প্রবীর বিকাশ সরকার : [ভূমিকা : আমার ৫৫ বছরের জীবনে বাবার সঙ্গে কেটেছে মাত্র ২৪-২৫টি বছর! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যেভাবে বাবাকে দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি এবং বুঝেছি তার মূল্যায়নই হচ্ছে এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বা স্মৃতিকথা ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’---এমন করে খোলামেলা খুঁটিনাটি কোনো স্মৃতিকথা আর কোনো বাঙালি লিখেছেন তার জন্মদাতা পিতৃদেবকে নিয়ে আমার অন্তত জানা নেই।]

এর মধ্যে বড়জেঠু এসে গ্রামে নিয়ে গেল কয়েক দিনের জন্য আমাকে। তখন শরৎকাল। সেকি অপূর্ব শারদীয় দৃশ্য ও পরিবেশ গ্রামের! এই সময় থেকেই আমার মনের মধ্যে একটা কবি কবি উদাস ভাব অঙ্কুরিত হচ্ছিল। কুমিল্লার ছোটরাস্থ বাড়ির পূবদিকে বিহারিকলোনী। রাস্তার দুপাশে টানা বেড়ার তৈরি টিনের দীর্ঘ চালাঘর, খোপ খোপ অসংখ্য কক্ষগুলোতে ভারত থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা বিহারিদের বসবাস। দু-এক ঘর পাঠানও ছিল। রিক্সা চালানো, ঠোঙা তৈরি, মুদির দোকান, ধুনকর, চানাচুর বিক্রি, মুচিগিরি, পানসুপারির দোকান, রাজমিস্ত্রী, ইলেকট্রিশিয়ান, রেডিও-ঘড়ি মেরামত, কুলি-মুটের কাজ ছিল প্রধান জীবিকা এইসব হতদরিদ্র মানুষগুলোর। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, পানীয় জলের সঙ্কট, অসুখবিসুখ-মহামারি, মারামারি-ঝগড়া, চুরিচামারি এবং কাচা লেট্রিনের দুর্গন্ধ ইত্যাদির কারণে ভদ্রমানুষ এদিকে আসতোই না। কাচা লেট্রিনের মলমূত্র সারা বছরই একটি খাল দিয়ে আমাদের বাড়ির পেছন দিয়ে বয়ে যেতো গোমতী নদী পর্যন্ত। বর্ষায় মোটামুটি পরিষ্কার থাকত খাল, কিন্তু শুষ্কমৌসুমে মাঝেমাঝে অসহনীয় দুর্গন্ধ এসে নাকে লাগত! আমাদের ছিল একটি কমন কাচা লেট্রিন। বিহারিদের একটি শুধু সুবিধে ছিল স্নান ও ধোয়াপাকলার জন্য কলোনীপুকুর ব্যবহার করা। এই পুকুরটির মালিক ছিলেন কুমিল্লা শহরের রূপকথা, লিবার্টি সিনেমা হলসহ অনেক জায়গাসম্পত্তির কর্ণধার মধ্যপ্রদেশ থেকে আসা মারোয়াড়ি ব্যবসায়ী শ্যামলাল ক্ষেত্রী পরিবার। পাক-ভারত যুদ্ধের পর ভারতে চলে গেলে পরে আর ফিরে আসেনি তারা কেউ। ফলে সবগুলো জায়গা শত্রুসম্পত্তিতে পরিণত হয়। এই কলোনীর রাস্তা গিয়ে মিশেছে গ্রান্ড চিটাগং রোডের সঙ্গে। আর এই রোডের ওপারস্থ সদর পুলিশ কোর্টই বাবার অফিস। যেটা এখন ডিসির অফিস হিসেবে পরিচিত। বাসা থেকে এই পথেই অফিস পর্যন্ত মাত্র ১৫ মিনিট লাগতো বাবার। অবশ্য এই রাস্তা ছাড়া আর কোনো রাস্তা ছিল না আমাদের বাড়ি থেকে বেরোবার। বাড়ির মুখেই খাল তার উপর কাঠের ভাঙ্গা সাঁকো পার হয়ে কলোনীর উঁচু পথে গিয়ে উঠতে হতো। পুরো বর্ষাকাল এই সাঁকো থাকতো জল ছুঁই ছুঁই হয়ে। বেশি বৃষ্টি হলে পরে জল না নামা পর্যন্ত হাঁটুর উপর কাপড় তুলে পারাপার করতে হতো। বাবাকে রাবারের লং বুট পরে যাতায়াত করতে দেখেছি।

