শরীয়তপুর প্রতিনিধি : শরীয়তপুর জেলার গোসাইরহাট উপজেলার নাগের পাড়া ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের মেম্বার নজরুল ইসলাম মুন্সীকে (৫০) বৃহস্পতিবার রাতে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বত্তরা। নিহতের মা তহেমিনা বেগম বাদী হয়ে শুক্রবার দুপুরে গোসাইরহাট থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এতে নজরুলের আপন চাচা আব্দুল মান্নান মুন্সিকে প্রধান করে ২৪ জনকে আসামী করা হয়। পুলিশ এজাহারভূক্ত ৩ আসামীকে গ্রেফতার করেছে।এলাকায় এখনো থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।

গোসাইরহাট থানা ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নাগেরপাড়া ইউনিয়নের ভদ্রচাপ গ্রামের মৃত শিকিমালী মুন্সির সাথে তার ছোটভাই মান্নান মুন্সির দীর্ঘদিনের পারিবারিক দ্বন্দ চলে আসছিল। বংশ পরম্পরায় সে দ্বন্দ শিকিমালী মুন্সির ছেলেদের সাথেও শুরু হয়। পারিবারিক দ্বন্দ এক পর্যায়ে রূপ নেয় রাজনৈতিক ও আদিপত্য বিস্তারের দ্বন্দে। মান্নান মুন্সি নাগেরপাড়ার ইউপির ৫ নং ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার।

গত ইউপি নির্বাচনেও মান্নান মুন্সি মেম্বার পদে প্রার্থী হন। কিন্তু তার ভাতিজা নজরুল মুন্সিও চাচার বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দিতা করে নির্বাচিত হন। এতে পুরনো দ্বন্দ আরো ঘনিভূত হয়। মান্নান মুন্সির ভয়ে ইতমধ্যে নজরুল মুন্সি নাগেরপাড়া ছেরে ৩০ কিলোমিটার দুরে শরীয়তপুর জেলা শহরে ভাড়া বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। সেখানে তিনি শরীয়তপুর জজ কোর্টের সামনে একটি ফটোকপি মেশিনের দোকান দিয়ে পরিবারের খরচ বহন করতেন। মাঝে মধ্যে পরিষদের কাজ ও নিজের জমাজমি দেখা শুনা করতে নাগের পাড়ায় যাতায়াত করতেন।

বৃহস্পতিবার বিকেলে নজরুল মুন্সি নাগেরপাড়া বাজারে যান। সেখান থেকে শরীয়তপুরে তার ভাড়া বাসায় না ফিরে রাত্রি যাপনের জন্য এবং মায়ের সাথে দেখা করতে রাত সাড়ে ৮ টার দিকে তার দুই সঙ্গী রতন পেদা ও তাজিম মুন্সিকে সাথে করে অটো রিক্সায় করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। নাগেরপাড়া বাজার থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দুরে মুন্সিরহাট উঁচু ব্রীজের কাছে রাত পৌনে ৯ টার দিকে পৌছলে পূর্বে থেকে ওৎ পেতে থাকা ১০-১২ জন সন্ত্রাসীর একটি দল ককটেল বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাদের উপর অতর্কিতে হামলা করে। এসময়ে অটো রিকক্সা থেকে টেনে হেচরে বেড় করে নজরুলের ঘাড়ে ও মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাথারি কোপাতে থকে। তার সহযাত্রী দুইজনকেও অনুরূপভাবে কোপানো হয়। তাদের ডাক চিৎকারে আশে পাশের মানুষ এগিয়ে আসলে দূর্বত্তরা পালিয়ে যায়।

