শরীয়তপুর প্রতিনিধি : শরীয়তপুর পৌরসভা এলাকার জন্য বরাদ্দকৃত বিদ্যুৎ থেকে সীমাহীন দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে বিভিন্ন ইউনিয়নে পল্লী বিদ্যুতের এলাকায় পাচার করা হচ্ছে পিডিবি‘র বিদ্যুৎ। এর মাধ্যমে একটি সংঘবদ্ধ চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। আর এ কাজে প্রত্যক্ষ সহায়তা দিচ্ছে পিডিবি কর্তৃপক্ষ। পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ বার বার চিঠি দিয়েও থামাতে পারেননি পিডিবি কর্মকর্তাদের অবৈধ বিদ্যুৎ পাচার বানিজ্য। বরং সন্ত্রাসী হামালা করে বাধা দেয়া হয়েছে পল্লী বিদ্যুতের কার্যক্রম।

১৯৭৮ সাল থেকে তৎকালিন শরীয়তপুর মহকুমা শহরে শুরু হয় বিদ্যুৎ সরবরাহ। সে মসয়ে মাদারীপুর শহরের আওতায় চালানো হতো সরকারি-বেসরকারি মিলে মাত্র দেড় শত গ্রাহকের সঞ্চালন ব্যবস্থা। যতই সময় পেরিয়েছে ততই বেড়েছে গ্রাহকের সংখ্যা।

১৯৮৪ সালে শরীয়তপুরকে জেলা ঘোষনা এবং ৮৫ সালে পৌরসভা ঘোষনার পর বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকে। ২০০০ সাল থেকে শরীয়তপুরে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতায় সমগ্র জেলায় শুরু হয় বিদ্যুৎ বিতরণ কার্যক্রম। তখন থেকেই শুধুমাত্র শরীয়তপুর পৌরসভাধীন ২৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকা রাখা হয় পিডিবির আওতায়। তখন থেকে শুধুমাত্র শরীয়তপুর পৌরসভা এলাকায় আঙ্গারিয়া, আটং, রাজগঞ্জ ও টাউন ফিডারের মাধ্যমে শরীয়তপুর পৌর শহরে গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিতরন করছে পিডিবি।

পিডিবির নাম পরিবর্তন করে বর্তমানে ওয়েষ্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী (ওজোপাডিকো) নামকরণ করা হয়েছে। উলেøখিত চারটি ফিডার থেকে পাশ্ববর্তী রুদ্রকর, আঙ্গারিয়া, চিতলিয়া, তুলাসার, পালং ও ডোমসার ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে অন্তত ২০ কিমি নতুন লাইন স্থাপন কার্যক্রম অবৈধ প্রক্রিয়ায় চালানো হচ্ছে । কয়েকটি সিন্ডিকেট মিলে পর্যায়ক্রমে পৌর এলাকা অর্থাৎ শহরের জন্য নির্ধারিত বিদ্যুৎ লাখ লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে পাচার করছে পৌর এলাকার সীমানা ঘেরা ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে। এ কাজে প্রত্যক্ষ সহায়তা করছে পিডিবির কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারি।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, শরীয়তপুর সদর উপজেলার আঙ্গারিয়া ইউনিয়ন, রুদ্রকর ইউনিয়নসহ কযেকটি এলাকায় ঝুঁকিপূর্নভাবে বাশেঁর খুঁটি, খেঁজুর গাছ, কড়ই গাছ. শিমুল গাছের সাথে তার টাঙিয়ে সরবরাহ করা হয়েছে পিডিবির বিদ্যুৎ। সাম্প্রতিক সময়ে অবৈধ ঝূঁকিপূর্ণ বিদ্যুতের তারে পেচিঁয়ে শুধু আঙ্গারিয়া ইউনিয়নের হাজৎখোলা ও দরিচর গ্রামেই মারা গেছে তিন ব্যক্তি। এরা হলেন, মোহাম্মদ সরদারের একমাত্র পূত্র রুহুল আমিন, দরবেশ খানের ছেলে ওয়ারেস খান ও নুরুল হক মাঝির ছেলে ফরিদ মাঝি।

