মো. আতিকুর রহমান


বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যার ভাবে নিষ্পেষিত দারিদ্র পীড়িত এক সম্ভবনাময় দেশের নাম বাংলাদেশ। ইন্টানেটের অবাধ অপব্যবহার, ডিজিটাল বাংলাদশের স্বপ্ন এবং সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের ষড়যন্ত্রে সাইবার ক্রাইম আমাদের প্রিয় মাতৃভুমিকেও অশান্ত করতে পারে, যা আমাদের অস্তিত্ত্বকেও হুমকির মুখে ফেলতে পারে। যেখানে এন্তেজানিয়ার মতো  রাষ্ট্র সাইবার ক্রাইমে ধ্বংসের মুখোমুখি সেখানে আমাদের অবস্থা আরো করুণ। তাই এ ব্যাপারে এখনই পদপে নেওয়া জরুরী।

গতানুগতিক এ সংস্কৃতিতে ক্লিক করলেই স্ক্রীনে ভেসে উঠে অশ্লীল নীল ছবি ও বেহায়াপনা। ক্লিক করলেই চ্যাটিং করতে পারছে এক দেশের তরুণ অন্য দেশের তরুণীর সাথে। আর এ সুযোগ দেদারসে লুফে নিচ্ছে এদেশের অতি সম্ভাবনাময় কিশোর-কিশোরীরা, যাঁরা এদেশের উন্নয়নের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারী। পিতা-মাতার অগোচরে তাঁরা সাইবার ক্যাফে গিয়ে ব্লু-সাইট ব্রাউজ করে প্রতিনিয়ত যৌন তৃপ্তি মেটাচ্ছে। অত্যধিক জৈবিক শক্তির ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে তাঁরা মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে তাঁদের মন থেকে দিন দিন পড়া লেখা, শ্রদ্ধা, সম্মানবোধ, বিবেক বুদ্ধি ইত্যাদি লোপ পেতে থাকে। এর কারণেও সমাজে চুরি, ডাকাতি, খুন, স্মাগলিং, সন্ত্রাসী, ধর্ষণ, ইভটিজিং ও প্রতারণার মতো ঘৃণ্য কিশোর অপরাধ ও অপরাধী চক্র উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইদানিং মোবাইল ফোন ও কম্পিউটারের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফির মারাত্মক বিস্তার ঘটেছে। এ কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে মোবাইল ফোন। দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারের বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট আইন বা নির্দেশনা নেই। কম দামি হওয়ায় মাল্টিমিডিয়া সুবিধা সম্বলিত হ্যান্ডসেট তরুণদের হাতে হাতে ঘুরে ফিরছে। ইন্টারনাল বা এক্সটারনাল মেমোরির মাধ্যমে অশ্লীল ভিডিও চিত্রগুলো সংরক্ষণ ও ব্লু টুথ প্রযুক্তিতে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে অন্যের মোবাইল ফোনে। এক্ষেত্রে সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণীরা।

নির্ধারিত বয়সের আগে সাবালকত্বের মিথ্যা পরিচয় দিয়ে ফেসবুকে ঢুকে পড়ছে স্কুলের অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু-কিশোররা। শিক্ষাগ্রহণের এই বয়সে সারাক্ষণ ফেসবুকের নেশায় বুদ হয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে আমাদের নতুন প্রজন্ম। ক্ষুধামন্দা, মানসিক বৈকল্য, বিষণ্ণতা ও শারীরিক অক্ষমতা তৈরি হচ্ছে তাদের মধ্যে। ফলে কোমলমতি এসব ছেলেমেয়ের মনোযোগ কমে যাচ্ছে, কমছে পাঠাভ্যাস, সেই সঙ্গে সামাজিক সৌজন্যতাবোধও। খিটখিটে মেজাজ, হিংস তা, চোখের অসুখ, নার্ভের সমস্যা দেখা দিচ্ছে তাদের। মানসিক ভারসাম্যহীনতার মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে ফেসবুকচারী এই প্রজন্ম। সবকিছু মিলিয়ে নেতৃত্ব ক্ষমতাহীন, দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং বাস্তবতার বাইরে তৈরি হচ্ছে এক অলীক স্বপ্নময় জীবনের (ভার্চুয়াল লাইফ) নেশায় আসক্ত নতুন প্রজন্ম।

