রেজাউল ইসলাম ফরাজী, ঝালকাঠি : রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ জন্মেছিলেন ১৮৯৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ধানসিঁড়ি নদীর পাশের গ্রাম বামনকাঠির দাশ পরিবারে। বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃৎ এই কবির ৬৩তম মৃত্যুবার্ষিকী ২২ অক্টোবর। ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার বামনকাঠি গ্রাম। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ধানসিঁড়ি নদী। নদীতীরের গ্রামটিতে একটি পরিত্যক্ত ভিটায় রয়েছে কিছু গাছপালা।

স্থানীয়ভাবে এটি ‘দাশের ভিটা’ নামে পরিচিত। এটাই রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের পৈতৃক ভিটা। জীবনানন্দ দাশের শৈশব-কৈশোর এমনকি যৌবনের অনেক সময় পার হয়েছে বামনকাঠি গ্রামে। তাঁর পৈতৃক ভিটা দেখতে আসেন দেশ-বিদেশের পর্যটকরা। তবে এই বিরান ভিটা দেখে হতাশ হওয়া ছাড়া তাঁদের আর কোনো উপায় থাকে না। কিন্তু তাঁরা শুধু জঙ্গল দেখে ফিরে যান।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, ভিটির ধ্বংসপ্রাপ্ত কাঠামো কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু গাছপালা এবং একটি ঘাট বাঁধানো পুকুর ছাড়া অবশিষ্ট আর কিছুই নেই। জানা যায় ৩০ বছর আগেও দাশের বাড়িতে অধি দাশ ও ভোলা দাশ নামে কবির দুই জ্ঞাতি সপরিবার বসবাস করতেন। তারা সপরিবার ভারতে চলে যাবার পর থেকে ছাড়া ভিটায় পরিণত হয়েছে কবির জন্মস্থান।

জীবনানন্দ দাশের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে এক যুগের বেশি সময় ধরে গবেষণা করছেন রাজাপুর ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মো. সোহরাব হোসেন। তাঁর দাবি, কবির ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতায় উলে¬খ করা তিনটি নদী ধানসিঁড়ি, রুপসিয়া ও জাঙ্গালিয়ার অবস্থান কবির জন্মভিটার কাছেই। বেশ কয়েক বছর ধরে ঘেঁটে জানতে পেরেছেন, কবির পূর্বপুরুষদের নিবাস ছিল ফরিদপুরে। কিন্তু সেখানে নদীভাঙনের শিকার হয়ে কবির বাবা ও দুই চাচা ঝালকাঠির বামনকাঠি গ্রামের সেন বাড়িতে আশ্রয় নেন এবং এখানেই কবির জন্ম হয়।

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা সিটি কলেজের টিউটরের চাকরি থেকে জীবনানন্দ বরখাস্ত হন। কিছু দিন বেকার জীবনের পর ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে দিল্লির রামযশ কলেজে চাকরি লাভ করেন। কয়েক মাস পর ১৯৩০-এর মার্চে রামযশ কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে বরিশালে ফিরে আসেন জীবনানন্দ দাশ। ২৬ বৈশাখ তারিখে ঢাকা শহরে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে জগন্নাথ কলেজের পাশে অবস্থিত ঢাকা ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে কবি জীবনানন্দ দাশ রোহিণীকুমার গুপ্তের কন্যা লাবণ্য গুপ্তের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। লাবণ্য গুপ্ত সে সময় ঢাকার ইডেন কলেজের ছাত্রী। বিয়ের পর জীবনানন্দ দাশ আর রামযশ কলেজে ফিরে যাননি কার্যত বেকার জীবন বেছে নিয়েছিলেন। বেকার জীবনানন্দ সস্ত্রীক বরিশালে শহরের পিতৃগৃহে অবস্থান করতে থাকেন। এ সময় প্রচুর লেখালেখি করেন তিনি।