এছারাও বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে মারা গেছে কয়েকটি গবাদী পশু। গত ৬ মাসে রুদ্রকর, আঙ্গারিয়া, চিতলিয়া ও তুলাসার ইউনিয়নে অবৈধভাবে ৩ শতাধিক খুঁটি স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে কোথাও কোথাও বিদ্যুৎ সঞ্চালন শুরু হয়েছে। আবার কোথাও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। গ্রাহকদের কাছ থেকে জানা গেছে খুঁটি স্থাপন ও মিটার বিতরনের মাধ্যমে সিন্ডিকেট সদস্যরা অন্তত ১ কোটি ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৫ বছর যাবৎ পল্লী বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে এমন সব এলাকায় শত শত গ্রাহকের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করা হচ্ছে পিডিবির বিদ্যুৎ। চিতলিয়া ইউনিয়নের কাশিপুর গ্রামের মান্নান বেপারী, ইয়াকুব মাল, ইউপি সদস্য আলমগীর মালের স্ত্রী তানজিলা বেগম জানান, স্থানীয় অজুদ মোল্লা ও বাচ্চু মাল তাদের থেকে প্রতিটি খুঁটির বিনিময়ে ৩০ হাজার টাকা নিয়েছে। আর প্রতিটি মিটারের জন্য আদায় করছে ৯ হাজার টাকা। আঙ্গারিয়া ইউনিয়নের দরিচর দাদপুর গ্রামের বিলকিছ বেগমসহ নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েক ব্যক্তি বলেন, সাবেক ইউপি মেম্বার আব্দুর রব মোল্লা এলাকায় বিদ্যুতের খুঁটি দেয়ার কথা বলে প্রতি ঘর থেকে ৬ হাজার করে টাকা তুলে নিয়েছে।

দরিচর গ্রামের মোক্তার হোসেন, আমাদের বাড়িতে ১৫ বছর যাবৎ পল্লী বিদ্যুৎ ব্যবহার করছি। এখন এলাকায় নতুন করে পিডিবির লাইন দেয়া হচ্ছে। পলøী বিদ্যুৎ থেকে পিডিবির সরবরাহ ভাল তাই আমরা পিডিবির সংযোগ পেতে দরখাস্ত করেছি। স্থানীয় সিরাজ কাজী বলেন, আমাদের গ্রামগুলোতে অনেক আগে থেকেই পল্লী বিদ্যুতের লাইন চালু রয়েছে। এখন কি ভাবে, কোন আইনে এলাকায় পিডিবি প্রবেশ করছে তা আমাদের জানা নেই।

স্থানীয় আঙ্গারিয়া বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী ও বাড়ির মালিক বলেন, শরীয়তপুরে বিডিবির আওতায় সাড়ে ৭ মেগা ওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে। সরবরাহ হয় মাত্র সাড়ে ৫ থেকে ৬ মেগাওয়াট। এত টুকু সীমিত বিদ্যুৎ থেকে আবার অনিয়মতান্ত্রিকভাবে বিদ্যুৎ পাচার করা হচ্ছে পল্লী বিদ্যুতের এলাকায়। ফলে আমরা প্রতিনিয়িত বিভিন্ন ভোগান্তি পোহাচ্ছি। এই অবৈধ ব্যবসা বন্ধে আমরা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

শরীয়তপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ঠিকাদার মো. আলা উদ্দিন হাওইকার বলেন, আমি চিতলিয়া ইউনিয়নের মীরাকান্দি গ্রামে পল্লী বিদ্যুতের খুঁটি স্থাপনের কাজ করতে গেলে সেখানে পিডিবির অবৈধ গ্রাহকরা আমার কাজে বাধা দেয়। আমাকে খুঁটি স্থাপন করতে দেয়া হয়নি। ফলে আমি অনেক লোকসানে পরেছি।

শরীয়তপুর জেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহা ব্যবস্থাপক মো. সোহরাব আলী বিশ্বাস বলেন, শরীয়তপুর পৌরসভা এলাকার বাইরে পিডিবির বিদ্যুৎ সরবরাহের কোন সুযোগ নেই। তার পরেও অবৈধ অনুপ্রবেশ করে পলøী বিদ্যুতের এলাকায় পিডিবি দীর্ঘ দিন যাবৎ লাইন স্থাপন করে আসছে। এ বিষয়ে বার বার চিঠি দিয়েও কোন ফল পায়নি। জেলা প্রশাসকের কাছেও অনেকবার ধর্ণা ধরেছি। কেউ কোন সহায়তা করেনি। আমি অনতি বিলম্বে এই অবৈধ ব্যবসা বন্ধে সংশ্লিষ্টদের সহায়তা কামনা করছি।

শরীয়তপুর ওজোপাডিকো (পিডিবি) এর নির্বাহী প্রকৌশলী শ্যামা প্রসাদ মিত্র বলেন, ইউনিয়ন পর্যায়ের গ্রাহকদের আবেদনে স্থানীয় সংসদ সদস্য মহোদয়ের সুপারিশের ভিত্তিতে পিডিবির ফরিপুরে অবস্থিত প্রকল্প কার্যালয় ইউনিয়ন গুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহের অনুমতি প্রদান করেছে। এটা আমার দপ্তরের কাজ নয়। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ বিতরণ করতে গিয়ে কেউ অবৈধভাবে টাকা পয়সা নিয়ে থাকলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


(কেএনআই/এসপি/নভেম্বর ০৩, ২০১৭)