প্রবীর বিকাশ সরকার : দীর্ঘদিন ধরেই একটা প্রশ্ন মাথার মধ্যে পীড়াদায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে আর সেটা হল: আওয়ামী লীগ জাপান শাখার ভবিষ্যৎ কী? এবার প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর জাপান সফরের মধ্য দিয়ে জাপান আওয়ামী লীগ শাখার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে গেছে বলে অনেকেই বলাবলি করছেন। বালাই ষাট!

বালাই ষাট নয়। আসলে বাস্তবতা তাই। শরীর যেমন খাদ্যদ্বারা বেঁচে থাকে, প্রবৃদ্ধি ঘটে সংগঠনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আওয়ামী লীগ জাপান শাখা তার জন্মলগ্ন থেকেই সরস অক্সিজেন এবং পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। কথায় বলে বৃক্ষের পরিচয় ফলে---আওয়ামী লীগ জাপান শাখার কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ বা কর্মকাণ্ড নেই যার দ্বারা প্রমাণ করা যায় জাপানে এই সংগঠনটি ক্রিয়াশীল। বরং বলা যায় এটা জন্মলগ্ন থেকেই পরজীবী বা প্যারাসাইট হয়ে আছে। আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনগুলো কাজ করে আর সেখানে মঞ্চে বসেন আ-লীগের নেতৃবৃন্দ পদাধিকার বলে। যা অসামঞ্জস্যপূর্ণ। হতাশাব্যঞ্জক। অথচ এমনটি হওয়ার কথা তো নয়, বরং প্রধান নেতৃত্ব হিসেবে আওয়ামী লীগই তো পথ দেখাবে বা পথ তৈরি করে দেবে উত্তরণের জন্য অঙ্গ সংগঠনগুলোকে। তাতো হয়নি বিগত ২৪ বছরেও। কেন?

এর জন্য নানাবিধ কারণ বিদ্যমান। প্রথম থেকেই এই সংগঠনের নেতা ও কর্মীদের মধ্যে কর্মপদ নিয়ে রেষারেষি, দ্বন্দ্ব এমনকি মারামারি পর্যন্ত হয়েছে একাধিকবার। কিছুদিন দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। তর্কাতর্কি, হম্বিতম্বি ইত্যাদি নিয়ে হামলাও হয়েছে, পুলিশ এসেছে, মামলা হয়েছে সে এক বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড! এইসব ঘটনা জেনে শুনে কেবল ব্যথিতই হয়েছি। পরামর্শ দিয়েও কোনো সমাধান করতে পারিনি। কে শোনে কার কথা! এই কোন্দলের কারণে সংগঠনটি এগিয়ে যেতে পারেনি। তথাপি বেশ কয়েক বছর সাধারণ সম্পাদক তার চেষ্টাবলে সংগঠনকে ধরে রেখেছিলেন, সভাপতি জাপানেই থাকতেন না ব্যবসা উপলক্ষে বাংলাদেশেই অধিকাংশ সময় কাটাতেন বলে অভিযোগ করতেন সাধারণ সম্পাদকই। ফলে যোগাযোগহীনতাও একটা গুরুতর কারণ ছিল বটে। কিন্তু এটা তো নিজেদের মধ্যে ঘটিত কৃতকর্ম, মানুষ বা শুভাকাঙ্ক্ষীরা তো তা বুঝবে না।

যতক্ষণ জাপানে থেকেছি নেতাদের আহবানে কাজকর্মে সহযোগিতা করেছি। আর এই কাজ প্রচারপত্র তৈরি করে দেয়া, দূতাবাসে ১৫ই আগস্ট উপলক্ষে স্মারকলিপি প্রদান করা সেটাও লিখে দিয়েছি এর বাইরে আর কোনো স্মরণযোগ্য কর্মকাণ্ডের ছবি আমার অন্তরে নেই। অন্তরে যা উজ্জ্বল হয়ে আছে সবই বঙ্গবন্ধু পরিষদের নানা গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডের চিত্রসমূহ। এটা অনস্বীকার্য যে একটি মানুষ ২৪ বছর ধরে বঙ্গবন্ধু পরিষদ জাপান শাখাকে এগিয়ে নিয়ে এসেছেন বহু বাধাবিপত্তি হুমকিধামকি অতিক্রম করে। তিনি শেখ এমদাদ হোসেইন সেই ১৯৯১ সালে চাঁদা দিয়ে পরিষদের সদস্য হয়েছিলেন। তার কোনো মূল্যায়ন করেনি আওয়ামী লীগ জাপান শাখা বা কেন্দ্রিয় বঙ্গবন্ধু পরিষদও। সেটা হওয়া কি উচিত ছিল না? আওয়ামী ঘরানার নেতারা মেহনতি জনতার শ্রমের নামে স্লোগান দেন অথচ প্রকৃত কর্মীদের শ্রমের ও কর্মের মূল্যায়ন করেন না কেন? প্রশ্নটি পক্ষপাতমূলক নয়, কমনসেন্সমূলক।

