জাহিদুর রহমান


২০১৩ সাল থেকে ২০১৭। শুধু এফডিআরের হিসাব ধরলে এই পাঁচ বছরেই কোটিপতি এসপি সুভাষ। জ্ঞাতভাবে তার সঞ্চয় বছরে গড়ে ১ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। যা পাঁচ বছরে দাঁড়ায় ৮ কোটি ৩৬ লাখের বেশি।

এই সময়ে অ্যাডিশনাল এসপি থেকে হয়েছেন এসপি। বৈধভাবে বেতন-ভাতা পেয়ে যা কামিয়েছেন আর পারিবারিক যে সম্পত্তি রয়েছে তাতে কোটি টাকা জমানোও কঠিন। এই সময়ে কোনো শান্তিরক্ষী মিশনেও অংশ নেননি তিনি।

সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে এসপি সুভাষের দুর্নীতির যে তথ্য প্রাথমিকভাবে বেরিয়ে এসেছে তাতে অস্বস্তি খোদ পুলিশ বিভাগে। একই পদে কিংবা বিভাগের উচ্চপদস্থদের সম্মুখীন হতে হচ্ছে বিব্রতকর সব প্রশ্নের। উটপাখির মতো বালিতে মাথা লুকাচ্ছেন তারা।

বিসিএস পুলিশের ১৭ থেকে ২৫ ব্যাচের অতিরিক্ত ডিআইজি, পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায় সুভাষের আর্থিক অপকর্ম নিয়ে ক্ষোভ, অসন্তোষের কথা।

‘আমরা যারা সৎ আর সাদামাটা জীবনযাপন করি, পুলিশ সুপার পদে জেলা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করি তারা এখন বেশি বিব্রত। গত কয়েকদিন ধরেই বন্ধু ছাড়াও চেনা গণ্ডির নানাজন সুভাষের প্রসঙ্গ তুলে আমাদের খোঁচা দিচ্ছেন। বলতে পারেন অসম্মানও করছেন। আমাদের সততা নিয়েও অনেকে ঠাট্টা-মশকরা করছে। হৃদয়ে যে কি পরিমাণ রক্তক্ষরণ হচ্ছে তা না পারছি বলতে, আবার না পারছি সহ্য করতে। মনে হয় পেশাগত ভাবেই মরে যাচ্ছি।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজের কাছে এভাবেই আক্ষেপ করছিলেন ঢাকা রেঞ্জের গুরুত্বপূর্ণ একটি জেলার পুলিশ সুপার পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা।

এদের কেউ বলেছেন, পেশাগত দিক দিয়ে মহল বিশেষের আস্থার হলেও সুভাষ ডুবে ডুবে জল খেয়েছেন। দুর্নীতির গভীর জলে নিমজ্জিত হয়েছেন তা প্রথমে অনেকেই বিশ্বাসই করতে পারেননি। জাঁদরেল এসপি হিসেবেও দুর্নীতির কালো বেড়াল খোঁজার মতো প্রশাসনিক সংস্কার ঘোষণা করা সুভাষের প্রকৃত চেহারা বেরিয়ে আসায় নিজেদের ক্ষোভ আর ঘৃণাটাও প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।

সুভাষের ব্যাচের একজন পুলিশ কর্মকর্তা বাংলানিউজকে জানান, গত বছরের ৬ নভেম্বর ঝালকাঠি থেকে ফরিদপুরে বদলি হয়ে আসেন সুভাষ। পরদিন ৭ নভেম্বর নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে পরিচিতিমূলক মতবিনিময় সভায় সুভাষের দেওয়া বক্তব্যের উদ্ধৃতি টেনে তিনি বলেন, সুভাষ ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘পুলিশের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও আশকারা ছাড়া মাদক ব্যবসা চলতে পারে না। আমি ইতোমধ্যে মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করে এ ব্যাপারে ভয়ংকর সব তথ্য পেয়েছি, যা আমার পেশার জন্য হুমকিস্বরূপ। তবে আমি সর্ষের মধ্যকার ভূত তাড়ানোর চেষ্টা করছি এবং গত তিন মাসে আমি অনেকটা সফলও হয়েছি।’ নিজের বাহিনীর মধ্যে কারা এই ‘ভূত’, তা সে সময় তিনি নির্দিষ্ট করে না বললেও সেই ভূত যে তার ঘাড়েই ভর করেছিলো তা বের হয়ে আসছে একে একে। যোগ করেন সুভাষের ব্যাচের ওই কর্মকর্তা।