বিহারিদের জন্য যেমন ছিল কলোনীপুকুর তেমনি আমাদের জন্য ছিল পাইক পুকুর। বহুপ্রাচীন এই পুকুরের এর মালিক ছিলেন বিশাল গোঁফ’ওলা মোর্তুজ আলী, এক রগচটা মানুষ। গভীর কালো জলের বেশ বড় একটি পুকুর। অফুরন্ত মাছ ছিল এই পুকুরে! বর্ষায় জল একেবারে ঘরের উঠোনের কাছাকাছি চলে আসতো। উঠোনের পূর্বদিকে ছিল আমাদের থাকার ঘর আর পশ্চিমদিকে রান্নাঘর। পুকুরের মূল পাড় থেকে ৯/১০ হাত পর্যন্ত জল উঠে আসতো। বর্ষায় কত মাছ যে ধরেছি বড়শি ফেলে সকাল, দুপুর আর সন্ধ্যায় তার হিসেব ছিল না! পুকুরের চারপাশের বাসাবাড়ির সবাই মাছ ধরতো। মাঝেমাঝে মালিক কর্তৃপক্ষের কেউ দেখে ফেললে গালাগাল করতো। বাবার সঙ্গে মোর্তুজ আলীর খুব ভালো ভাব ছিল যে কারণে অনেকটা নির্বিঘ্নেই মাছ ধরতে পেরেছি আমি। বাবাও মাঝে মাঝে সঙ্গ দিয়েছে। তাছাড়া যখন মাঝেমাঝে জাল ফেলে মাছ ধরা হতো তখন নির্ভুলভাবেই বড় রুই বা কাতলমাছ একটা উপহার হিসেবে পেতাম আমরা বাবার কল্যাণেই। কেননা পুলিশ কোর্টের ‘বাবু’ বলে কথা! পুলিশি ঝামেলা হলে তো প্রথমেই বাবুর কাছে যেতে হতো। ছোটখাটো অভিযোগ কিংবা মামলার ব্যাপারে বাবা বরাবরই ছিল উদার।

বর্ষায় উপচেওঠা পুকুরের জল নির্গমনের পথ ছিল দুটি। একটি উঠোনের পূর্বদক্ষিণ কোণে অন্যটি পূর্বউত্তর কোণে অর্থাৎ আমাদের ঘরের পাশ দিয়ে। চাঁই পেতে কত মাছ যে ধরেছি তা বলার মতো নয়! যেদিন প্রচন্ড বৃষ্টি হতো বাড়ির পুরুষ ও ছেলেমেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পড়তাম উঠোনে। হাঁটু পর্যন্ত থই থই করা ঘোলাজল। পলো দিয়ে, ত্রিকোণী জাল দিয়ে, হাতড়িয়ে মাছ ধরেছি। বাবাও উৎসাহ দিয়েছে এই মাঝরাতের মৎস্যশিকার উৎসবে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও ছিল বলে তো মনে হয় না।

১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের প্রারম্ভে একদিন ভোরবেলা উঠে দেখলাম আশ্চর্য এক ঘটনা! পশ্চিম দিকের দুটি ঘর খালি। তালা দেয়া। ভানুমামার মেয়ে সমসবয়সী অঞ্জনা, ছোট ছেলে গৌতম, বেটেখাটো সদা ঝগড়াটে মামী এবং মোটা করে সারাদিনই বিড়বিড়করা ঠাকুমা কেউ নেই! এমনকি চায়নামাসিও নেই! লক্ষ্মী মাসিকে জিজ্ঞেস করতে চোখের জল লুকিয়ে বললো, ‘গ্রামের বাড়িতে গেছে, শীগ্গিরই ফিরে আসবে।’ কিন্তু এক মাস চলে যাওয়ার পরও আর তারা ফিরে এলো না। উত্তর দিকের বড় ঘরটিতে ছিল একটি পরিবার বহু বছর, সন্ধ্যা নামে একটি মেয়ে আমারই সমবয়সী, যার হাতে থাকতো সারাক্ষণ বই আর বই। বইপড়ুয়া আমার বাবা সন্ধ্যাকে খুব স্নেহ করতো মূলত বইপাঠের কারণেই। তারাও চলে গেল আমরা যখন পুলিশ লাইনে ছিলাম তখন। মার সঙ্গে একদিন বেড়াতে এসে দেখি নতুন একটি পরিবার। গৃহকর্তা মণীন্দ্রকুমার দে, দলিল রেজিস্ট্রি অফিসের মুহুরি, খুবই শান্তশিষ্ট সাদাসিধে মানুষ। তিনি সর্বক্ষণ ধুতি আর ফতুয়া পরে থাকতেন। তার ছেলে দীপক ছিল সমবয়সী পরে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়েছিল দুজনের মধ্যে। এখনো কুমিল্লায় গেলে দেখাসাক্ষাৎ হয়।