মূলত এই আসক্তির ফলে যা হলো, নিজের সম্পর্কে অতিরিক্ত শেয়ার, যখন-তখন কারণ ছাড়াই ফেসবুকে ঢোকা, প্রোফাইলের ছবিটি নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া, ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিউজ ফিড পড়া এবং এগুলো নিয়ে সময় পার করা, অনলাইনের জন্য বাস্তবের জীবনকে জলাঞ্জলি দেওয়া, কাউকে বন্ধু করতে পাগলের মতো আচরণ করা, ফোনের নোটিফিকেশন বা কোনো নোটিফিকেশনের চিহ্ন দেখলেই উত্তেজিত হয়ে ওঠা, কোথাও গেলে সঙ্গে সঙ্গে চেক ইন করার মাধ্যমে নিজের অবস্থান জানিয়ে দেওয়া, প্রায়ই মানুষকে ট্যাগ করা, কাজের সময় লুকিয়ে গোপনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেসবুক ব্যবহার করা, কেউ যখন কোনো ফেসবুক পোস্টে কোনো মন্তব্য করে না তখন হতাশ হয়ে পড়া, বন্ধু সংখ্যা বাড়ানোর জন্য অপরিচিতদের তালিকায় যুক্ত করার প্রবণতা, একেবারে মাঝ রাতে ঘুম থেকে ধড়ফড় করে উঠে ফেসবুক চেক করা এবং অনেক ক্ষেত্রে ফেসবুক ছাড়া জীবন অচল হয়ে পড়ছে এ রকম ভাবনা পেয়ে বসা। আর এই আসক্তির ফলে যা ঘটে তা আরো ভয়াবহ যেমন- আবেগ-অনুভূতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, হতাশা ও দুশ্চিন্তা পেয়ে বসে, একাকী বোধ হয় ও নিজেকে দোষী ভাবতে শুরু করে আসক্ত ব্যক্তি, কাজের সময় ঠিকঠাক থাকে না, কাজের আগ্রহ হারিয়ে যায়, সময় জ্ঞান লোপ পায়, অসৎ পথে পরিচালিত হতে বাধ্য করে, নিজেকে অন্যর সঙ্গে তুলনা করে ঈর্ষাবোধ হতে শুরু করে, দায়-দায়িত্ব ভুলে মনোযোগ ডুবে থাকে ফেসবুকে এবং সম্পর্ক নষ্ট হয়, ঘর ভেঙে যেতে পারে। এছাড়াও নানাবিধ শারিরীক সমস্যা পিঠব্যথা, মাথাব্যথা, স্পন্ডাইলিটিজ বা মেরুদণ্ডে সমস্যা, ওজনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে কারও ওজন বেড়ে যায় আবার কারও ওজন কমে যায়, ইনসমনিয়া বা ঘুমের ব্যাঘাত ও চোখে দেখতে সমস্যা হয়।

এসব জানা সত্ত্বেও এর ব্যবহার কমেনি বরং বেড়েছে দেশে প্রতিনিয়ত সাইবার ক্রাইমের এরকম ঘটনা ঘটে চলেছে। যা অনাকাক্সিক্ষত ও দুঃখজনক। এরকম অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাগুলোতে চরম মূল্য দিতে হচ্ছে নারী, শিশু ও যুবসমাজকে। কারণ হিসেবে প্রযুক্তির সহজ ও অবাদ ব্যবহারকে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রযুক্তির সহজলভ্যতা যুবসমাজকে অপরাধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ফলে বাড়ছে অবক্ষয় ও অপরাধ।

