শরীয়তপুর প্রতিনিধি : নদী ভাঙ্গনের কবলে পরে গত দুই বছরে বিলীন হয়েছে শরীয়তপুরের ১৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠা প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে ১৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মাথার উপর এখনো স্থাপিত হয়নি কোন ছাদ। ফলে তারা খোলা আকাশের নিচে গাছ তলায়, সড়কে, মানুষের বাড়ির আঙ্গিনায় আবার কোথাও ছোট্ট মক্তব খানার মধ্যে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম। এতে ব্যাহত হচ্ছে শিশুদের লেখা পড়া, আর রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে অসুস্থ্য হয়ে পরছে অনেকে। ফলে প্রতি বছর শত শত শিক্ষার্থী ঝরে পরায় চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য অর্জন। 

অনেক আগে বর্ষা মৌসুম পার হলেও থেমে নেই নদী ভাঙ্গন। বর্ষাকালের সাথে পাল্লা দিয়ে শরৎ-হেমন্তেও ভাংছে নদী, ভাংছে জনবসতি। এরই সাথে বিলীন হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নতুন বছরকে সামনে রেখে ভাঙ্গন হুমকিতেও রয়েছে একাধিক স্কুল।

নদী ভাঙ্গন শরীয়তপুরের চরাঞ্চল, বিশেষ করে জাজিরা, নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের যুগ-যুগান্তরের সঙ্গী। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ১৭‘র অক্টোবর পর্যন্ত রাক্ষুসী পদ্মা গিলে খেয়েছে ১৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ২টি উচ্চ বিদ্যালয়। এর মধ্যে শুধু জাজিরা উপজেলাতেই রয়েছে ১২ টি প্রাথমিক ও ২টি উচ্চ বিদ্যালয়।

বিদ্যালয়গুলো হলো, কুন্ডেরচর কলমিরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কুন্ডেরচর সুরৎ খার কান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কুন্ডেরচর হাশেমালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বড়কান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কুন্ডেরচর ইয়াকুব মাদবরের কান্দি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কুন্ডেরচর কালু বেপারী কান্দি প্রাথমিক, জগৎ জননী প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাথালিয়া কান্দি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কুন্ডেরচর ইসমাইল মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় ও কুন্ডেরচর কালু বেপারী উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজ। নড়িয়া উপজেলার চর নড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শেহের আলী মাদবর কান্দি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঈশ্বরকাঠি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভেদরগঞ্জ উপজেলার চরভাগা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও গোসাইরহাট উপজেলার কোদালপুর ছৈয়াল পাড়া নান্নু মুন্সির কান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

এ সকল বিদ্যালয়ে অন্তত ৫ হাজার শিক্ষার্থীর ভাগ্যে এখনো জোটেনি কোন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নির্মিত হয়নি কোন গৃহ বা ইমারত। অথচ প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই ছিল ইট পাথরে নির্মিত দ্বিতল-বহুতল ভবন। নিজেদের প্রানপ্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও খেলার মাঠ হারিয়ে শিশুরা আজ বাধ্য হচ্ছে খোলা আকাশের নিচে কারো বাড়ির আঙ্গিনায়, ভাড়া ঘরে আবার কখনো গাছতলায় বা রাস্তার উপর রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিঁজে শিক্ষা গ্রহন করতে। ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে সমাপনি পরীক্ষা। দুই দিন পর শুরু হবে বার্ষিক পরীক্ষা। কিন্তু শিশুদের তেমন প্রস্তুতি নেই। তারা মনোযোগি হতে পারছেনা পড়া শুনায় এমনকি স্কুলের সাথে নিজেদের বসত বাড়ি বিলীন হওয়ায় পরিবেশও পাওয়া যাচ্ছে না উপযুক্ত লেখা পড়া করার মত।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, জাজিরা পাথালিয়া কান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একটি গ্রামীন কাঁচা সড়কের উপর খোলা আকাশের নিচে তাদের পাঠগ্রহন করছে। কালু বেপারী কান্দি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পাঁচু খাঁর কান্দি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি পরিত্যক্ত ভবনে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আর ইয়াকুব মাদবর কান্দি বিদ্যালয়ের শিশুরা ১২ হাত লম্বা ৭ হাত চওড়া একটি ছোট্ট মক্তবখানার মধ্যে কোন করমে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের পড়াশোনা।

শিক্ষক মেহেদী হাসান মিন্টু জানান, পাথালিয়া কান্দি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নদী ভাঙ্গনে স্কুল বিলীন হওয়ার আগে শিক্ষার্থী ছিল ৩ শত জনেরও বেশী। কিন্তু স্কুল ভেঙ্গে যাওয়ার পর সেখান থেকে ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পরে এখন রয়েছে মাত্র ৬০ জন।

