রূপক মূখার্জি, লোহাগড়া (নড়াইল) : গ্রামের নাম বাড়িভাঙ্গা। যে গ্রামে স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও গড়ে ওঠেনি কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত এই গ্রামের কোমলমতি শিশুদের সময় কাটে কাচের বল (মার্বেল) ও গ্রামীণ খেলাধুলা করে। একটু বয়স্কদের সময় কাটে তাস ও কেরামবোর্ড খেলে এবং চায়ের দোকানে টেলিভিশনে সিনেমা ও খবর দেখে। গ্রামটিতে রয়েছে গ্রাম্য কোন্দল তথা ভিলেজ পলিটিক্স। এছাড়া মাাদকের ভয়াবহতায় উঠতি বয়সের ছেলেরা বিপদগামী হয়ে উঠছে। খেলার কোন মাঠ না থাকায় ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল বা অন্যান্য খেলাধুলার সুযোগ থেকে বঞ্চিতা যুবকরা।

নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার নোয়াগ্রাম ইউনিয়নে বাড়িভাঙ্গা গ্রামটি লোহাগড়া উপজেলা শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার পশ্চিমে নবগঙ্গা নদীর উত্তর পাড়ে অবস্থান। এছাড়া নড়াইল জেলা শহর থেকে ১১ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এই গ্রামটি। গ্রামটির পশ্চিম পাশ দিয়ে জেলার সর্ববৃহৎ ইছামতি বিলের সাথে নবগঙ্গা নদীর সংযোগ স্থাপনকারী বাড়িভাঙ্গা খালটি দেশীয় প্রজাতির মাছের ভান্ডার গুরুত্ব বহন করে আসছে।

বাড়িভাঙ্গা গ্রামের নামকরণ কিভাবে হয়েছে তা কেউ সঠিক ভাবে বলতে পারেননি। তবে এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, এক সময়ে এই গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। পরবর্তীতে হিন্দু সম্প্রদায় ভারতে পাড়ি জমানোর মুসলমানরা বাড়িঘর ভেঙ্গে নিয়ে এই গ্রামের বসবাস শুরু করে। সম্ভবতঃ সে কারনেই গ্রামটির নাম বাড়িভাঙ্গা নামকরণ হয়েছে বলে অনুসন্ধানকালে জানা গেছে। তবে গ্রামের নাম ‘‘বাড়িভাঙ্গা’’ শব্দটি নিয়ে ওই গ্রামবাসীর রীতিমতো বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়।

বাড়িভাঙ্গা গ্রামে দেড় শতাধিক পরিবারের বসবাস রয়েছে। এই গ্রামের পূর্বদিকে রায়গ্রামের অবস্থান। বাড়িভাঙ্গা থেকে রায়গ্রাম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দূরত্ব অন্ততঃ চার কিলোমিটার। দক্ষিণে নবগঙ্গা নদী। পশ্চিমে ব্রাহ্মণডাঙ্গা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং উত্তরে হান্দলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দূরত্ব দুই কিলোমিটারের বেশি। তাও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না থাকায় কোমলমতি শিশুরা এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে।

তবে শত প্রতিকুলতার মধ্যদিয়েও এই গ্রাম থেকে কিছু ছেলে-মেয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে চাকুরী করছে। এ গ্রামের শিক্ষিতের হার ২০%।

বাড়িভাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা মোক্তার হোসেন (৭০) জানান, এই গ্রামে স্থাপনা বলতে দুটি মসজিদ এবং ছোট ছোট ২/৩টি খুপরি ঘরের দোকান রয়েছে। নেই কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং খেলার মাঠ। যার কারনে এই গ্রামে শিক্ষার হার সর্বোচ্চ ২০%। যারা লেখাপড়া শিখেছে তারাও চাকুুরী এবং পরিবেশগত সমস্যার কারনে শহরে চলে গিয়েছে। তরুন ছেলেরা মাঝে মধ্যে তার বাড়ির পাশের পতিত জমিতে ক্রিকেট খেলে শখ পূরণ করে। গ্রামে খেলার মাঠ না থাকায় ছেলেদের খেলার সুযোগ দিয়ে থাকেন।

এই গ্রামের বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য কায়কোবাদ লস্কার জানান, এই গ্রামে কয়েক বছর আগে ব্র্যাক কর্তৃক একটি শিশু শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। ৪/৫ বছর ধরে পড়াশোনা করানোর কারনে কিছু ছেলে মেয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে। পরে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আবারও ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার গতি থেমে গেছে। এই গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলে ছেলে-মেয়েরা অন্তত ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পারতো।