সকালে ঘুম থেকে উঠে এবং ঘুমাতে যাওয়ার আগে দ্রুত সময়ে পৃথিবীর যেকোনো খবর জানা ও আপনজনের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে পরিচিত টিভি ও ইন্টারনেটও প্রযুক্তির অবদান। প্রযুক্তি মানুষের জীবনযাত্রার মান সহজতর করাসহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও দুর্ভাগ্যবশত এটির অপব্যবহার কিশোর ও যুবসমাজকে অবক্ষয় ও নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দিকে দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
শুধু কি তাই? দেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে প্রশ্ন ফাঁস ঘটনা। আর এই ভয়ংকর কাজটি সহজেই করে ফেলছে প্রযুক্তির ব্যবহার করে। রাত জেগে ফেসবুক, টুইটার, ইমো, ভিগো, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবারের মতো সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার যেন এখন ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভিগো লাইভে মধ্যরাত থেকে বসে অশ্লীলতার মেলা! এতদিন যা ইউটিউব দখলে রেখেছিল। এখন তা একচেটিয়া ভিগোর দখলে। নোংরামির সেই ফুটেজ একে একে অন্যসব মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ছে। এসব ফুটেজ দিয়ে একে অন্যকে ব্ল্যাকমেইলও করছে। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন সবচেয়ে বড় ‘অসামাজিক মাধ্যমে’ রূপ নিয়েছে। এসব মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি বিচরণ করে তরুণ সমাজ। তাই ঝুঁকিটাও বেশি। সোশ্যাল মিডিয়ার কুফলের প্রভাব সমাজে বিশৃঙ্খলতা অবক্ষয় ও নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অন্যতম কারণ। এভাবে চলতে থাকলে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এগিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, পিছিয়ে যাওয়া এখন অনেক কাছে চলে এসেছে।

বাংলাদেশের মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের এক জরিপে দেখা গেছে, ৩০ জন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীর মধ্যে ক্লাসরুমে বসে পর্নোগ্রাফি দেখে এরকম ২৫ জনের মোবাইল ফোনে পর্নোগ্রাফি পাওয়া যায়। অপরদিকে, ১০০ জন অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীর ৮৬ জন মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, যাদের মধ্যে ৭৬ জন পর্নোগ্রাফি দেখে। ফলে তাদের আসক্তির মাত্রা বেড়ে চলছে পাশাপাশি লেখাপড়ায় অমনোযোগীর সংখ্যাও লক্ষণীয়। কিছু বিকৃত রুচিহীন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান, মিউজিক ভিডিও, পর্নোগ্রাফি কিশোর ও যুবকদের খারাপ কাজে উদ্দীপনা তৈরির পাশাপাশি অনুকরণে উৎসাহ দেয়। ফলে বড় বড় অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি যুবসমাজ বিপথগামী হওয়ার কারণ| কারণ, প্রযুক্তির এ অপব্যবহার তাদের ব্র্যান্ড, ইমেজ, ও গ্ল্যামারের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি করে। ফলে এটির অনুকরণে যুবসমাজ ভালোমন্দের পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে না। ইন্টারনেট, ইউটিউব, ভাইবার, পর্নোগ্রাফি আসক্তিতে উন্নত দেশগুলোর প্রায় ৬২ শতাংশ যুবসমাজ (১২-১৬ বছর) যৌন হয়রানি ও ধর্ষণসহ বড় বড় অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া পর্নোগ্রাফিসহ আরো অন্য প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বাংলাদেশের যুবসমাজকেও অবক্ষয় ও নানাবিধ বিশৃঙ্খলাও গ্রাস করবে।