দুর্নীতির মাধ্যমে আট কোটি টাকার বেশি উপার্জনের অভিযোগে ফরিদপুরের সদ্য সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) সুভাষ চন্দ্র সাহা ও তার স্ত্রী রীনা চৌধুরীর বিরুদ্ধে গত মঙ্গলবার রাজধানীর বংশাল থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। যে কারণে ফরিদপুর থেকে প্রত্যাহার করে সুভাষকে সংযুক্ত করা হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরে। বলা হয়েছে, মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এ অবস্থানেই বহাল থাকবেন তিনি।

জানা যায়, মাগুরা জেলার শ্রীপুর থানার রাধানগর গ্রামের প্রয়াত সূর্য্য কান্ত সাহা ও তরুলতা সাহা দম্পত্তির সন্তান সুভাষ চন্দ্র সাহা (৪৪)

১৯৯৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে ৪র্থ স্থান নিয়ে মাস্টার্স পাস করেন।

১৯৯৯ সালে বিসিএস পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হন। ২০০৩ সালের ১০ মে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে মৌলভীবাজারে যোগ দেন। এরপর তিনি একই পদে সিলেট সদর, বরগুনা ও পিরোজপুরের বিভিন্ন সার্কেলের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে পিরোজপুর, কুষ্টিয়া, যশোর ও সিরাজগঞ্জ জেলায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৫ সালের ৫ মে পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। একইবছর ১৪ জুন ঝালকাঠি জেলা পুলিশের দায়িত্বভার পান। সবশেষ ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর ফরিদপুর জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

বিসিএস ২১তম ব্যাচের পুলিশ ক্যাডারে ৫৪ জনের মধ্যে সুভাষের মেধাক্রম ছিল ৩০ এর ওপরে। ওই ক্যাডারের ৫১ জন এখন পুলিশেই কর্মরত। যাদের মধ্যে ১০ জনের বেশি বিভিন্ন জেলায় পুলিশ সুপারের দায়িত্ব রয়েছেন। বরিশালের আগৈলঝড়া উপজেলার জামাই সুভাষ চন্দ্র সাহা এসপি হিসেবে প্রথম পদন্নোতি পেয়েই যোগ দেন শ্বশুরবাড়ির পাশের জেলা ঝালকাঠিতে। কুষ্টিয়ায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থাকার সময়ই সুভাষ মনোযোগ দেন এফডিআরের দিকে। শুরু হয় অবৈধ অর্থ সঞ্চয়। তার একমাত্র পছন্দের ব্যাংক ওয়ান ব্যাংক লি.।

ব্যাংকটি যশোর শাখায় ২০১৩ সালের সালের ২৬ মে ৩২ লাখ টাকার প্রথম এফডিআর খোলেন তিনি। একই বছরের ১০ জুন একই শাখায় ৩৬ লাখ টাকার এফডিআর ও একই ব্যাংকের এলিফ্যান্ট রোড শাখায় ২৭ জুন ১৮ লাখ টাকার এফডিআর খোলেন। অর্থাৎ এক বছরেই ৮৬ লাখ টাকা শুধু এফডিআর।

তারপর ২০১৫ সালের মে মাসে এসপি হিসেবে পদন্নোতির পরপরই স্ত্রী ও নিজের নামে ওয়ান ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় ফুলে ফেঁপে এফডিআর হিসেবে জমা হতে থাকা অর্জিত অর্থ। অথচ আয়কর ও আয়কর রিটার্নে এ আয়ের কোনো উল্লেখ করেননি তিনি।

মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় সুভাষ দম্পতির বিরুদ্ধে দায়ের করা দুর্নীতির মামলার বাদী দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয়, ঢাকা-১’র সহকারী পরিচালক আবদুল ওয়াদুদ বলেছেন, পুলিশ বিভাগে চাকরিকালীন বিভিন্ন দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জিত ৮ কোটি ৩৬ লাখ ১৩ হাজার ৩শ ৬৭ টাকার উৎস, অবস্থান, মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ গোপন করেছেন অভিযুক্ত সুভাষ দম্পত্তি। এমনকি তাদের ২০১৬-২০১৭ কর বছরের আয়কর রির্টানেও এ টাকার কোনো তথ্য ছিল না।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সুভাষ চন্দ্র সাহা মূলত পুলিশে নিয়োগ, বদলি ও পদন্নোতির মাধ্যমেই অবৈধ অর্থ উপার্জন করেছেন বেশি। বাইরে সততার লেবাসে ভেতরে ভেতরে তিনি রোপণ করেছিলেন দুর্নীতির বটবৃক্ষ।

সুভাষের ব্যাচের একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, সুভাষ কখনো শান্তিরক্ষী বাহিনীতেও কাজ করেননি। বরং তর তর করে দু’টি জেলায় পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পেয়েছেন।

এখন প্রশ্ন হলো সুভাষ কেন যশোরে এফডিআর করতে গেলেন?

সুভাষ চন্দ্র সাহা কুষ্টিয়ায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান করেন ২০১০ সালের প্রথম দিকে। ওই জেলায় চাকরি করেন প্রায় ৩ বছর। এ অঞ্চলের অনেক কিছুই নিজের নখদর্পনে থাকায় যশোরে ওয়ান ব্যাংকেই নিজের গজ্জিত অর্থ রাখাকে নিরাপদ ভাবতে থাকেন তিনি। ১৯টি এফডিআরের মধ্যে ১২টিই যশোরে। ৬টি ঢাকার বংশালে আর অবশিষ্ট এফডিআরের অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন এলিফ্যান্ট রোড শাখায়।

সময় সুযোগ বুঝে যশোর থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত ওই অর্থ তিনি ভারতে পাচারের উদ্দেশে রেখেছিলেন- এমন সন্দেহ খোদ সুভাষের ব্যাচের একাধিক কর্মকর্তার।

কি করে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন আর তা উদঘাটিতই বা হলো কি করে?

পুলিশের ২০তম ব্যাচের পুলিশ সুপার পদে একজন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে জানান, এসপি পদে বেতন পাই পঞ্চম গ্রেডে। মূল বেতন ৪৩ হাজার টাকা। এর সঙ্গে বাসাভাড়া ও বিভিন্ন ভাতা দিয়ে যা পাই তা দিয়ে মাস শেষে খরচ সামলে সঞ্চয় রাখাটা বেশ কঠিন। এক-দুই কোটি টাকা হলে না হয় কথা ছিল। কিন্তু ৮ কোটি টাকা! এটা চাকরি বা দু’বছরে মিশন খেটেও আয় করা কল্পনাতীত।

আরেক কর্মকর্তা আর্থিক খাতের গোয়েন্দা তৎপরতার ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরে বলেন, একজন কোটি কোটি টাকা ব্যাংকে নিজের ও স্ত্রীর নামে গচ্ছিত রাখছে। অথচ কেউ প্রশ্ন-ও করছে না। লেনদেন সন্দেহজনক কিনা সে বিষয়েও কেউ টু শব্দটি করলো না?

তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) এমনকি বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) কি করলো? এভাবে বছরের পর বছর মানি লন্ডারিং হলো। তারা কি করলেন। আর ওয়ান ব্যাংক কর্তৃপক্ষের ভূমিকাও সন্দেহজনক। তারাই বা কেন এই অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকে সময় মতো অবহিত করলেন না?

সব মিলিয়েই মনে হয় এটাই বাংলাদেশ। সবাই এক পাঁকে বাঁধা- হতাশার কথাও জানান ১৭ ব্যাচের এক কর্মকর্তা। তার মতে, সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করলে দুদককে এতদূর যেতে হতো না। আমাদের পুলিশ বিভাগের ইমেজ ক্ষুণ্নের সুযোগ পেতো না সুভাষ ও তার সহযোগী।

তথ্যসূত্র : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম