খাড়দিয়ার বাচ্চু
মেলেটারি বাচ্চু
খাড়দিয়ার মেলেটারি
বাচ্চু মেলেটারি
বাচ্চু রাজাকার...

একাত্তরের দিনগুলোতে এইসব নামেই তাকে চিনতো ফরিদপুরের নগরকান্দার সাধারণ মানুষ। এই চিহ্নিত রাজাকার যখন ‘মওলানা আবুল কালাম আজাদ’ নাম নিয়ে কোরআনের তাফসির করার নামে তার অপকর্ম ঢাকতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো তখনই তার স্বরূপ উন্মোচন করে দেই ‘সেই রাজাকার’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে। তারই পথ ধরে আজ কুখ্যাত সেই রাজাকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। রায় হবে। আমি চাই, এই বাচ্চু রাজাকারের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক। তার ফাঁসি হোক।


কম্পিত, উত্তেজিত কণ্ঠে বাংলানিউজকে কথাগুলো বলছিলেন সাহসী সাংবাদিক প্রবীর সিকদার। ফরিদপুরের একজন সাংবাদিক হিসেবে দৈনিক জনকণ্ঠে স্বাধীনতার ত্রিশ বছর পর ২০০১ সালে বাচ্চু রাজাকারকে জনসমক্ষে নিয়ে আসেন প্রবীর সিকদার। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ছেলে প্রবীর ৭১-এ ছিলেন মাত্র ৯ বছরের শিশু। বাচ্চু রাজাকার ও তার নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হাতেই তিনি হারিয়েছেন দাদু, বাবা ও কাকাদের।

সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ রায় দেবে আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে। রোববার এই খবর প্রকাশের পর সন্ধ্যায় প্রবীর সিকদারকে বাংলানিউজ কার্যালয়ে আমন্ত্রণ জানান এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেন। তিনিই আলোচনা শুরু করেন। জানতে চান এমন একটি দিনে প্রবীর সিকদারের কেমন লাগছে? উত্তরে প্রবীর বললেন, “শোনার পর থেকেই বেশ স্বস্তি অনুভব করছি। আমি আশা করছি তার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে।”

প্রবীর সিকদারের সঙ্গে এই আলোচনায় আরও অংশ নেন বাংলানিউজের হেড অব নিউজ মাহমুদ মেনন, চিফ অব করেসপন্ডেন্টস আহমেদ রাজু, আউটপুট এডিটর রানা রায়হান, পলিটিক্যাল এডিটর জাকারিয়া মন্ডল।

আবেগতাড়িত কণ্ঠে প্রবীর সিকদার বলে চললেন, “আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাচ্চু রাজাকারের সর্বোচ্চ সাজাই হবে। যদি সেটা না হয়, আমি মনে করবো তার একাত্তর সালের অপরাধগুলো সঠিকভাবে তুলে ধরা সম্ভব হয়নি। আর যদি সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়ে থাকে তাহলে বাচ্চু রাজাকারের যে অপরাধ, তাতে একবার নয় তিন শ’ বার ফাঁসি হতে পারে।”

২০০১ সালের মার্চে রাজাকারের স্বরূপ উন্মোচন করে যখন ধারাবাহিক প্রতিবেদন করছিলেন তখনই প্রবীর সিকদারের ওপর নেমে আসে বাচ্চু রাজাকারের খড়গ।

‘হত্যা করা হয় আমাকে’ বললেন প্রবীর সিকদার। বাংলানিউজকে বলেন, সেদিন ওরা মনেই করেছিলো আমার মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যু নিশ্চিত করেই সেদিন তারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেছিলো। আমি কেনো কিভাবে বেঁচে গেছি তা আমি নিজেও জানি না।”

দিনটির কথা স্মরণ করে প্রবীর সিকদার বলেন, “সেদিন হাইওয়েতে একটি ডাকাতির খবর কাভার করতে যাই সকাল সাড়ে আটটার দিকে। ভয়াবহ সেই ডাকাতির খবর নিয়ে মোটর বাইকে করে যখন ফরিদপুর শহরে ফিরছিলাম তখন হঠাৎই পথের মাঝে আমার ওপর প্রথম বোমা হামলা, এরপর এলোপাতাড়ি কোপানো চলতে থাকে, সবশেষে গুলি করে রেখে যায়। ওরা নিশ্চিত করে যায় আমার মৃত্যু। রাস্তায় ওরা আমার ডেড বডিই ফেলে যায়।”

মারা যাননি প্রবীর সিকদার। তবে একটি পা হারিয়ে এখন ক্র্যাচে ভর করে হাঁটেন। স্বাভাবিক কাজ করতে পারেন না একটি হাত দিয়ে। আর সারা শরীরে এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন স্প্লিনটারের যাতনা।

“তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপে ও আগ্রহেই আমার সুচিকিৎসা হয় ও আমি বেঁচে যাই,” বলেন প্রবীর সিকদার।

প্রবীর বলেন, “আমার ওপর এই হত্যাচেষ্টার মামলায় সুবিচার পাইনি। চার্জশিটের ওপর দুইবার নারাজি দিয়েছি। যখন ওই মামলার প্রধান আসামি পার পেয়ে যায় তখন আমি অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতেও যাইনি।”

“তারপরেও আমার ওপর হামলার বিচার না পেলেও সেই রাজাকারের বিচার হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে রায় হচ্ছে এটি আমাকে স্বস্তি দিচ্ছে”, বলেন প্রবীর সিকদার।

“১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের ওই সময়টিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে বাচ্চু রাজাকারের ইতিহাস আজ হয়তো অন্যভাবে লিখতে হতো,” বলে চলেন প্রবীর সিকদার। তবে তিনি এও জানান, আওয়ামী লীগের মধ্যেও ঢুকে পড়তে চেয়েছিলেন বাচ্চু রাজাকার। প্রবীর বলেন, “ওই সময় আমার কাছে খবর ছিলো আওয়ামী ঘরানায় একটি ইসলামী টেলিভিশন হবে। আর তার দায়িত্ব দেওয়া হবে মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে। এসময় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ওই টেলিভিশনের জন্য জমি বরাদ্দ দেওয়ার প্রক্রিয়াও চলছিলো। তখন ডিসিসি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন কেএম নূরুল হুদা। যিনি একসময় ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক ছিলেন। তার মাধ্যমেই বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে আমার কাছে যেসব তথ্য ছিলো তা হাজির করি মেয়র মোহাম্মদ হানিফের সামনে। এরপর ওই টেলিভিশনের উদ্যোগের সমস্ত কাগজপত্র টেনে ছিঁড়ে ফেলেন মেয়র হানিফ। তার সেই অবদানও বাচ্চু রাজাকারের নতুন প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পথ রুদ্ধ করেছিলো।”

মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরেশ চন্দ্র সিকদারের ছেলে প্রবীর সিকদার আরও জানান, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর বাচ্চু রাজাকারের প্রতিপত্তি আরও বাড়তে থাকে। টেলিভিশনের মালিকানা ছাড়াও কয়েকটি ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য ছিলেন তিনি। জামায়াতের মসজিদ মিশন নামের একটি প্রকল্পও চলতো তার নেতৃত্বে।

প্রবীর বলেন, “বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের প্রমাণগুলো খুবই স্পষ্ট, অনেক চাক্ষুষ। তার শাস্তি অবধারিত। তার ফাঁসিও অবধারিত। তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন জনপ্রিয় চিকিৎসকের স্ত্রীকে ধরে নিয়ে গিয়ে প্রায় চার মাস নিজ বাড়িতে আটকে রেখে ধর্ষণ করে এই বাচ্চু রাজাকার। এই নারী এখনো বেঁচে আছেন। এবং তিনি কখনো টেলিভিশন দেখেন না। পাছে তাকে বাচ্চু রাজাকারের সেই ঘৃণিত মুখ দেখতে হয়।”

প্রবীর সিকদার আরও জানান, বাচ্চু রাজাকারের ওপর ওই রিপোর্টটি যাতে না হয় তার জন্য তাকে ১০ লাখ টাকা দেওয়ারও চেষ্টা চলছিলো। কিন্তু সে অফার তিনি হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন।

তিনি বলেন, “রিপোর্ট করার কারণেই দেশের মানুষ জানতে পারে আবুল কালাম আজাদ মওলানা নয়, মূলত একজন খুনি, ধর্ষক ও লুণ্ঠনকারী।”

যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে নানা উদ্বেগ, হতাশা ও আশা রয়েছে। বিচার নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন নই। আজ নয়তো কাল, নয়তো পরশু হবে সেই বিচার। কিন্তু আমি উদ্বিগ্ন কোনো কারণে যদি এই রাজাকার বা তাদের সহযোগীদের হাতে ফের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যায় তাহলে এইসব যুদ্ধাপরাধীর অপকর্ম তুলে ধরে যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন তাদের ওপর নেমে আসবে চরম খাঁড়া। তাদের জন্যই এই রাজাকারদের ফাঁসি হওয়া প্রয়োজন।

আর এ কারণেই, আমার নিজের ওপর হামলার বিচার হোক চাই না হোক, এই রাজাকারের শাস্তি হচ্ছে এটাই আমার স্বস্তি, বলেন প্রবীর সিকদার।

সৌজন্যে : বাংলানিউজ২৪ডটকম।
প্রকাশকাল : ২০ জানুয়ারি ২০১৩