এই গ্রামের কলেজ ছাত্র রুবেল হোসেন জানান, তিনি বহু কষ্ট শিকার করে এখন নড়াইল সরকারী ভিক্টোরিয়া কলেজে বাংলা বিষয়ে অনার্স পড়াশোনা করছেন। তবে গ্রামের অবস্থায় ভয়াবহ খারাপ। এই গ্রামের শিশুরা কাচের মার্বেল, ও কিছু গ্রামীণ খেলাধুলা করে সময় কাাটায়। যুবকরা কেরামবোর্ড ও তাস খেলার মধ্যদিয়ে বড় হয়। গ্রামে খেলার মাঠ বলতে কিছুই নাই। কৃষি জমিতে ধান কাটার পর কিছুদিন পতিত থাকলে সেখানে ফুটবল খেলা করা ছাড়া বিকল্প কোন সুযোগ নেই। এছাড়া ঈদগাহ মাঠে খেলাধুলা করতে গেলেও সেখানে বাধা দেয়া হয়। যার কারনে পড়াশোনা ও খেলাধুলা এই গ্রামবাসীর জন্য বড়ই অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছে।

এই গ্রামের সন্তান ওবায়দুুর রহমান, দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসে থাকার পর এখন নড়াইল শহরে মুদিখানার ব্যবসা করেন। ছেলে-মেয়েকে নড়াইল শহরের ভাল প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করেছেন। তিনি জানান, ওই গ্রামের অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষিত হওয়ায় ভিলেজ পলিটিক্স নিয়ে চর্চা বেশি। ২০১২ সালে এই গ্রামের মাছ ধরা নিয়ে সংঘর্ষে একটি মার্ডার হয়। এছাড়া মাঝে মধ্যে একাধিকবার কাইজে ও মারামারির ঘটনা ও বাড়িঘর ভাংচুর হয়েছে। শিক্ষার আলো বঞ্চিত হওয়ায় গ্রামের আর্থসামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের সৃষ্টি হয়েছে। মাদকের ছোবল ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এসব থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষার বিকল্প নেই।

এই গ্রামের সন্তান রেজাউল শেখ জানান, স্কুল না থাকায় তার চারটি ছেলে-মেয়ের কেউ পড়াশোনা শিখতে পারেনি। দুটি ছেলে বর্তমানে ইজিবাইক চালায় এবং দুটি মেয়েকেই অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। এখন নিজে চা সহ ছোট একটি মুদিখানার দোকান দিয়ে সংসারে খরচ বহন করছেন। গ্রামে একটি স্কুল থাকলে থাকলে ছেলে-মেয়েগুলি পড়াশোনা শিখে চাকুরী করলে আজ এতো বেশি কষ্ট করতে হতো না।

একই অবস্থা এই গ্রামের মটুক হোসেনের। তিনিও দুটি মেয়েকে লেখাপড়া না শিখিয়েই বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন এবং দুটি ছেলে ওয়েলডিং এর কাজ করে। গ্রামে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় পড়াশোনা শেখানো সম্ভব হয়নি বলে তিনি জানান।

প্রতিবেশি ব্রাহ্মণডাঙ্গা গ্রামের শিক্ষক শান্তনু চট্টোপাধ্যায় জানান, বাড়িভাঙ্গা গ্রামে স্কুল না থাকায় থেকে৬/৭ বছর আগে সরকারের পক্ষ থেকে স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও ৩৩ শতক জমি গ্রামবাসী দিতে না পারায় স্কুলটি প্রতিষ্ঠা হয়নি। এখনও ৩৩ শতক জমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামে লিখে দিলেই সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ রয়েছে। ৩৩ শতক জমির দাম পড়ছে ৬ লাখ টাকার মতো।

স্থানীয় ইউপি সদস্য এস্এম শারফুজ্জামান বুরাক বলেন, বাড়িভাঙ্গা গ্রামের স্কুলের খুবই প্রয়োজন থাকলেও দারিদ্রতার কারনে ৩৩ শতক জমির টাকা যোগাড় করা সম্ভব হচ্ছে না। নড়াইলের অনেক কৃতি সন্তান দেশের গুরুত্বপুর্ণ পদে অবস্থান করছেন। একটি হতদরিদ্র গ্রামের কোমলমতি ছেলে-মেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে জমি কেনার ক্ষেত্রে বিত্তবানদের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেছেন।

নোয়াগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম কালু জানান, স্কুলের জন্য ৩৩ শতক জমির মুল্য ৬ লাখ টাকার বেশি। জমির এই উচ্চমুল্যের কারনে এখন আর কেউ বিনামুল্যে জমি দিতে রাজিজ হয় না। বাড়িভাঙ্গা গ্রামবাসীর পক্ষেও ৬লাখ টাকা যোগাড় করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে মানবতার সেবক-দানশীল ব্যক্তিদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

লোহাগড়া উপজেলা শিক্ষা অফিসার লুৎফর রহমান গতকাল রোববার দুপুরে এ প্রতিবেদককে বলেন, দেড় হাজার জনসংখ্যা আছে এমন এলাকা বা গ্রামে এবং দুই কিলোমিটারের মধ্যে স্কুল না থাকলে সে এলাকায় ৩৩ শতক জমি স্কুলের নামে দলিল করে দিলে সরকারীভাবেই স্কুল প্রতিষ্ঠার সুযোগ রয়েছে।

(আরএম/এসপি/নভেম্বর ১৯, ২০১৭)