মৌলভীবাজার প্রতিনিধি : 'চিরচেনা সবুজের মতো মায়াবী এই শহরের চিত্র এরকম কখনো ছিলনা, এখানেই নেই কোন রাজনৈতিক বৈরিতা, আছে বহুকাল ধরে রাজনৈতিক সুস্থ সংস্কৃতির এক মহান ঐতিহ্য। আর এভাবেই এখানে বেড়ে উঠছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।' কিন্তু হঠাৎ করে সবকিছু উলটপালট করে শহরের অতীত ইতিহাসকে ম্লান করে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে এখানকার সবমহলের মানুষজনকে। রাজনৈতিক ছত্রছাঁয়ায় বাড়ছে অপরাধ, ঘটছে বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনা। নানা সময়ে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন অনেকের। প্রতিটি ঘটনা ঘটার পরে পুলিশি তৎপরতা বাড়লেও সময় বাড়ার সাথে সাথে বদলে যায় সবকিছু।

গত কয়েকমাসে মৌলভীবাজারের আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতিতে হতাশ করেছে শহরের সকল বাসিন্দাদের। জেলা শহরসহ বিভিন্ন উপজেলা জুড়ে দুর্বৃত্তদের হামলা, ছিনতাই, ডাকাতি, মাদক আগের চেয়ে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা না করায় এমন অপ্রীতিকর ঘটনা দিন দিন বাড়ছে বলে বিভিন্ন মহলের অভিমত।

জানা গেছে, প্রত্যেকটি হামলার ঘটনায় কোননা কোনভাবে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত। জেলা শহরের আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতির এই প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। বেড়ে চলেছে খুনখারাবির মত ঘটনা, বলা যায় 'হাফ মার্ডার থেকে ডাবল মার্ডার'। এসব ঘটনায় উঠতি বয়সী টিনেজারদের সম্পৃক্ততা ভাবিয়ে তুলেছে অভিভাবকসহ বিভিন্ন মহলকে। এর লেশ কিছুতেই থামানো সম্ভব হচ্ছেনা।

গত ২২ সেপ্টেম্বর রাতে ঘরে ডুকে জনপ্রিয় পৌর কাউন্সিলর স্বাগত কিশোর দাস চৌধুরীসহ একই পরিবারের ৫ জনের উপর হামলা করে ক্ষমতাশীল দলের চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা। এরপর ২৮ অক্টোবর জেলা আওয়ামীলীগের দলীয় বহুপ্রতীক্ষিত কাউন্সিল শেষে সন্ধ্যায় পৌর মেয়রের কার্যালয়সহ শহরের কয়েকটি স্থানে হামলা ও ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। ৮ নভেম্বর রাতে যুবলীগ কর্মী ও বালু ব্যবসায়ী মুহিবুর রহমান, ১৪ নভেম্বর পৌর শহরের প্রাণকেন্দ্র চৌমুহনীতে জনসম্মুখে সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আনছার আলী ও ১৬ নভেম্বর সাব-রেজিস্টার অফিসে কামালপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি রাসেল আহমদসহ ৬/৭ জন হামলার শিকার হন। ১৭ নভেম্বর শহরের ৩টি দোকানের মালামাল চুরিসহ চলতি মাসে মৌলভীবাজার-কুলাউড়া আঞ্চলিক মহাসড়কের তালতলানামক স্থানে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় নূর জাহান নামের এক মহিলার কাছ থেকে ১ লক্ষ ৭২ হাজার টাকা ছিনতাই হয়। ৯ নভেম্বর কুলাউড়া উপজেলায় বরমচাল উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা করে জয়সিং গঞ্জু (৩৩) নামের এক যুবক এবং ১১ নভেম্বর শ্রীমঙ্গলে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে ৬ ডাকাতকে আটক করে র‌্যাব। ২০ নভেম্বর সোমবার দুপুর আড়াইটার দিকে শ্রীমঙ্গল পৌর আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক অর্ধেন্দু কুমারকে ছুরিকাঘাত করে কুপিয়ে নিজ বাসার সামনে সাড়ে ৫ লক্ষ টাকা ছিনতাই করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।

