎক্ষণিক মাল কিনে রাস্তায় ফেলেছি। স্ট্যাকইয়ার্ডে আনার সময় কই। তিনি আরো বলেন, আমাদের এসওরা তাদের স্বস্ব সাইডে কখন কী পরিমাণ মাল গেছে ওইভাবে হিসেব রেখেছেন এবং সেইমতে বিল দেয়া হয়েছে।

মেরামত সংস্কারের কাজের দুর্নীতির চিত্র খুবই ভয়াবহ। এ খাতে প্রায় ৪ কোটির অধিক টাকা ব্যয় করে যে সকল রাস্তা সংস্কার করা হয়েছে তার কিছুই এখন দৃশ্যমান নেই। প্রায় সকল রাস্তা ঘুরে এর সিংহ ভাগের নমুনা খুঁজে পাওয়া যায়নি। মেরামত সংস্কারের ক্ষেত্রে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত প্যাড কোটেশন, ১ লাখ পর্যন্ত ডিপিএম এবং এর উর্ধ্বে ই-টেন্ডারিং এর মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। নির্বাহী প্রকৌশলীর নিজস্ব ক্ষমতা বলে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত প্যাড কোটেশনের প্রায় সকল কাজ তাঁর আত্মীয় নারায়ণ এবং তাঁর কার্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভাগাভাগি করে নিয়েছে। ১ লাখ পর্যন্ত ডিপিএমের কাজগুলো পাস করেছেন কুমিল্লা জোনের এসি। ওই সকল কাজের বেশ কয়েকটি কাগজে কলমে দৃশ্যমান হলেও বাস্তবে দেখা যায় না। এ সকল ছোট কাজগুলো বেশির ভাগই হরিলুট হয়েছে। বড় কাজগুলো তদারকির অভাবে আদায় করে নেয়া সম্ভব হয়নি বলে অভিজ্ঞ অনেক ঠিকাদার মন্তব্য করেছেন।

অনুসন্ধানকালে জানা গেছে, ঠিকাদারের কটি ফার্মের নামে যে বিলগুলো নেয়া হয়েছে ওই সকল কাজের ১টিও ফার্মের মালিক করেন নি। তাদের লাইসেন্স ব্যবহার করে সরকারের রাজস্ব খাত থেকে লাখ লাখ টাকা চলে গেলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কোনো কোনো রাস্তায় একটি ইটও না ফেলে বিল নিয়েছে বহু ঠিকাদার। নির্বাহী প্রকৌশলী তাঁর আতœীয়কে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে বহু ঠিকাদারকে ভুয়া বিল দিতে বাধ্য হয়েছেন বলে একাধিক বঞ্চিত ঠিকাদার পত্রিকায় না লিখার শর্তে জানিয়েছেন। নিকটাত্মীয়কে কাজ দেয়া নিয়ে অন্যান্য ঠিকাদারদের দ্ব›দ্ব এড়াতে নির্বাহী প্রকৌশলী বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতাধর কিছু নেতার সাথে যৌথভাবে কাজ দিচ্ছে। কিছু কিছু রাস্তা সংস্কার মেরামতের টেন্ডারের প্রক্রিয়া কাগজে কলমে সঠিক থাকলেও বাস্তবে একেবারেই এর কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় নি।

এ প্রসঙ্গে নির্বাহী প্রকৌশলী শুভ্রত দত্তের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথমে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন। পরবর্তীতে বলেন, আপনারা সবই জানেন। এমন কোনো প্রশ্ন করে আমাদেরকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবেন না। তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের সাথে কথা বলেছি, তারা কিছু টাকা দেবে। ওই টাকায় যতটুকু কাজ করা যায় তা করার চেষ্টা করব। চাঁদপুর সড়ক বিভাগে মেরামত সংস্কারের ঠিকাদারি কাজের নামে একটা বিশেষ শ্রেণীর লুটপাটের চিত্র দেখে তা রোধের ব্যবস্থা না করে এক পর্যায়ে অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এ কাজে নেমে পড়েন।

গত দু’মাসে সওজ এর দীর্ঘদিন কাজ করছে এমন বেশ কটি ঠিকাদারি ফার্মের নামে পিএম এবং আরএম কোটেশন দেখিয়ে তারা নিজেরা কাজ ভাগাভাগি করে নেয়। এ কাজে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত নির্বাহী প্রকৌশলীর ক্ষমতাসীমায় একাধিক কাজ ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। উপ-সহকারি প্রকৌশলী, ওয়ার্ক অ্যাসিস্টেন্ট, সওজ শ্রমিক নেতা সবাই মিলেমিশে কাজ করেছে। তাদের কেউ কেউ ১/২ হাজার ইট এবং ইটের খোয়া ২/১শ ফুট বালি রাস্তায় ফেলে ৫০ হাজার টাকার বিল আদায়ের জন্য চেষ্টা করছেন। এধরনের কাজের সংখ্যা হবে প্রায় ৪০ টি।

সার্বিক বিষয়ে সওজ চাঁদপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী শুভ্রত দত্ত বক্তব্য বলেন, এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করলে আপনার কী লাভ হবে? নারায়ণ আমার চাচাতো শালা। সে আমি চাঁদপুর আসার আগেও ঠিকাদারি করেছে। অফিস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঠিকাদারি বিষয়ে কথা তুললেই তিনি তা এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেন। তার দাবি, মেরামত সংস্কারের কাজ যথাযথভাবে বুঝে নিয়ে ঠিকাদারদের বিল দেয়া হয়েছে। নানা ব্যস্ততার কারণে আমি সাইড ভিজিট কম করলেও আমার এসওরা যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন।

(ইউএইচ/এসপি/অক্টোবর ২০, ২০১৭)