বর্তমানে পৃথিবীর ৪৪.২ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। ধারণা করা হয়, ২০১৭ সালের শেষ নাগাদ পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক লোক ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় আসবে। বিটিআরসির হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১৬ সালের আগস্টে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় সোয়া চার কোটি। ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা তিন কোটি ছাড়িয়েছে। প্রতি ১২ সেকেন্ডে একটি করে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলা হচ্ছে, যেটা বাংলাদেশের জন্মহারের চেয়েও বেশি। অন্য এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ইন্টারনেট তথ্যভা-ারের প্রায় ২৫ শতাংশই পর্নোগ্রাফি। বর্তমানে ইন্টারনেটে মোট ২০ কোটির অধিক ওয়েবসাইটের মধ্যে পাঁচ কোটি পর্নোগ্রাফি ওয়েবসাইট রয়েছে। এই ভয়ংকর থাবার বিস্তার থেকে আমাদের তরুণ সমাজের মুক্তি এখন রীতিমতো চ্যালেঞ্জ। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে খ্যাত ওয়েবসাইটগুলো দেশের তরুণ সমাজকে অন্ধকারের দিকেই ধাবিত করছে।

অবাধ তথ্য প্রযুক্তির যুগে কিশোর, তরুণ ও যুব সমাজের বড় একটি অংশ আশঙ্কাজনকভাবে জড়িয়ে পড়ছে নানা সাইবার ক্রাইমে। সাইবার ক্রাইম থেকে পরবর্তীতে ঘটছে নানা ধরনের বড় বড় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, অনেক উচ্চ ও মধ্যবিত্তের সন্তান অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেও কিশোর অপরাধীদের সিংগভাগই হচ্ছে দরিদ্র পরিবারের সন্তান।

অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা অপরাধের সাথে যুক্ত হয় পেটের দায়ে। কিন্ত মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা সঙ্গদোষ, লোভ ও অভিভাবকের সঠিক পরিচর্যার অভাবে এবং উচ্চবিত্তের সন্তানরা সার্বিক পরিচর্যা ও যথাযথ নজরদারির অনুপস্থিতি এবং আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে নানা অপরাধের সাথে যুক্ত হয়। সন্ত্রাসী গডফাদাররা সোশ্যালমিডিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে কিশোরদের দ্বারাই মূলত বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ সংঘটিত করছে আর এসব অপরাধী বেপরোয়াভাবে হত্যা, অপহরণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে প্রতিদিনই বিভিন্ন অপরাধে অংশ নিচ্ছে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের ভয়ংকর সন্ত্রাসীরা এদের নিয়ন্ত্রণ করছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এদের গ্রেফতার করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে দু’একদল ধরা পড়লেও অধিকাংশই থেকে যাচ্ছে ধরা-ছোয়ার বাইরে। আর এসব কিশোর অপরাধীর সন্ত্রাসী গডফাদারদের তো কেশাগ্র স্পর্শ করা যায় না। তাঁরা সব সময়ই থাকেন নিরাপদে। একথা স্বীকার না করার উপায় নেই যে, সামাজিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে শিশু-কিশোররা সন্ত্রাসী গডফাদারদের স্বার্থের গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।


তাছাড়া সমাজ পরিচালনা শক্তির অসহযোগিতা, উদাসীনতা এবং নিষ্ক্রিয়তা, দারিদ্রের বিস্তার, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব ও হতাশা প্রভৃতি শিশু-কিশোরদের অপরাধের পথে ঠেলে দিচ্ছে। বিশেষ করে এখনো সন্ত্রাসী গডফাদারদের দ্বারা বিভিন্ন অবৈধ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে টোকাই জাতীয় শিশু কিশোররা। মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের শিশু-কিশোরদের একটি অংশও অবৈধ প্রলোভন, সঙ্গদোষসহ নানা কারণে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে। যথাযথ নিয়ন্ত্রণের অভাবে এরা জড়িয়ে পড়ছে মারাত্মক সব অপরাধের সঙ্গে, এরা গুলি করে হত্যা, জবাই করে হত্যাসহ হেরোইন, চোরাচালান, গ্রাহকদের কাছে মাদক পৌঁছে দেয়া, ছিনতাই, অবৈধ অস্ত্র-গুলি-বিস্ফোরক পরিবহনে ব্যবহৃত হচ্ছে।

