কক্সবাজার প্রতিনিধি : নৌকায় নাফ নদী পার হতে গিয়ে রোহিঙ্গা নারী-শিশুর লাশের মিছিল কেবলই দীর্ঘ হচ্ছিল। এ কারণে শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তে যে কোনো ধরনের নৌকা নামায় এখন প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা চলছে। ফলে ক্ষুধার তাড়না এবং মানসিক নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ৫২ রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও পুরুষ বাঁশ ও জারিকেনের ভেলায় চড়ে বুধবার সকালে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশে করেছে।

কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে আসা সকলে মিয়ানমারের বুচিদং (বুথেডং) এলাকার বাসিন্দা। ভোর ৪টার দিকে তারা মিয়ানমারের ধংখালীর চর থেকে বাংলাদেশের পথে রওনা দেন। এদের মধ্যে মাঝে ২২ শিশু, ১৭ নারী ও ১৩ জন পুরুষ রয়েছে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর নিপীড়নের পর টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত দিয়ে নৌকায় পার হতে গিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় ২৮টি নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রায় দুইশ নারী-শিশুর সলিল সমাধি হয়েছে। তাই নাফ নদীতে এখন সব ধরনের নৌকা নামানো নিষেধ করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।

এরপরও জীবন বাঁচাতে ঝুঁকি নিয়ে ভেলায় চড়ে এপারে আসাদের মানবিক সহায়তা দিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠানোর জন্য এক জায়গায় জড়ো করে রাখে বিজিবি সদস্যরা।

টেকনাফ বিজিবি-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম জানান, বুধবার সকালে নারী ও শিশুসহ ৫২ জন মিয়ানমার নাগরিক ভেসে নাফ নদী দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে- এমন সংবাদে বিজিবির একটি দল সেখানে উপস্থিত হয়। পরে তাদের উদ্ধার করে একে একে সবাইকে তল্লাশি করে শাহপরীর দ্বীপের জালিয়া পাড়ায় রাখা হয়।

ভেলায় ভেসে আসা বৃদ্ধ আনর আলী জানান, তার বাড়ি মিয়ানমার বুচিদং হাইন পাড়া গ্রামে। এখন গোলাগুলি বন্ধ হলেও মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের গ্রাম এখনও ঘিরে রেখেছে। ঘর থেকে বের হয়ে খাবার সংগ্রহ করার মতো পরিস্থিতি না থাকায় অর্ধাহার-অনাহারে দিন পার করছিলেন তারা। আবার পাকা ধানগুলোও কেটে নিচ্ছে সেনাবাহনী-বিজিপি। তাই নিরুপায় হয়ে ঝুঁকি জেনেও নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে আসাতে বাধ্য হয়েছেন।

তিনি আরও জানান, গত ১০ দিন আগে একই গ্রামের প্রায় শতাধিক লোক মিয়ানমার সীমান্তে ধংখালি চর নামক এলাকায় অবস্থান নেন। পরে নৌকায় করে এপারে আসার অপেক্ষায় ছিলেন তারা। কিন্তু নৌকা না পেয়ে তারা প্লাস্টিকের জারিকেন ও বাঁশের সমন্বয়ে ভেলা তৈরি করে। পরে বুধবার ভোররাতে ওই ভেলাতে ৫২ জন উঠে রওনা দেন। প্রায় ৬-৭ ঘণ্টা পর তারা টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তে এসে পৌঁছে। পরে বিজিবির সদস্যরা তাদের উদ্ধার করে কিছু শুকনো খাবার হাতে তুলে দেন।

মোহাম্মদ নুর (৪০) নামে আরেক রোহিঙ্গা জানান, গত এক মাস আগে তার বড় ভাই নুরুল আলমকে সেনাবহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। এরপর থেকে সন্তানদের নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সেনাবাহিনী ও রাখাইনরা যেসব গ্রামে এখনো রোহিঙ্গা অবস্থান করছে তাদেরকে বর্মী ভাষায় লেখা ‘বাঙালি কার্ড’ নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। কেউ তা নিতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করছেন। এ কারণে রোহিঙ্গারা এখনও বাংলাদেশে প্রবেশ অব্যহত রেখেছে।

তিনি আরও জানান, ধংখালী চরে বর্তমানে হাজারের ওপরে লোকজন রয়েছে। তারা নৌকা না পাওয়ার কারণে এপারে আসতে পারছে না।

টেকনাফ বিজিবি-২ ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম বলেন, ভেলায় আসা রোহিঙ্গাদের বিকেলে বালুখালী ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে। এর আগেও প্রায় অর্ধশতাধিকের বেশি রোহিঙ্গা পুরুষ জারিকেন নিয়ে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল। এবারই জারিকেন ও বাঁশের সহায়তায় নারী-শিশুর ঝুঁকিপূর্ণ পারাপার দেখলাম। এটি উদ্বেগজনক।

(ওএস/এসপি/নভেম্বর ০৮, ২০১৭)