বিশেষভাবে উল্লেখ্য, কবিতার পাশাপাশি এ সময় ১৯৩১-এ তিনি গল্প-উপন্যাসও লিখতে শুরু করেন। পিতৃগৃহে ছিলেন বলে চাকরি না থাকলেও যাকে বলে 'জীবন সংগ্রাম তা ছিল না। চাকরি খোঁজার দায়িত্ব এবং বেকার থাকার অনির্বচনীয় মর্মযাতনা সত্তে¡ও অবসর ছিল প্রশস্ত। এই প্রশস্ত অবসরে জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন। ১৯৩৫-এর আগস্টে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে টিউটর হিসেবে চাকরি লাভ করেন জীবনানন্দ। ফলে তার দীর্ঘ বেকার জীবনের অবসান ঘটে। কিন্তু লেখালেখির এই দ্রুত চলা আরও কিছু দিন অব্যাহত থাকে। বরিশালের বগুড়া রোডে অক্সফোর্ড মিশন গির্জার পাশে সর্বানন্দ ভবনে থাকতেন জীবনানন্দ দাশ ও তাঁর পরিবার।

বরিশালের এই বাড়িতে কবি কাটিয়েছেন জীবনের অনেকটি বছর। এখন যে পরিবারটি সে বাড়িতে বসবাস করছে তারা ক্রয়সূত্রে ১৯৫৮ সাল থেকে এই ভিটের মালিক। কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাঁরা বাড়িটির নাম দিয়েছেন ‘ধানসিঁড়ি’। বাড়ির বাসিন্দাদের সহযোগিতায় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কবির জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকীতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজনও করা হয় সেখানে। ১৯৪৬ সালে ব্রজমোহন কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে কলকাতায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত জীবনানন্দ দাশ বরিশালেই থাকতেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ধানসিঁড়ি নদীর রূপ-লাবণ্যের কথা উঠে এসেছে। ধানসিঁড়ি নদী পরিচিতি পায় দেশ-বিদেশে। কিন্তু কবির স্মৃতিবিজড়িত সেই নদী এখন মরাখাল।

একসময়ের খরস্রোতা ধানসিঁড়ি নাব্যতা হারিয়ে ও দুপাশ দখলে সংকুচিত হয়ে গেছে। ধানসিঁড়ি নদীটি রাজাপুরের বাগড়ি বাজার থেকে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে গিয়ে মিশেছে। এ ছাড়া জীবনানন্দ দাশের বাড়ির উত্তর দিক দিয়ে আরেকটি নদী প্রবাহিত ছিল। এই নদীর নাম রুপসিয়া। রাজাপুর বাজার থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে যে নদীটি বিষখালী নদীতে মিশেছে, সেটির নাম জাঙ্গালিয়া। এই তিনটি নদীই এখন প্রায় মৃত। ঝালকাঠি জেলার গাবখান ইউনিয়নের বৈদারাপুর গ্রাম থেকে ধানসিঁড়ির যাত্রা। বৈদারাপুর থেকে ধানসিঁড়ি বয়ে গেছে ছত্রকান্দা গ্রাম হয়ে পিংড়ি, হাইলাকাঠি, বাঘড়ীর কোল ঘেঁষে রাজাপুর থানা সদর হয়ে জাঙ্গালিয়া নদী পর্যন্ত। বাঘড়িরহাট পর্যন্ত যার শেষ সীমানা। তিন দশক আগেও আট কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ধানসিঁড়ি নদী ছিল রাজাপুরের সঙ্গে ঝালকাঠির একমাত্র সংযোগসূত্র। এ নদী ধরেই রাজাপুরের লোকজন তখন ঝালকাঠি ও বরিশালে যাতায়াত করেছে। এককালে এ নদী দারুণ স্রোতস্বিণী ছিল। এখন মরা খালে পরিণত ধানসিঁড়ির দেহ শীর্ণ হয়ে গেছে। স্থানে স্থানে শুকনো মৌসুমে পানিশূন্য থাকে। বড় বড় গয়না নৌকায় চড়ে মানুষ ধানসিঁড়ি নদী দিয়ে একসময় ঝালকাঠি ও বরিশালে যাতায়াত করেছে।