২০১০ সালের মতো এবারও (২০১৪) বঙ্গবন্ধু পরিষদ জাপান শাখাকে হেয় করা হয়েছে চরমভাবে! যদি নাগরিক সংবর্ধনার মঞ্চে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলোর নেতারা বসতে পারেন তাহলে সবচে আগে জাপানে গঠিত বঙ্গবন্ধু পরিষদ জাপান শাখার (১৯৯০-৯১) বর্তমান সভাপতি যিনি সদস্য থেকে সাধারণ সম্পাদক হয়ে এখন সভাপতির পদে আসীন তাকে কেন আমন্ত্রণ করা হবে না? সমস্যাটা কোথায়? সমস্যাটি ঈর্ষাজনক কিছু? তিনি তো বড় অঙ্কের চাঁদাও প্রদান করে সহযোগিতা করেছেন আয়োজকদের। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু পরিষদের অনেক সদস্যকেই সংবর্ধনা সভায় প্রবেশাধিকার প্রদান করা হয়নি নামের তালিকা দেয়া সত্ত্বেও। কেন তার জবাব অনেকেই জানতে চান আমার মতো কারণ আমরা বঙ্গবন্ধুর আর্দশে বিশ্বাসী এবং নীতির অনুসারী। আর এই স্বাদেশিক কারণেই ১৯৯০ সালে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলাম আমি নিজেই একা তখন সর্বপ্রথম সাড়া দিয়েছিলেন আমিনুল ইসলাম আমীন, ফরহাদ, মানিক, জাকির, আনোয়ার, রতন প্রমুখ প্রবাসী কায়িক শ্রমিকরা। তাদের অধিকাংশ আজ জাপানে নেই। পরে এসেছেন কাজী মাহফুজুল হক লাল, সরদার নাঈম আরও পরে ছালেহ্ মোহাম্মদ আরিফ প্রমুখ। আমরা বন্ধু হয়েছি, একই আর্দশের পথিক বলে বঙ্গবন্ধুর নামে গঠিত এই সংগঠনটির শাখা গঠন করেছি। কিন্তু সঙ্গেসঙ্গে অনীহাও প্রকাশ করেছেন পরিষদ না করার, কারণ তারা সরাসরি রাজনীতি করতে আগ্রহী। ফলে রাতারাতি আওয়ামী লীগ জাপান শাখা গঠিত হল। রাজনীতি করার নামে কী হল তাতো উপরেই বর্ণনা করেছি। এই কী লক্ষ্য ছিল? এই কি প্রতীজ্ঞা ছিল? আমরা শ্রমের, কাজের মূল্যায়ন করব না কেবল দলাদলি করব, অন্যের অনুষ্ঠানে গিয়ে আসন নিয়ে বড় বড় কথা বলব?

একই ঘরানার সদস্য হয়ে কেন বঙ্গবন্ধু পরিষদ জাপানের সভাপতি মঞ্চে বসার যোগ্যতা রাখা সত্ত্বেও আমন্ত্রিত হন না এর কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না। বঙ্গবন্ধু পরিষদ জাপান শাখার একজন সদস্য হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের এই কৃপণতা, অবহেলা, অবজ্ঞা এবং দায়িত্বহীনতা মেনে নিতে পারছি না। আপনারা বলবেন, আমরা বঙ্গবন্ধু পরিষদ জাপান শাখার সভাপতিকে হেয় করিনি, অবজ্ঞা করিনি, তাহলে কে বা কারা করেছে, নিশ্চয়ই কেউ করেছে এর কী একটা বিহীত করবেন না? মানবিক বিচার-বিচেনার একটা উদাহরণ স্থাপন করবেন না? মানুষকে শ্রদ্ধা জানাবেন না? এটা তো হতে পারে না।

সম্মানিত নেত্রীর আগমনের প্রাক্কালে ৮জনের একটি কমিটি গঠন করে সভাসমিতি দেনদরবার করা হয়েছে একাধিকবার সবই আমাদের কানে আসে, আসতে বাধ্য, কিন্তু ফলাফল কী দেখা গেল সংবর্ধনা সভায় ৮জনের ৬জনই মঞ্চের চেয়ার দখল করে নিলেন বাদ দিলেন অন্যতম সদস্য শেখ এমদাদকে। এর চেয়ে সুন্দর আর প্রকাশ্য অবজ্ঞা, অবহেলা আর কী হতে পারে! একে কী কথার বরখেলাপ বললে বেশি বলা হবে?