তিনি বলেন, এই বিদ্যালয়টির একটি ঐতিহ্য ছিল। প্রতি বছর ৪-৫ জন শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেনী থেকে বৃত্তি পেত। অনেক প্রানবন্ত ছিল স্কুলটি। খেলার মাঠ ছিল। সব কিছুই সর্বগ্রাসী পদ্মা নদী গিলে খেয়েছে।

অনুরূপ তথ্য দিয়েছেন ইয়াকুব মাদবর কান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা জোনাকী আক্তার।তিনি বলেন, তাদের বিদ্যালয়ে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী ছিল। নদী ভাঙ্গনের পর প্রতিনিয়তই ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি হ্রাস পেয়ে এখন মাত্র ৬৫ জন রয়েছে। তারা জানান, নদী ভাঙ্গন রোধ করা না গেলে এ অঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।

এদিকে জাজিরার বিলাশপুর ইউনিয়নের কাজিয়ার চরে অবস্থিত ১৯৪২ সালে প্রতিষ্ঠিত ৯ নং কাজিয়ার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একই প্রাঙ্গনে অবস্থিত ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত কাজিয়ারচর ছমির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে পদ্মা নদীর ভাঙ্গন ঝুঁকিতে। এ এলাকায় প্রতি দিনই নীরব ভাঙ্গনের বিলীন হচ্ছে জনবসতি।

উল্লেখিত স্কুল দুটি থেকে মাত্র ৫০ গজ দুরে রয়েছে নদী। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী মনে করছেন, আগামী জানুয়ারী মাস নাগাদ এই দুটি বিদ্যালয়সহ কাজিয়ারচর বাজারটিও নদী ভাঙ্গনের শিকার হতে পারে। ছমির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক জি,এম সালাহ উদ্দিন ও কাজিয়ার চর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা মঞ্জিলা বেগম বলেন, তাদের বিদ্যালয় দুটির ৬টি ভবন রয়েছে। এর মধ্যে পাকা ভবন তিনটি। যে ভাবে নদী ভাঙ্গছে এবং ক্রমশই স্কুলের দিকে এগিয়ে আসছে, তাতে মনে হচ্ছে আগামী নতুন বছরে শিক্ষাদান এই স্কুলে সম্ভব হবেনা। তারা সরকারের কাছে নদী ভাঙ্গন রোধে একটি প্রতিরক্ষা বাধ নির্মানের আসু ব্যবস্থা গ্রহনের দাবি জানান।

শিক্ষার্থী আলো আক্তার, শাহীন আলম, ঈমন, রাফসান, সুহাদা, নওরিণ ও সোহাগ জানায়, তাদের খোলা আকাশের নিচে পড়া লেখা করতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিঁজে তারা প্রায়ই অসুস্থ্য হয়ে পরছে। তারা বলে, স্কুলের সাথে সাথে তাদের অনেকের ঘর বাড়িও বিলীন হয়েছে নদী ভাঙ্গনে। এখন তাদের একটাই দাবি আগের মত নতুন স্কুল নির্মান করা। শিশুদের পাশাপাশি পাথালিয়া কান্দি বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সভাপতি আক্কাস আলী মাদবর বলেন, ১৯৭৩ সালে পাথালিয়া কান্দি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়। মাত্র ১০-১২ বছর আগে সরকার এখানে একটি দ্বিতল ভবন নির্মান করে দেয়। কিন্তু চোখের সামনেই কার্ত্তিক মাসের শেষ দিকে স্কুলটি নদী ভাঙ্গনে বিলীন হয়। এতে এলাকার শত শত শিশুদের শিক্ষা জীবন বিপন্ন হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

শরীয়তপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, গত দুই বছরে জেলার তিনটি উপজেলায় প্রায় ১৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নদী গর্ভে বিলীন হওয়ায় বিকল্প ব্যবস্থায় কোন রকমে পাঠদান কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, এভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিলীন হওয়ায় আশংকাজনক হারে ঝরে পরছে শিক্ষার্থী, এমনকি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা। ফলে, সরকারি নির্দেশনা মতে শরীয়তপুরে প্রাথমিক শিক্ষাকে কাংখিক লক্ষ্যে পৌছানো যাচ্ছে না । নতুন ভবন নির্মানের ব্যবস্থা নিতে জোর চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।

(কেএনআই/এসপি/ডিসেম্বর ০৮, ২০১৭)