সন্ত্রাসী দুষ্টচক্র বিশেষ করে গডফাদাররা সোশ্যালমিডিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজের দারিদ্র-পীড়িত শিশু-কিশোরদের বিভিন্ন সমাজবিরোধী কাজে ব্যবহার করছে নানা প্রলোভনে, নানা কৌশলে। ইদানিং অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি এবং গামছা পার্টিসহ বিভিন্ন ছিনতাই ও কিলার চক্রও নাকি শিশু-কিশোর অপরাধীদের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করছে। এটি নিশ্চয়ই একটি চরম উদ্বেগকর খবর। আবার অন্যদিকে দেশের আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে সাইবার ক্যাফে, সিনেমা হল, মেমোরী লোডিং পয়েন্ট ইত্যাদি। যেগুলো দ্বারা সুষ্ঠু বিনোদনতো দূরের কথা বরং যুব সমাজ প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে পতিত হচ্ছে। ফলে বর্তমান যুগ সাইবার সংস্কৃতি, হেডফোন সংস্কৃতি, চ্যাটিং-ড্যাটিং সংস্কৃতি ও ব্লু লোডিং সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।

সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে নিন্মেক্ত প্রদপেক্ষগুলো গ্রহণ করতে হওব, যেহেতু সাইবার ক্রাইম এটি একটি আর্ন্তজাতিক সমস্যা। এ সমস্যা প্রতিরোধের জন্য জাতিসংঘের ত্তত্ত্বাবধানে একটি আলাদা কমিশন গঠন করে প্রদক্ষেপ নিতে হবে; প্রতিরোধের জন্য সর্বপ্রথম অ্যান্টিভাইরাস কোম্পানীগুলোকে আর্ন্তজাতিকভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। কারণ তাদের পৃষ্টপোষকতায় এসব হচ্ছে। তাই তাদের দমন করলে সাইবার অপরাধ অনেকাংশে কমে যাবে; সাইবার অপরাধ দমনের জন্য যুগোপযোগী আইন ও নীতিমালা প্রয়োজন।

প্রয়োজন সাইবার বা ভার্চুয়াল পুলিশ গঠনের এবং দেশব্যাপী কঠোর মনিটনিংয়ের। হ্যাকিংয়কে অপরাধ হিসাবে ঘোষণা দিয়ে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে; পর্ণো সাইট সমূহ কে একেবারেই বন্ধ করে দিতে হবে। পর্ণোসইট তৈরি কারকদের কঠোর আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। বন্ধ করে দিতে হবে সংশিষ্ট ওয়েবসাইটগুলোর আইপি এড্রেস। যাতে ব্যবহারকারী তা ব্যবহার করতে না পারে; দেশের সাইবার ক্যাফেগুলোকে একটি সুনিদিষ্ট নীতিমালার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ব্যবহার কারীর নাম ঠিকানা ও পরিচয় পত্র এন্ট্রি করে রাখতে হবে। আলাদা পাটিশন বন্ধ করে দিয়ে উন্মুক্ত স্থানে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এছাড়া পুলিশের নজরদারী বাড়ানো, সাইবার ক্যাফেসহ সকল পর্যায়ে এডাল্ট ফিল্টার বা পর্ণো প্রতিরোধক সফটওয়্যার বাধ্যতামূলক করতে হবে।

সর্বোপরি গুজবে কান না দিয়ে যৌক্তিক আচরণ করলে এবং লোভ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে সাইবার জগতে প্রতারণার হাত থেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিরাপদ থাকা সম্ভব হবে পাশাপাশি নৈতিকতার বিন্তার ঘটাতে হবে, কারণ নৈতিক অধঃপতনের কারণে মানুষ মূলত নানা অপরাধ মূলক কর্মতৎপতায় জড়িয়ে পড়ে। তাই কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে অবশ্যই এসব বিষয়ে নজর দিতে হবে। দারিদ্র্য-বিমোচন, বেকারত্ব দূরীকরণ, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ উজ্জীবিত করা, শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়াসহ নানা সুচিন্তিত কর্মসূচি নিলে কিশোর অপরাধ প্রবণতা বহুলাংশে কমে যাবে। তবে প্রধানত যুব সমাজের নৈতিক অবক্ষয় ও কিশোর অপরাধ বৃদ্ধিতে সবচেয়ে অগ্রণী দায়বদ্ধতা হলো তাঁদের অভিভাবকদের।

