প্রবীর বিকাশ সরকার : ২০১১ সালে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম। নিরাভরণ ছিমছাম বিশ্বভারতী। সেখানে ঘুরে ঘুরে ছাত্র-ছাত্রী ও বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে রবীন্দ্রনাথের দেখা পাইনি। কারো কথাবার্তা, আচার-আচরণ কিংবা পরিবেশের মধ্যেও রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন, আদর্শ এবং তাঁর মহান চিন্তার প্রতিফলন দেখতে পেলাম না। চলমান বিশ্বের পরিবর্তন, বিবর্তনের ছায়াও কোথায় দোলায়মান নেই। মনে হয় অভিমান করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এইসব সঙ্গে করে নিয়েই চলে গেছেন চিরতরে। তা না হলে তাঁর এই স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানটি যেটা এশিয়ায় আর দ্বিতীয়টি নেই সম্ভবত বিশ্বেই বিরল আরও চৌকস আরও মনোরম আরও পরিবেশ সৌন্দর্যমন্ডিত হতে পারত। ইউনেসকোর বিশ্ব সংস্কৃতি সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় চলে আসতে পারত কিন্তু তা হয়নি। কেন হয়নি তারও ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

বোলপুর বেশ দ্রুতবেগে নগরায়নের দিকে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের বাইরে অনেক হোটেল-মোটেল ও নতুন নতুন বাড়িঘর স্থাপিত হচ্ছে। যদিওবা আধুনিক সুযোগ-সুবিধাদি এখনো পুরোদমে চালু হয়নি। বাজার আছে, জরাজীর্ণ চা-স্টল আছে। হৈহল্লা আছে, রিকশা ও গাড়ির শব্দ আছে। রাঙা ধুলোময় গ্রাম আছে, শুকনো খোয়াই নদী আছে। নির্জন বন আছে। প্রাকৃতিক দৃশ্য ছবির মতো সন্দেহ নেই তবে ভবিষ্যতে নগরায়ণ যখন বিস্তৃত হতে থাকবে বিশ্বভারতীকে গ্রাস করে ফেলে কিনা সন্দেহ থেকেই যায়।

রবীন্দ্রনাথ জীবিতকালেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর এই আদর্শ প্রতিষ্ঠানটি বাঙালি ধরে রাখতে পারবে না। ধরে রাখার মতো কোনো উত্তরাধিকারীও তিনি তৈরি করে রেখে যেতে পারেননি। বার্ধক্যের অন্তিমকালে তিনি কি খুব বিরক্ত হয়ে পড়েছিলেন শান্তিনিকেতন নিয়ে? কারণ ১৯৩৫ সালে তাঁর জাপানি ভক্ত মাদাম তোমি কোরা (১৮৯৬-১৯৯৩) যখন শান্তিনিকেতনে যান গুরুদেবকে দেখার জন্য তখন গুরুদেব ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন আর একবার নাগানো-প্রিফেকচারের নির্জন নিরিবিলি সবুজ কারুইজাওয়া শহরে গিয়ে বাকি সময়টা কাটাতে। এখানে ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম জাপান ভ্রমণের সময় জাপান মহিলা মহাবিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সপ্তাহ খানেকের ওপর অবস্থান করেছিলেন। সেখানেই মাদাম কোরার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। মাদাম তোমি কোরার জীবনপঞ্জিতে গুরুদেবের এই অন্তিমইচ্ছের কথা উল্লেখিত আছে।

প্রথম ভ্রমণের সময় য়োকোহামা বন্দরনগরে অবস্থিত নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অমরাবতী সানকেইএন বাগান বাড়িতে তিনি প্রায় এক মাস অবস্থান করেছিলেন। সেই বাগানবাড়ির বিশাল প্রাঙ্গণে একাধিক জাপানি রীতির গৃহ ছিল বিভিন্ন নামে। রবীন্দ্রনাথ সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে শান্তিনিকেতনের গৃহগুলোর নাম রেখেছিলেন বলে তৎকালীন তাঁর ভ্রমণসঙ্গী পরবর্তীকালে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মুকুলচন্দ্র দে’র জীবনকাহিনীতে পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ জাপানে বহু কিছু দেখেছিলেন, মূল্যবান অভিজ্ঞতা ও ধারণা অর্জন করেছিলেন। জাপানি সংস্কৃতিকে শান্তিনিকেতনে প্রচলন করার জন্য ১৯০২ সাল থেকেই চেষ্টা করছিলেন। তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে বেশ কিছু শিক্ষক, চিত্রশিল্পী, গবেষক, বৌদ্ধপন্ডিত ও ক্রীড়াবিদ কলকাতা ও শান্তিনিকেতনে যান। তাঁরা সেসব শেখান এবং দুই সংস্কৃতির মধ্যে ভাববিনিময় করার প্রয়াস পান। তারই উদাহরণ হচ্ছে ‘নিপ্পন ভবন’ বা ‘জাপান ভবন’ যা ছিল রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ে গভীরভাবে লালিত একটি স্বপ্ন।