স্থানীয়রা আক্রান্তদের উদ্ধার করে গোসাইরহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়ার পর চিকিৎসক নজরুল মুন্সিকে মৃত ঘোষনা করেন। এবং ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মারাত্মক জখম রতন পেদা ও তাজিম মুন্সিকে আশংকাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রেরণ করেন। শুক্রবার দুপুরের পর শরীয়তপুর সদর হাসপাতাল মর্গে নিহতের ময়না তদন্ত শেষে তার মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ভদ্রচাপ গ্রামে জানাজা নামাজ শেষে বাদ এশা পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। নিহত নজরুল ইসলাম মুন্সির ২ স্ত্রী, ২ পুত্র ও দুইজন কন্যা সন্তান রয়েছে। তিনি স্থানীয়ভাবে শ্রমিকলীগের রাজনীতির সাথে জরিত ছিলেন।

নিহত নজরুলের মা তহেমিনা বেগম, স্ত্রী নাহার বেগম, ছোট ভাই সবুজ মুুন্সী, ছেলে ইমন, মেয়ে নিপা সহ স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ১৯৯২ সালেও নিহত নজরুল মুন্সির ভাই জসিম মুন্সি ঢাকা থেকে বাড়ি আসলে মান্নান মুন্সি ভাড়াটে খুনিদের দিয়ে তাকে হত্যা করিয়ে ডাকাতের হামলায় নিহত হয়েছে বলে চালিয়ে দিয়েছিল। গত ইউপি নির্বাচনে নজরুল মুন্সী মান্নান মুন্সীকে পরাজিত করে মেম্বার নির্বাচিত হয়। নির্বাচনের পর থেকেই পরাজিত মেম্বার প্রার্থী মান্নান মুন্সী তার সমর্থক দেলোয়ার সারেং, মাসুদ সরদার, হানিফ বালি, রুবেল চৌকিদার, রিপন বালি, পাবেল চৌকিদাররা নজরুল মেম্বারের উপর প্রতিশোধ নিতে ষড়যন্ত্র শুরু করে। পরিকল্পিতভাবেই নজরুলকে খুন করা হয়েছে বলে দাবি তাদের। হত্যার সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্ত মূলক বিচার দাবী করেছেন নজরুলের পরিবার।

নিহত নজরুলের মরদেহ ময়নাতদন্তকারি চিকিৎসক শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডাক্তার এহসান বলেন, নিহতের শরীরে ধারালো অস্ত্রের অসংখ্য আঘাত ছিল। তার মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য মাথার খুলি, ঘাড় ও শ্বাস নালীতে আঘাত করা হয়। দেখে মনে হয়েছে খুব অভিজ্ঞ ও পেশাদারীদের হাতে এ হত্যাকান্ড সংগঠিত হয়েছে।

নাগেরপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান হাজী মো. মহসিন সরদার বলেন, মেম্বার নজরুল খুন হওয়ার ৩০ মিনিট পূর্বে আমার সাথে ফোনে কথা বলেছে। এর পরই নাগের পাড়া থেকে অটোবাইক যোগে মুন্সির হাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে বড় ব্রীজে পৌছলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আটোরিক্সার গতিরোধ করে নজরুলকে হত্যা করা হয়েছে। নির্বাচনের পর থেকে তার আপন চাচা পরাজিত প্রার্থী মান্নানের সাথে একাধিকবার সংঘর্ষ হয়েছে। নজরুল খুব সৎ লোক ছিল। কথা ও কাজে মিল রেখে কাজ করতো । আমি এ হত্যাকান্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবী করছি।

গোসাইর থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এ,বি,এম মেহেদী মাসুদ বলেন, ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম হত্যায় তার মা তাহমিনা বেগম বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। এতে নজরুলের চাচা মান্নান মুন্সিকে প্রধান করে মোট ২৪ জনকে আসামী করা হয়েছে। এজাহারভূক্ত আসামী মাজেদ বেপারী, বজলু সরদার ও সোহেল পুস্তিকে আমরা গ্রেফতার করেছি। বাকি আসামীদের ধরার জন্য আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।


(কেএনআই/এসপি/ডিসেম্বর ০১, ২০১৭)