তাছাড়া ব্লু সাইট ব্রাউজের অভয়ারণ্য, সাইবার ক্যাফেগুলোও কিশোর অপরাধের অন্যতম হোতা। ডিজিটাল যুগের সন্তানের দোহাই দিয়ে তাঁদের অবাধ চলাফেরা, অবাধ ব্রাউজিং চ্যাটিং-ডেটিং ইত্যাদির উপর হস্তক্ষেপ না করলে অভিভাবকদের পাশাপাশি জাতি ও দেশ প্রচুর ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ খুব শক্তিই হলো একটি দেশের মূল চালিকাশক্তি। তথ্য প্রযুক্তির যুগে ইন্টারনেট ব্যবহার করা জরুরী। তবে অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে তার আদরের সন্তান কোন কোন সাইট ব্রাউজ করছে। সাথে সাথে সে কোথায় যাচ্ছে, মূল্যবান সময় কোথায় ব্যয় করছে, কি করছে, কখন ফিরছে ইত্যাদির প্রতি কড়া নজর দিতে হবে। অভিভাবকদের শিশুকাল থেকে সন্তানদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা এবং সুষ্ঠু বিনোদনে অভ্যস্ত করতে হবে। নতুনত্বের প্রতি তরুণ সমাজের আসক্তি, সামাজিকভাবে সচেতনতার অভাব, পরিবারের উদাসীনতা, ধর্মীয় অনুশাসনের বাইরে জীবনযাপন, সুফল-কুফল বিচার বিবেচনা না করেই প্রযুক্তির ব্যবহার, সঙ্গ দোষ, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবই মূলত সাইবার ক্রাইম সংঘটনের মূল কারণ।

ইতিমধ্যে দেশের প্রতিটি জেলার ডিসি, এসপি, ইউএনও এসি (ল্যান্ড) এবং ওসিসহ অন্যান্য কর্মকর্তার প্রায় সবাই যুক্ত হয়েছেন ফেসবুকে। সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার ও অপরাধ ঠেকাতে ইতিমধ্যে ‘সাইবার নিরাপত্তা হেল্পলাইন’ চালু করা হয়েছে। সপ্তাহের সাত দিন সাইবার নিরাপত্তা (০১৭৬৬৬৭৮৮৮৮) হেল্পলাইনে ২৪ ঘণ্টা ফোন করে সাইবার সংশ্লিষ্ট হয়রানির অভিযোগ করা যাবে। এছাড়া সাইবার ক্রাইম সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে প্রত্যেক জেলায় ‘সাইবার ক্রাইম কন্ট্রোল কমিটি’ গঠন করা হচ্ছে। অপরদিকে সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত সব অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করতে প্রতিটি থানাকে পুলিশ সদর দফতর থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া সরকার বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি)-এর মাধ্যমে ‘লেভারেজিং গ্রোথ, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড গভর্নেন্স (এলআইসিটি) প্রকল্পের’ আওতায় সাইবার নিরাপত্তায় প্রশিক্ষিত দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে উন্নত প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছে, যা ইতিবাচক বলে মনে করি।

আমাদের প্রিয় মাতৃভুমি বাংলাদেশকে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের অস্তিত্ত্বকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেওয়ার আগেই আমাদের দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দেশ ও তথা সমাজ থেকে সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে সমস্যা সমাধানে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ও তার দ্রুত বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উল্লেখিত সমাধান গুলো দ্রুত বাস্তবায়নে সচেষ্ট হতে হবে।

লেখক : মো. আতিকুর রহমান, কলাম লেখক