একদিন বাবাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে বললো, ‘ভানুবাবু সপরিবারে আগরতলায় বাড়ি বানিয়ে চলে গেছে। এই বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে স্থানীয় ব্যবসায়ী ঈমান আলীর কাছে।’ রাগতস্বরে আরও বললো, ‘যে দেশ ছেড়ে যায় তার মতো অভাগা আর নেই! অত ভয় পেলে কি চলে! কীসের ভয়ে হিন্দুরা দেশত্যাগ করছে জানি না। দেশপ্রেম নেই কারো। এই দেশে জন্মেছি এই দেশেই মরবো এটাই আমার শেষ কথা।’ বাবা তাঁর কথা রেখেছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়। পাক-ভারত যুদ্ধ যখন বাঁধলো তখন হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা লাগার সম্ভাবনা ছিল। অনেক মুসলমান প্রতিবেশীর মুখে উস্কানিমূলক কথাবার্তা, ভারত সম্পর্কে গালিগালাজ, পাকিস্তান যুদ্ধে জিতলে হিন্দুদের কতল করা হবে ইত্যাদি গুজব আমাদের কানে এসেছিল। সেইসময় কুমিল্লায় প্রচুর হিন্দুর বাস! বাবা যাঁদের চিনতেন, জানতেন প্রভাবশালী হিন্দু ধনী ব্যবসায়ী, ডাক্তার, অধ্যাপক, রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কম ছিলেন না। যেমন ব্যবসায়ী রায় ফার্মেসি, সাহা ফার্মেসি, বেঙ্গল স্টোর্স, বিবি রায়, খাদিঘর, এম ভট্টাচার্য অ্যান্ড কোং (দানবীর মহেশ ভট্টাচার্য্যরে প্রতিষ্ঠান), তালুকদার ফার্মেসি (আমার মামার প্রাচীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান), সিংহপ্রেস, ভগবতী পেড়া ভান্ডার, মাতৃভান্ডার, শীতল ভান্ডার, এসি পাল, রাধারানী ম্যানুফ্যাকচারিং এমনি আরও অনেক। রাজনীতিকদের মধ্যে ছিলেন প্রাক্তন মন্ত্রী শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রাক্তন মন্ত্রী কামিনীকুমার দত্ত, মহাবিপ্লবী ও কুমিল্লা পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান অতীন্দ্রমোহন রায়, উকিল যতীন্দ্র ভদ্র, ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাস, ব্যাঙ্কার অখিল দত্ত, সাংবাদিক রজত নন্দী প্রমুখ। কিংবদন্তির হোমিওপ্যাথ ডাক্তার দীনেশচন্দ্র রাউত (আমার দাদুর বন্ধু) ও কিরণ চৌধুরী; এ্যালোপ্যাথ ডা. নিত্যহরি সাহা, ডা. সোহানী, ডা. মহীউদ্দিন, ডা. শামসুল আলম, ডাঃ সুরেশচন্দ্র বসু, ডা. সতীশচন্দ্র দাস প্রমুখ। পুলিশ অফিসার হিসেবে খুবই শ্রদ্ধেয় ছিলেন শহীদ প্রফুল্লকুমার দে, বাবাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন তিনি। তাঁরই ছেলে মোহামেডান দলের প্রখ্যাত ফুটবলার ভানু (মামা)। তখন একটা দুর্দান্ত সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল গড়ে উঠেছিল কুমিল্লা শহরে। এই আবহটা বঙ্গবন্ধুর তিরোধান পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল বলা যায়। তারপর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে দ্রুত ভাঙ্গন, ক্ষয়, অবক্ষয় শুরু হয় নীতি-আদর্শবিবর্জিত রাজনীতির প্রভাবে সারা বাংলাদেশ জুড়েই। ভারত-ভাগের সময় তো বটেই পাক-ভারত যুদ্ধের আগে-পরে এবং ১৯৭১ সালের সময় অনেক বড় বড় এবং প্রভাবশালী হিন্দু পরিবার কুমিল্লা ত্যাগ করে চলে যান। চলবে

আলোকচিত্র : ফৌজদারি কোর্টের ওপাশে বিখ্যাত মফিজাবাদ বিহারিকলোনীর প্রবেশপথ। একই জায়গায় রেজিস্ট্রি বিল্ডিংএর এই জায়গায় একটি মাঠ এখনো আছে যেখানে খেলাধুলা করতাম।

লেখক : জাপানপ্রবাসী

(এএস/জুলাই ০২, ২০১৪)