৪০ বছরের অধিককাল ধরে যিনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে গেছেন জাপান-ভারত-বাংলাদেশে সেই কিংবদন্তিতুল্য রবীন্দ্রগবেষক ও বাঙালিপ্রেমী অধ্যাপক কাজুও আজুমা (১৯৩৪-২০১১) প্রচন্ড হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে, বিপুল পরিমাণ চাঁদা সংগ্রহ করে ১৯৯৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করে দেন। আজুসা স্যার মৃত্যুর আগে একদিন তাঁর বাড়িতে আমাকে দু-তিন ঘণ্টা ধরে নিপ্পন ভবন নির্মাণের দুঃস্বপ্নময় কঠিন পরিস্থিতির ইতিহাস বলেছিলেন সেটা নিয়ে আমি দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য সাময়িকীতে একটি প্রবন্ধ লিখেছি গতবছর। নিপ্পন ভবন এখনো তেমন জমে ওঠেনি। নানা সমস্যার কথা জানা যায়। তবে এই একটি স্থানই আছে শান্তিনিকেতনের শ্রীনিকেতনে যেখানে জাপান-রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কের স্মৃতিফলক হিসেবে বর্তমান। আর কোনো স্মারক চোখে পড়েনি। আরও স্মারক রাখা উচিত শতবর্ষ প্রাচীন রবীন্দ্র-জাপান ঐতিহাসিক সম্পর্কের গুরুত্ব অনুসারে। বাঙালি স্বপ্নকে লালনপালন এবং বাস্তবায়ন করতে জানে না বিধায় তার কোনো প্রকল্পই টিকে না। জানি না নিপ্পন ভবনের ভবিষ্যৎ কেমন হবে। প্রার্থনা করি গুরুদেব ও অধ্যাপক আজুমার ভালোবাসার প্রতীকটি যেন দীর্ঘায়ু লাভ করে, অমর্যাদা না হয়।

ক্যাম্পাসে থাকে আমার অনুজপ্রতীম বন্ধু নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় যাকে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন অধ্যাপক আজুমা তাঁর বাড়িতে ২০০৩ সালে। এই একটি মানুষকে দেখলাম রবীন্দ্রনাথকে বুকে ধারণ করে কঠিন সংগ্রাম করে যাচ্ছে অসুস্থ শরীর নিয়েও। বিশ্বভারতীতে দুর্নীতি, অনিয়ম নতুন কিছু নয়। এসবের প্রতিবাদ করছে নীলাঞ্জন পত্রিকায় লিখে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছে। সাম্প্রতিককালে দু-একটি ন্যাক্কারজনক ঘটনার কথা পত্রিকান্তরে পড়ে যারপরনাই ব্যথিত হয়েছি। একটি কথাই কেবল বার বার মনে হয়, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সতিই কী বাঙালি জাতি ভালোবাসে? বিদেশিদের কাছে আজও যেমন তিনি অনুসরণীয় এবং গ্রহণযোগ্য সেখানে বাঙালিজীবনে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার কোনো প্রতিফলন আদৌ আছে কী? রবীন্দ্রআদর্শে সম্পূর্ণ বিশ্বাসী, এগিয়ে নিতে সক্ষম আন্তর্জাতিকমনস্ক শিক্ষক এই প্রতিষ্ঠানে বড় বেশি প্রয়োজন বলে অনুভব করি।

*ছবিটি নীলাঞ্জনের বাসায় গৃহীত। মেসো-মাসি এবং নীলাঞ্জনের ছোটবোনের সঙ্গে লেখকের এক অন্তরঙ্গ মুহূর্ত।