অমল তালুকদার,পাথরঘাটা (বরগুনা) প্রতিনিধি : বরগুনার পাথরঘাটা কলেজ ষ্টাফ পুকুর থেকে গণধর্ষনের শিকার তরুনীর লাশ উদ্ধারের ঘটনায় কলেজ শাখার সভাপতি ও সম্পাদকসহ চার ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেফতারের পর মুখ খুলতে শুরু করেছে যৌন হয়রানীর শিকার সহ নানাভাবে হয়রানীর শিকার ভুক্তোভোগীরা। ডিবিপুলিশের হাতে গ্রেফতারের পরপরই তাদের অপরাধ নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য বের হতে শুরু করেছে। বিশেষ করে উপজেলা কমিটির নেতাদের বেশ কিছু অপকর্মের ঘটনা সামনে এসেছে। উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি লুবনা মনিকে জড়িয়ে ছাত্রীদের যৌন হয়রানীতে ওই দুই নেতাকে সহযোগীতার অভিযোগ উঠেছে।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ,পাথরঘাটা কলেজে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল সভাপতি রুহি আনান দানিয়াল ও সাদ্দাম হোসেন ছোট্ট এবং দু’জন নারী নেত্রীর। তাদের আধিপত্যে জিম্মি ছিল শিক্ষক ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কলেজে ভর্তি রেজাল্ট ও ফরম পুরণ সবকিছইু এদের নিয়ন্ত্রনে ছিল। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নানা কৌশল ও প্রয়োজনের বাধ্য করে প্রায় শতাধিক ছাত্রীদের যৌন হয়ারাণী করার অভিযোগ উঠেছে ওই তিন নেতা ও তাদের দলীয় সহযোগীদের বিরুদ্ধে।

পাথরঘাটা কলেজেরই স্নাতক প্রথম বর্ষের একজন ছাত্রী লুবনা। কলেজ শাখার সভাপতি রুহী আনান দানিয়েল’র দুর সম্পর্কের ভাই হলেও ঘনিষ্ঠতার আলোচনা রয়েছে এদের জড়িয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে লুবনা মনির কয়েকটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। এর মধ্যে একটি ছবিতে দানিয়েল পেছন থেকে লুবনাকে জড়িয়ে অপর একটিতে উপজেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আল-আমিন রাজুর মুখে সিগেরেট ধরিয়ে দিতে দেখা যায়।

পাথরঘাটা ডিগ্রী কলেজের উচ্চমাধ্যমিক ১ম ও ২য় বর্ষে অধ্যায়নত বেশ কয়েকজন ছাত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে মুঠোফোনে জানান, কলেজের প্রতিবছর নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হলেই যে সব সুন্দরী মেয়েদের দিকে সাদ্দাম ও দানিয়েলের ‘নজর’ পড়ত তাদেরকে ওই দু’জনের পক্ষ হয়ে লুবনা মনি ভর্তি, পরীক্ষা, রেজাল্ট ও ফরম পুরণে ‘বিশেষ সুবিধা’ পাইয়ে দেয়ার প্রপোজ করতেন ও মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহ করে দিত। এদের ফাঁদে পড়লেই ওইসব ছাত্রীদের অনৈতিক প্রস্তাব দেয়া হত। এতে রাজী না হলে নানাভাবে ওই ছাত্রীদের ভীতি প্রদর্শণ হয়রানী করত সাদ্দাম দানিয়েল ও লুবনা। এতে কাজ না হলে একপ্রকার জোর করেই কলেজের ছাদে নিয়ে যৌন হয়রানী ও শারীরিক লাঞ্চিত করত।

স্নাতক প্রথম বর্ষে অধ্যায়নরত ইমাম হোসেন নামের একজন শিক্ষার্থী বলেন, সাদ্দাম দানিয়েলদের একটি গ্রুপ কলেজে যাইচ্ছেতাই করে বেড়াত। এদের দাপটে শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীরা তটস্থ থাকত। উচ্চমাধ্যমিক বানিজ্য বিভাগে অধ্যায়নরত মোঃ শাওন মিয়া বলেন, সাদ্দাম ও দানিয়েলের কু-প্রস্তাবে রাজী না হলে লুবনা মনিকে দিয়ে এদের অপমান লাঞ্চণা ও অপবাদ দিয়ে এমনকি প্রকাশ্যে মারধরও করা হয়েছে। আমরা এদের কঠোর বিচার দাবি করি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কলেজের স্নাতক ২য় বর্ষে অধ্যায়নরত কয়েকজন ছাত্রী বলেন, এই চক্র গত চার বছরে শতাধিক ছাত্রীকে ফাঁদে ফেলে অথবা বাধ্য করে যৌন হয়রানী করেছে। কলেজের ছাদে সাদ্দাম ও দনিয়েলের বিশেষ ব্যাক্তি ছারা প্রবেশ নিষিদ্ধ একটি জায়গা রয়েছে। এখানে শিক্ষক বা সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রবেশ নিষেধ। লুবনা মনি কৌশলে টার্গেটেড ছাত্রীদের ছাদে নিয়ে অপক্ষেমান সাদ্দাম ও দানিয়েলের কাছে পৌঁছে দিত।

