মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) : পটুয়াখালীর কলাপাড়ার কুয়াকাটার শাহীন মুন্সী (১৯), কাউয়ার চর গ্রামের সুজন মুসুল্লী (১৬)। একজন কুয়াকাটা সৈকতে ছাতা ও বেঞ্চের ব্যবসা ও অন্যজন সাগরে মাছ শিকার করে। এই দুই মেধাবী ছাত্র লেখাপড়া করলে শাহীন এখন অনার্সে পড়তো আর সুজন এসএসসি পরীক্ষা দিতো। কিন্তু ঘুর্নিঝড় সিডর কেড়ে নিয়েছে তাদের শিক্ষা জীবন। আর কাউয়ার চর গ্রামের সাফিজুল (১৩) তো স্কুলের বাড়ান্দায়ই যেতে পারেনি।

ঘুর্নিঝড় সিডর এই তিনজনের শিক্ষা জীবন কেড়ে নিয়েছে। তাদের মতো ২০০৭ সালের সিডর তান্ডবে কলাপাড়ার শতশত স্কুলগামী শিশু-কিশোরের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। বিধ্বস্ত উপকূলে নতুন করে সবকিছু শুরু করতে হওয়ায় সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ছেলেরা এখন কেউ মাছ ধরে, কেউ এখন
কৃষক, কেউবা নির্মান শ্রমিক। আর মেয়েরা এখন ২/৩ সন্তানের মা। সিডর এদের শুধু নিঃস্বই করেনি, নিভিয়ে দিয়ে গেছে গ্রামীন জনপদের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর শিক্ষার আলো।

২০০৭ সালে কাউয়ার চর গ্রামের সাফিজুলের বয়স তখন মাত্র পাঁচ। তার বাবা হাসান হাওলাদার বলেন, সাফির (সাফিজুল) লাইগ্যা তখন আদর্শ লিপি বই, ল্যাহার লইগ্যা কাঠের সিলাট কিইন্না আনছিলাম। অর মা কয়েকদিন পড়াইছেও। কিন্তু হেইয়ার পরই ঝড় এ কথা বলে থেমে যান।

দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলেন, ওই রাইতে (সিডরের রাতে) মুহুর্তের মধ্যে ঘরডা উড়াইয়া লইয়া যায়। পানিতে তলাইয়া যায় চাইর দিক। কোনরহম কোলে কইর‌্যা সাফিজুলরে লইয়া বান্দের উপর উইট্রা জানডা বাছাই। পরদিন বাড়িতে আইয়া দেহি শূন্য ভিডা। সব শ্যাষ। তখন তিনডা মাইয়া পোলাই ছোড আছিলো। ঘর-দুয়ার আছিলো না। দুইডা খাওয়ার লাইগ্যা যুদ্ধ করতে হইছে। তাই আর হয়নি অগো ল্যাহাপড়া।

সাফিজুলের ইচ্ছা লেখা পড়া করার। কিন্তু এখন বয়স ১৪ তাই তাকে আর স্কুলে ভর্তি না নেয়ায় ইচ্ছা থাকলেও আর পড়া লেখা হচ্ছে না। সাফিজুল বলেন, যহন গায়ে একটু জোড় হইছে হেই থেকে বাবার লগে মাছ ধরতে গেছি। হারাদিন সাগরে থাকতাম। রাইতে আইয়া ঘুমাইয়া পড়ি। ল্যাহাপড়া করমু কোন সময়। খুব ইচ্ছা করে ইসকুলে যাইতে,কিন্তু মুই বড় দেইখ্যা কোন ইসকুলেই
মোরে আর ভর্তি নেয় না।

একই গ্রামের সুজন মুসুল্লীও এখন মাছ ধরে। স্কুলের মেধাবী ছাত্র হিসেবে তার পরিচিতি থাকলেও এখন জেলে হিসেবে পরিচিত। চরচাপলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সে যখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র তখন ঘুর্নিঝড় সিডর আঘাত হানে। এক ঝড়ে গোটা এলাকা লন্ডভন্ড করে দেয়। সেই সাথে শেষ করে দেয় তার শিক্ষা জীবন।

সুজন বলেন, আগে দল বাইন্দা স্কুলে যাইতাম, আর এ্যাহন মাছ ধরতে যাই। আগে হাতে থাকতো বই-খাতা আর এ্যাহন জাল। ঘরে পাঁচটা ভাই-বোন। বড় দুই ভাই বিয়া কইর‌্যা ভিন্ন। মোর উপর এ্যাহন সংসার। মাছ ধরতে পারলে সংসার চলে, না ধরলে না খাইয়া থাকতে হয়।

কুয়াকাটার শাহীন মুন্সী এখন সৈকতে পর্যটকদের বিশ্রাম নেয়ার জন্য বেঞ্চ ও ছাতার ব্যবসা করেন। তার উপার্জনে চলে চারজনের সংসারের ভরন পোষন। কিন্তু শাহীনের স্বপ্ন ছিলো উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে চাকুরি করা। কিন্তু ঘুর্নিঝড় সিডর তার সব স্বপ্ন ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।

শাহীন বলেন, কুয়াকাটা সৈকতে তার বাবা দেলোয়ার মুন্সীর একটি ঝিনুক ও একটি মুদি দোকান ছিলো। নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে কুয়াকাটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ছিলো। কিন্তু ২০০৭ সালের সিডরের জলোচ্ছাস তাদের নিঃস্ব করে দিয়ে গেছে। সিডরের জলোচ্ছাসে দুটিই দোকান সহ তাদের কুয়াকাটা আদর্শ গ্রামের তাদের বসত ঘরটিও ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

শাহীনের পিতা দেলোয়ার মুন্সী বলেন, পোলাডার মাথা ভালো আছিলো। ইসকুলের ছারের সবাই অরে ভালো পাইতো। কিন্তু কি আর করমু, সিডরের পর মোগো না আছিলো মাথা গোঁজার জায়গা, না আছিলো দুইডা খাওয়ার টাহা। গত আট বছরে গায়ে খাইট্রা একটা ছোট্র ঘর করছি মাইনষের জায়গায়। কিন্তু শ্যাষ করছি পোলা মাইয়াগো ল্যাহাপড়া। ঘুর্নিঝড় সিডর তান্ডবে শুধু কলাপাড়ার শতশত স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে গেছে।

কাউয়াচরের আমির হোসেন জানান, এই চরে সাত শতাধিক পরিবার ছিলো। সিডরের রাতে জলোচ্ছাসে সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

কাউয়ার চর গ্রামের ফ্রেন্ডশীপ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হোসনে আরা ইয়াসমিন জানান, এ গ্রামের ৩/৪ কিলোমিটারের মধ্যেও কোন স্কুল নেই। তাই সিডরের পর এই গ্রামের স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রীরা আর স্কুলে যায়নি। এখন স্কুলগামী বয়সের দুই শতাধিক শিশু প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। তবে সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে কিশোরীরা। কারন তাদের ১০/১২ বছর বয়স হলেই বিয়ে দিয়ে বাধ্য হয়ে সিডর পরবর্তী উপকূলীয় এলাকার শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

কলাপাড়া উপজেলা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা জানান, সিডরের পর ওই সময়ে দায়িত্বরতরা এবং বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুলে পাঠাতে বিভিন্ন কর্মসূচী নিয়েছিলো। তবে যারা একেবারে
নিঃস্ব, সেই পরিবারের শিশুরা বাধ্য হয়েই সংসারের প্রয়োজনে স্কুল বন্ধ করে কাজে নামতে বাধ্য হয়েছে।

(এমকেআর/এসপি/নভেম্বর ১৪, ২০১৭)