মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) : দশ বছর অতিবাহিত হলেও সিডর বিধ্বস্ত পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ভাঙ্গনকবলিত রামনাবাদ নদের মোহনা ঘেষা লালুয়া ইউনিয়নের সাতটি গ্রামের মানুষের রিাপত্তায় নেয়া হয়নি কোন পদক্ষেপ। যুগযুগ ধরে ঝড়, জলোচ্ছাসে সর্বস্ব হারাচ্ছে এখানকার মানুষ।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে যুদ্ধ করতে করতে এ গ্রামগুলোর ১০ সহস্রাধিক মানুষ আজ নিঃস্ব। ঝড়,জলোচ্ছাস হলেই নিশ্চিত মৃত্যু এমন আশংকায় থাকলেও তাদের নিরাপত্তায় আজও নির্মাণ হয়নি একটি আশ্রয়কেন্দ্র। কলাপাড়ার লালুয়া ইউনিয়নের চৌধুরীপাড়া, ছোট পাঁচনং, হাসনাপাড়া, নাওয়াপাড়া, ধনজুপাড়া, এগার নং হাওলা এবং মুন্সীপাড়া গ্রামে কোন আশ্রয়কেন্দ্র নেই।

এ গ্রামগুলো ঘুরে দেখাযায়, চারিদিকে শুধুই ধংসের চিহ্ন। মাঠে ফসল নেই। বাড়ির পুকুরে নদীর জোয়ার ভাটার ওঠানামা করছে। প্রায় প্রতিটি বাড়ির চারপাশে স্যাঁসস্যাঁতে কর্দমাক্ত। একটি মাটির রাস্তাও অক্ষত নেই। বেড়িবাঁধ গুলো ভেঙ্গে যাওয়ায় এক গ্রামের সাথে অন্য গ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। দিনমজুর ও মাছধারা পেশায় নিয়োজিত হতদরিদ্র এ আটটি গ্রামের মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্য নাওয়াপাড়া গ্রামে ৪০ বছর আগে পাঁচ একর জমির উপর একটি মাটির কিল্লা নির্মান হলেও তা এখন পরিত্যক্ত প্রায়। এ মাটির কিল্লায় ওঠার নেই কোন রাস্তা। খাল সাঁতরিয়ে দূর্যোগের সময় এ মাটির কিল্লায় মানুষ আশ্রয় নিতে হয়।

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্নিঝড় সিডরের সময় এ কিল্লায় আশ্রয় নিতে গিয়ে নাওয়াপাড়া গ্রামের শেরআলী বয়াতী (৭০) এক বৃদ্ধ পানিতে ডুবে মারা গেছে। আহত হয়েছে শতাধিক মানুষ। নাওয়াপাড়া গ্রাম থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে বানাতিপাড়া আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে গাছচাপা পড়ে পঙ্গুত্ব বরন করতে হয়েছে এ গ্রামের মোখলেছ(৪০)কে। একই ভাবে আয়লা’র তান্ডবে এ গ্রামগুলো নিশ্চিহ্ন
হয়ে যায়। এ গ্রাম গুলোর প্রটেকশন বেড়িবাঁধ একাধিক স্থান থেকে ভেঙ্গে যাওয়ায় এ অবস্থা সৃষ্ঠি হয়েছে।

নাওয়াপাড়া গ্রামের মাটির কিল্লায় এখন স্থায়ী ভাবে কয়েকটি পরিবার নতুন করে ঘর বেঁধেছে। একসময় এসব পরিবারের গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, চাষের জমি থাকলেও তারা আজ সর্বস্বহারা। গত সিডরের পর থেকে এ মাটির কিল্লাই তাদের বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয়।

নাওয়াপাড়ার খালেদা বেগম (৪৫)বলেন, মোর বিধবা মাইয়া ও এক নাতনী লইয়া এ্যাহন এইহানেই থাহি। দূরে রামনাবাদ নদ দেখিয়ে বলেন, ওই নদীর মাঝখানে আমাগো ঘর ছিল। মোর যহন বিয়া হয় তহন মোগে সব ছিলো। কিন্তু গত এক যুগে সর্বনাশা নদী মোগো সব গিইল্লা খাইছে।

তিনি বলেন, এ কিল্লায় ওডার রাস্তা নাই। যহন জোয়ার থাহে তহন আর কিল্লা দিয়া নামা যায়না। হগল দিক পানিতে ডুইব্বা থাহে। ঝর, বৃষ্টি হইলে মানুস এইহানে আইতে পারেনা।

রুবেল বয়াতী (৩৮) বলেন, সিডরের সময় এই কিল্লায় আইতে যাইয়া মোর বাবা শেরআলী বয়াতী(৭০) মরছে। কতো মানুষ যে এইহানে আইতে যাইয়া পানিতে ভাইস্যা গেছে কইতে পারমুনা।

এ গ্রামের ঝরনা বেগম জানায়, মোগো সাত গ্রামেও একটা আশ্রয়কেন্দ্র নাই। ঝড় হইলে এই কিল্লা ছাড়া আর কোন উপায় নাই। হ্যাওতো মাডির রগে মিইশ্যা যাওয়ার পথে। এইহানে কোন ঘর না থাহায় ঝড়, বর্ষায় হারারাইত পোলা-মাইয়া লইয়া ভিজতে হয়।

এ সাতটি গ্রামের দশ সহস্রাধিক মানুষকে ঝড়, জলোচ্ছাসের সময় আশ্রয় জীবন বাঁচাতে রহিমুদ্দিন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, বানাতিবাজার ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় , চাড়িপাড়া রেজিষ্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঘূর্নিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র হচ্ছে এখন একমাত্র ভরসা। যা ওই সাতটি গ্রাম থেকে ৪/৫ কিলোমিটার দূরে। এ কারণে ঝড় হলে এ গ্রামগুলোর মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এ গ্রামের স্কুল পড়ুয়া একাধিক ছাত্র-ছাত্রী জানায়, হগল গ্রামে স্কুল থাকলেও মোগে গ্রামে স্কুল নাই। যদি স্কুল থাকতো তাইলে ঝড়ের সময় আমরা স্কুলে যাইয়া ওঠতে পারতাম। বই খাতা বাচাইতে পারতাম। মোগে ক্ষতি হইতো না।

চৗধুরীপাড়া, ছোট পাঁচনং, হাসনাপাড়া, নাওয়াপাড়া, ধনজুপাড়া, এগার নং হাওলা এবং মুন্সীপাড়া গ্রামের শতশত মানুষ জানায়, সিডরের পর থেকে এ গ্রামের মাঝামাঝি একটি আশ্রয় কেন্দ্র বানানোর জন্য আবেদন করলেও তাদের আর্তি কারও কাছে পৌছেনি। এ কারনে সব ঝড়,বৃষ্টিতে এ গ্রামগুলোর মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

লালুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মীর তারিকুজ্জামান তারা জানান, আশ্রয় কেন্দ্র না থাকায় লালুয়ার সাত গ্রামের মানুষের দূর্ভোগের শেষ নেই। জরুরী ভিত্তিতে এখানে আশ্রয় কেন্দ্র দরকার।


(এমকেআর/এসপি/নভেম্বর ১১, ২০১৭)