উত্তম গোলদার, মির্জাগঞ্জ (পটুয়াখালী) : সিডরের দশবছর অতিবাহিত হলেও মির্জাগঞ্জের প্রলয়ঙ্কারী ঘূনিঝড় সিডর ও আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত বহু পরিবার এখনও তাদের বসত ঘরে ফিরতে পারেনি। অন্যদিকে পায়রার ভাঙ্গনের কারনে ২০ গ্রামের মানুষ আতংকের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। এ এলাকার মানুষ পায়রা নদীর ভাঙ্গন রোধে শক্ত বেড়িবাঁধ চান। সিডরের ভয়াবহতা চরখালী ও মেন্দিয়াবাদ গ্রামের মানুষেরা আজও ভুলতে পারেনি।

একদিকে জলোচ্ছাসের তান্ডবে সর্বস্ব হারিয়ে তারা নিঃস্ব,অন্যদিকে আবার ঝড়ের আশঙ্কায় ক্ষতিগ্রস্ত এ পরিবারগুলো এখনও পায়রা নদীর পাড়ে বেড়ি বাঁধের ঢালে ছাপড়ার নিচে খুপড়ি ঘরে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। আকাশে মেঘ দেখলেই এখনও আতকে উঠে তারা। ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি মির্জাগঞ্জ উপজেলার সিডর ক্ষতিগ্রস্তরা। সব কিছু হারিয়ে তারা অনেকেই ঢাকায় গেছে কাজের সন্ধানে, কেউ বা নদীতে মাছ ধরে এবং কেউ অন্যের সঙ্গে কাজ করে এখন তাদের পরিবার পরিজনের জন্য দু’ মুঠো খবার সংগ্রহ করতে হচ্ছে।

সিডরে মারা যাওয়া লাশ গুলো চরখালী খান বাড়ির পুকুর পাড়ে ২৪টি কবরে ৩৩টি লাশ দাফন করা হয়। এখন অযত্ন অবহেলায় পড়ে রয়েছে গনকবরগুলো। এমনকি সরকারি ভাবে তাদের স্মরন করা হয় না। উপজেলার কপালভেরা গ্রামের পালোয়ান বাড়িতে একই ঘরে স্বামী-স্ত্রীসহ ৬জন মারা যায়। মৃত-জব্বার পালোয়নের ভাই রহিম পালোয়ান বলেন,তাদের ভাগ্যে তেমন কিছু জোটেনি।

মেন্দিয়াবাদ গ্রামের মাজেদা বেগম বলেন,পায়রা নদী থেকে ৪০ ফুট দুরে ছিল তার ঘর। সিডরের পর দিন ঘরের একটি খুটিও খুঁজে পায়নি সে। মাজেদা বেগমসহ এ রকম জমি না থাকা এ এলাকার ৬টি পরিবারকে থাকার জন্য রানীপুর গ্রামের ইসমাইল হাজি মেন্দিয়াবাদ গ্রামের ২০ শতাংশ জমি দান করেন। সেই থেকে এখানেই তাদের বসবাস। বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসহ অনেক স্বচ্ছল ব্যক্তিত্ব এসব দূর্গত মানুষের পাশে দাড়াঁনোর ফলে অনেকেই ঘূরে দাড়িয়েছে। আবার অনেকেই এখনও খুজে পাইনি মাথা গোঁজার ঠাঁই। এর মধ্যেই মেন্দিয়াবাদ এলাকায় ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। যে কোন সময়ে পায়রা নদীর ভাঙ্গনের কারেন বসতটুকু হারিয়ে যেতে পারে। পোলা-পান লইয়া মোরা এহন ভয়ে রাইত কাটাতে হয়। এ রকম অনেক পরিবার রয়েছে মেন্দিয়াবাদ গ্রামে। স্বজন হারা ব্যাথা নিয়ে কাটছে তাদের জীবন। একই ভাবে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে শত শত পরিবার সবর্শ্ব হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে।

উপজেলা সদরস্থ সুবিদখালী হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাবু সুভাষ চন্দ্র শীল ওই রাতে বিদ্যালয়ের আশে পাশের লোকজনকে বিদ্যালয়ের দোতালায় তুলতে সক্ষম হলেও তিনি পাশে সুবিদখালী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিছনে দুটি চাম্বল ও একটি তালগাছসহ ওই বিদ্যালয়ের ওপর উপরে পরলে তিনি ঘটনা স্থলে মারা যান এবং পরদিন সকাল নয়টারদিকে গাছ চাপা অবস্থায় তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।

জানা যায়, মির্জাগঞ্জে সিডরের আঘাতে ১০ হাজার ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত এবং ১১৫ জন নারী, পুরুষ ও শিশুর প্রাণহানীসহ অনেক সম্পদের ক্ষতি হয়। আংশিক বিধ্বস্ত হয় ১৪হাজার ৫শত ঘর, গবাদিপশু মারা যায় ২ হাজার ৫শত, হাঁস-মুরগি মারা যায় ১লাখ ৩০ হাজার, ফসল বিনষ্ট হয় ১১ হাজার ৯৯০ একর জমির,৭ হাজার ৯৮৭ টি পুকুরের প্রায় কোটি টাকার মাছ ভেসে যায়।

এছাড়াও উপজেলার ৮০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ২৪০টি মসজিদ সম্পূর্ন বিধ্বস্ত হয়, ৩৪ কিলোমিটার পাকা সড়ক, ১৫৬ কিলোমিটার কাচাঁ সড়ক ও ৩৫ কিলোমিটার বাধঁ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ দেউলী সুবিদখালী ইউনিয়ন।

এই ইউনিয়নে বিধ্বস্ত হয় ১ হাজার ১৭০টি ঘর এবং মৃত্যু ঘটে ৮৫ জনের। এর মধ্যে চরখালী গ্রামে মারা যায় ৪৫ জন।

মির্জাগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান খান মোঃ আবু বকর সিদ্দিকি বলেন, সিডরের সময়ে মির্জাগঞ্জে জান-মালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মির্জাগঞ্জের মানুষ শক্ত বেড়িঁবাধঁ নির্মানের দাবি জানেিয়ছেন সরকারের কাছে। তবে যারা এখন পর্যন্ত ঘর পায়নি তাদেরকে পর্যায়ক্রমে পূনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।


(ইউজি/এসপি/নভেম্বর ১৪, ২০১৭)