এছাড়াও আলোড়ন থিয়েটার নামের একটি সাংষ্কৃতিক সংগঠনের সাথে ওই চারজন জড়িত রয়েছেন।তবে ওই ঘটনায় জড়িত ও সমালোচিত থাকায় দানিয়েল, সাদ্দাম, লুবনা মনি ও লিজা মনিকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন আলোড়ন থিয়েটারের জেলা শাখার সভাপতি আবু জাফর সালেহ।

পাথরঘাটা কলেজের উপাধ্যক্ষ মোঃ জাহাঙ্গীর আলম বলেন,নেপথ্যেও এমন সব ঘটনা তার জানা ছিলনা। তবে দানিয়েল ও সাদ্দাম ভর্তি ফরম ও পুরনসহ বিভিন্ন ব্যাপারে সুপারিশের জন্য আসত। তাদের নেপথ্য উদ্দেশ্য আমরা অবগত ছিলাম না। তবে তারা যদি ঘৃন্য অপকর্মের সাথে লিপ্ত থাকে আমি মনে করি এদের কঠোর বিচার হওয়া উচিত।

এ ব্যাপারে লুবনা মনির সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি মুঠোফোনে বলেন, দানিয়েল আমার সম্পর্কে খালাত ভাই, আমরা ছোববেলা থেকে পরষ্পরকে চিনি জানি ও এক অপরে বেশ ফ্রি, যে কারণে ওই ছবি মজা করে তুলেছিলাম। কিন্তু ছবি নিয়ে যে এমন হবে বুঝিনি। আর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এছাড়াও আমার সাথে যারা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে তারাই এখন এসব করছে। শিক্ষার্থীদের হয়রানী ও লাঞ্চিত করা এবং দানিয়েল সাদ্দামকে সহযোগীতার ব্যাপারে তিনি বলেন, আমি এসব ব্যাপারে আসলে কিছুই জানিনা।

সাদ্দাম, দানিয়েল, মাহমুদ, রায়হান ও লুবনা চক্রের এসব অপকর্র্মের কথা জেনেও মৌন ভুমিকা পালন করতেন তাদের রাজনৈতিক বড়ভাই! ওই বড়ভাইয়েরা সকলে আপাতত আত্মগোপনে রয়েছে বলে জানাগেছে । নিজদলীয় প্রতিপক্ষকে দমনে হাতিয়ার হিসেবে এদের ব্যবহারেরও প্রমান রয়েছে। তখনকার ছাত্রলীগ নেতা নাসির উদ্দীন সোহাগকে লাঞ্চিত করতে দানিয়েল চক্রকে ব্যবহার করেছেন এরা। কথিত আছে এই সোহাগকে লাঞ্চিত করার পুরষ্কার হিসেবেই দানিয়েল সাদ্দামদের কলেজে পদস্থ করেছেন বড়ভাইয়েরা। এছাড়াও মাহমুদ মাদকাসক্ত অবস্থায় গ্রেফতার হওয়ার পর পুলিশকে ফোন করে ছাড়িয়ে এনেছেন বর্তমান সভাপতি হাফিজ।

কে এই লুবনা, কি তার পরিচয়

পাথরঘাটা পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা পাথরঘাটা পৌরসভা একই ওয়ার্ডের সনি সিনেমাহলের সাবেক ব্যবস্থাপক শাহ আলমের মেয়ে লুবনা মনি। মাধ্যমিকে অধ্যায়নরত থাকাকালীন তার পৌর শহরের ৭নং ওয়াডের বাবু নামের এক ছেলের সাথে বিয়ে হয় তার। কিন্তু দানিয়েলের সাথে ঘনিষ্ঠতার টের পেয়ে বাবু লুবনাকে ছেড়ে খুলনা চলে যান। এরপর আরও এক ছেলের সাথে গোপনে বিয়ে হলেও বেপরোয়া জীবন যাপনের কারনে কারো সাথেই ঘর বাঁধা হয়নি তার। বর্তমানে সে পাথরঘাটা উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ও কলেজে স্নাতক প্রথম বর্ষে অধ্যায়নরত ।

এদিকে অজ্ঞাত তরুনীকে ধর্ষণসহ নির্মম ভাবে হত্যা এবং অন্যান্য হত্যার সুষ্ঠ তদন্ত ও প্রকৃত দোষীদের খুজে বের করে দৃষ্টান্ত মুলক শাস্তির দাবিতে রবিবার বরগুনার পাথরঘাটায় মানববন্ধন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর স্বারকলিপি প্রদান করবে পাথরঘাটা সামাজিক উন্নয়ন ফোরাম। ফোরামের নেতৃত্বে থাকা বায়েজিদ মোর্শেদ রাকিব বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

বরগুনার পুলিশ সুপার বিজয় বসাক জানান, ঘটনার সাথে কারা জড়িত রয়েছে এ ব্যাপারে আমরা খোঁজ নিচ্ছি। ঘটনায় জড়িত দু’জনের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। গোপনীয়তার স্বার্থে আপাতত কিছু প্রকাশ সম্ভব হবেনা। এ ঘটনায় যারা জড়িত তাদের কেউ পার পাবেনা বলেও তিনি জানান।

(এটি/এসপি/নভেম্বর ১৯, ২০১৭)