জীবনানন্দ দাশ ধানসিঁড়িকে যেভাবে বাঁচিয়ে রেখেছেন, তাতে এখনও অনেকের আগ্রহ একনজর এই নদীটিকে দেখার। দেশ-বিদেশের বহু মানুষ ধানসিঁড়ি দেখার জন্য ছুটে এসে হতাশ হয়ে ফিরে যায়। নৌকা নিয়ে ঘুরেও ধানসিঁড়ি নদী দেখার সুযোগ নেই। সর্বশেষ ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে ধানসিড়ি নদীর উৎস মুখ থেকে সাড়ে সাত কিলোমিটার পশ্চিমে খননের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ওই সময় সাড়ে চার কিলোমিটার পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে ৮৪ লাখ টাকা ব্যয়ে রাজাপুর অংশের পিংড়ি-বাগড়ি-বাঁশতলার মোহনা পর্যন্ত খনন করা হয়েছিল। নিয়মিত বরাদ্দ না দেওয়ায় পরের সাড়ে তিন কিলোমিটার আর খনন করা হয়নি। প্রায় আট কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ধানসিড়ি নদীর রাজাপুর অংশের অবস্থা বড়ই করুন। ধানসিড়ি নদীর রাজাপুর অংশে খননের অভাবে ও বাগড়ি বাজার গরুর হাট এলাকায় দখল হওয়ার কারণে নদী এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। কিন্তু উৎস মুখ ভরাট হওয়ায় নদীর ওই অংশ আবারও ভরাট হয়ে গেছে। সর্বত্র কচুরিপানা আটকে আছে। বর্তমানে এ নদীর অবস্থা এতটাই করুণ যে নৌকা চলাচলও করতে পারছে না।

রাজাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রিয়াজ উল্লাহ বলেন, ধানসিঁড়ির দুই পারে কয়েক শ হেক্টর উর্ভর জমি আছে। কিন্তু নদীটি মরে যাওয়ায় সেচের অভাবে তা এক ফসলি জমিতে পরিণত হয়েছে। এসব জমিতে বর্ষা মৌসুমে আমন ধানের আবাদ করতে পারলেও শীত মৌসুমে পানি না থাকায় বোরোসহ শীতকালীন কোনো ফসলের আবাদ করতে পারছেন না কৃষকেরা। জীবনানন্দকে নিয়ে যথাযথ চর্চা ও প্রচার না থাকায় এই এলাকার বেশির ভাগ মানুষের কাছেই তিনি রয়ে গেছেন অনাবিষ্কৃত। জীবনানন্দকে ধারণ করতে না পারাটা এই এলাকাবাসীর জন্য চরম লজ্জার। ১৯৫৪'র ২২ অক্টোবর মৃত্যুর কিছু পূর্বে কলকাতার নাভানা প্রকাশনা সংস্থা প্রকাশ করেছিল জীবনানন্দ দাশের 'শ্রেষ্ঠ কবিতা'। তার মৃত্যুর পর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ প্রবন্ধ সংকলন 'কবিতার কথা'।

সিগনেট প্রেস থেকে 'কবিতার কথা' প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে। কবি তাঁর জন্ম স্থানের ধানসিঁড়ির পাড়েই শঙ্খচিল বা শালিকের বেশে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। হয়ত ফিরে আসতে চেয়েছিলেন তাঁর প্রিয় জন্মভূমিতে। সেই ফেরা হয়েছিল কিনা যানা যায়নি। যে ধানসিঁড়ি নিয়ে কবিতা লিখে খ্যাতিম্যান হয়েছিলেন, ধানসিঁড়িকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করেছিলেন সেই ধানসিঁড়ি নদী আজ বিপন্ন প্রায়। শুধু তাই নয় রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের আজীবন স্মৃতি বিজড়িত ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার বামনকাঠি গ্রামের নিজ জন্মভূমি, আজ নিখোঁজ অবস্থায় জঙ্গলাকীর্ণ ও বিস্তীর্ণ ধানক্ষেতে পরিণত হযয়েছে। তার অতি প্রিয় স্মৃতি বিজড়িত বিখ্যাত ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতার ধানসিঁড়ি নদীটি আজ ভরাট হয়ে ধু-ধু মাঠে পরিণত হয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফরোজা বেগম পারুল বলেন, রূপসী বাংলার কবিকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। শিগগিরই তাঁর জন্ম ভিটা সংরক্ষণের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে লিখিত আবেদন করা হবে। রাজাপুর উপজেলার পিংড়ি বলারজোড় ৫ কি. মি: সড়ক কবি জীবনানন্দ দাশ সড়ক হিসেবে নামাকরণ করা হয়েছে। এই মুহুর্তে কোন প্রকল্প না থাকলেও পুনরায় ধানসিঁড়ি নদী খননের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

(আরআইএফ/এসপি/অক্টোবর ২২, ২০১৭)