সম্মানিত নেত্রীকে দেখানোর জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন সবাই একজনকে শুধু বাদ দিয়ে। এটা কি শোভনীয় হয়েছে আ-লীগ নেতৃবৃন্দ? কিন্তু মহামান্য নেত্রী সবই জানেন এবং বোঝেন। জাপানে আওয়ামী ঘরানা কোনোকালেই ঐক্যবদ্ধ ছিল না, তিনি সেটা খুব ভালো করেই জানেন। এবং এবার বিপুল টাকার খেলা চলেছে বলে যে কথা উঠেছে বা গুজব ছড়িয়েছে তাও তাঁর কানে প্রবেশ করেছে বলেই মনে করি। কাজেই আওয়ামী লীগ জাপান শাখার যে দুটি গ্রুপের প্রস্তাবিত কমিটির অনুমোদন আদায়ে লড়াই চলছে তা আর বিজয়ের সম্ভাবনা নেই বলে শোনা যাচ্ছে। তাছাড়া এটাও বোঝা যায় অনায়াসে যে, কাজী লাল ও ছালেহ্ আরিফের কার্যকরী পরিষদটি কাজ না করেই যতটুকু গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল নতুন আর কোনো কমিটি সেটা অর্জন করতে পারবে না। কাজ করারও কোনো সুযোগ নেই। কী কাজই বা করবে? কী কাজ করেছে তারা এই পর্যন্ত যে তার ধারাবাহিকতা থাকবে। সবই তো শূন্য। যা কিছু করেছে তাকে ঠিক কাজ বলা যাবে কি? বড়ই আশ্চর্য হই যে, একটি স্মারক সংকলন আজ পর্যন্ত আ-লীগ জাপান শাখা প্রকাশ করতে পারেনি! এটা কী ভাবা যায়! তাহলে কীভাবে এই সংগঠনটির ইতিহাস লেখা হবে? যারা পদে ছিল তাদেরইবা কী ইতিহাস লেখা হবে? বৃক্ষের মাথায় তো কোনো ফলই দেখা যায়নি কোনোদিন!

জননেত্রী শেখ হাসিনাও আর খুব বেশি দিন রাজনীতি করবেন তাতো নয়, কারণ তাঁরও বয়স হয়েছে। কিন্তু তাঁর কর্মকাণ্ডকে ধরে রাখার জন্য, এগিয়ে রাখার জন্য জাপান আ-লীগের কোনো নেতা কি আছেন সেই মনোভাব দেখাতে পারেন? প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকদের সমস্যা, জাপানি রাজনীতিবিদদের বাংলাদেশের প্রতি আকর্ষণ করা, জাপানি বিনিয়োগের চেষ্টা করা, বিশিষ্ট বঙ্গবন্ধু-ভক্ত, গবেষকদের জাপানে আমন্ত্রিত করে আলোচনাসভার আয়োজন করা, জাপানি বুদ্ধিজীবী সমাজে বঙ্গবন্ধুর নাম তুলে ধরা, বিশেষ দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠানাদি করা, স্মারক প্রকাশনা করা ইত্যাদি কত কাজই তো করার ছিল সেসব সম্পাদন করা সম্ভবও ছিল এই জাপানে হয়নি কেন? অথচ এসবের অধিকাংশ কাজই সম্পাদন করেছেন একটি মানুষ শেখ এমদাদ হোসেইন বঙ্গবন্ধু পরিষদ জাপান শাখার সভাপতি। রাষ্ট্রদূতের বাইরে তিনি দুরাষ্ট্রের মধ্যে দূতালির কাজও করে চলেছেন দীর্ঘদিন ধরে। এইসব কাজের স্বীকৃতি আশা করতেই পারেন। কিন্তু তিনি প্রচারমুখী নন। কাজের লোক কাজ করে যাচ্ছেন একনিষ্ঠভাবে। কিন্তু কেন তাকেে এসব কাজ একা করতে হবে? কেন তাকে সহযোগিতা করা যাবে না? এসবের উত্তর দিতে পারবেন না জা-আ-লীগ নেতৃবৃন্দ।

একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগছে: এরপর কোথায় যাবে আওয়ামী লীগ জাপান শাখা? কোন্ গন্তব্যে? কী উপলক্ষে? এর উত্তর একমাত্র তারাই দিতে পারবেন আমরা যারা শুভাকাঙ্খী এর উত্তর বাস্তবিকই জানা নেই। কিন্তু এতদিনের পুরনো সংগঠনটি এখানে থেমে যাক এটাও কামনা করি না। ভুলভ্রান্তি স্বীকার করে, ভেদবিভেদ ভুলে, সমবায়িক মনোভাব নিয়ে জাপানে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সকল কর্মী, সমর্থক, শুভাকাঙ্ক্ষীদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে সুদূরপ্রসারী ফলপ্রসূ কাজ করার উদ্যোগ নেবেন নেতৃবৃন্দ এই প্রত্যাশা করি। স্মরণে রাখলে সুখী হব যে, এই লেখাটি কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য আদৌ লিখিত হয়নি।

লেখক : জাপানপ্রবাসী

(এএস/জুলাই ০২, ২০১৪)