অন্যদিকে কাউন্সিলরের উপর হামলার ঘটনায় জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম সুমনকে প্রধান আসামী করে আহত স্বাগত দাসের স্ত্রী জোনাকী দেব বাদী হয়ে মৌলভীবাজার মডেল থানায় মামলা দায়ের করলেও অদ্যাবধি কোনও আসামীকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ।

মুহিবুর রহমানের উপর হামলার ঘটনায় জহির হায়দার ওরফে আলীকে প্রধান আসামী করে ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হলে ৪নং আসামী শাহিন আহমদ ও আলীকে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে কিছুদিন পূর্বে পুলিশ গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠায়। কিন্তু বাকীরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আনছার আলী’র উপর হামলার ঘটনায় সাবেক ছাত্রলীগ আহবায়ক মবশ্বির আলীকে আটক করে পুলিশ।

এসব ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই সারাদেশের প্রায় সকল গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে মৌলভীবাজারের আলোচিত 'ডবল মার্ডার'। এ ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে জেলার সকল অভিভাবকসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষকে।

গত ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে শহরের সাইফুর রহমান অডিটোরিয়ামের পিছনের নির্জন জায়গায় ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার হয়ে পৌর মেয়র ফজলুর রহমান গ্রুপের দুই ছাত্রলীগ কর্মী সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ও শহরের ২৯ পুরাতন হাসপাতাল সড়কের বাসিন্দা, সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা মোঃ আবু বক্কর সিদ্দিকের কনিষ্ঠ পুত্র মোহাম্মদ আলী সাবাব (২২) ও দূর্লভপুর গ্রামের বিল্লাল হোসেনের ছেলে এবং মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী নাহিদ আহমদ মাহিরকে (১৭) ডেকে নিয়ে ছুরিকাঘাত করে কুপিয়ে নৃশংস কায়দায় হত্যা করা হয়। এঘটনার ৩ দিন পর মৌলভীবাজার মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। গত শনিবার (৯ ডিসেম্বর) রাত আটটার দিকে সন্তান হারা বাঁকরুদ্ধ নিহত সাবাবের মা সেলিনা চৌধুরী বাদী হয়ে ৩০২/৩৪ ধারায় ১২ জনকে আসামী করে একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলা নং (জিআর৭/৩৬৩)। এই মামলার ১২ আসামীর মধ্যে ইতিমধ্যে ৩ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।

রবিবার (১০ডিসেম্বর) আলোচিত এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মৌলভীবাজার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুহেল আহম্মদ মামলার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

এ মামলায় এপর্যন্ত গ্রেফতারকৃতরা হলেন- মৌলভীবাজার পৌর এলাকার বেরীরচর এর বাসিন্দা ফখরুল ইসলামের ছেলে রুবেল মিয়া (২৮), সদর উপজেলার ফতেহপুর এলাকার আনখার মিয়ার ছেলে আল জামিল (১৮) ও কুলাউড়া উপজেলার পাবই এলাকার কৌশিক দাশের ছেলে কনক দাশ (১৮)।

আলোচিত ডাবল মার্ডার মামলার সূত্রে জানা যায়, ১ ও ২ নং আসামী যতাক্রমে পৌর এলাকার বড়হাট গ্রামের সাবেক পৌর কমিশনার প্রয়াত আকিকুল হক চৌধুরীর ছেলে আনিসুল ইসলাম তুষার (২৫) ও পৌর এলাকার ধরকাপন গ্রামের আজিজুল হক বুলুর ছেলে সৈয়দ ফারদিনুল হক সৌমিক(২২) এই হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যান্য আসামিরা হলেন, পৌর এলাকার শমশের নগর সড়কের বাদশা মিয়ার ছেলে আরাফাত রহমান (২৪), রাজনগর থানার চকিরাই গ্রামের সিরাজুল ইসলাম মুক্তির ছেলে আশফাকুল ইসলাম মাহদি (১৮), মহলাল গ্রামের আইয়ুব হাসানের ছেলে তামিম হাসান (২২), সদর উপজেলার মাথারকাপন গ্রামের সৈয়দ আবু জাফর আহমদের ছেলে সৈয়দ প্রথিক (২২), সনি হায়দার, হৃদয় আহমদ, ফাহিম মুনতাসির। এ ঘটনায় অজ্ঞাত আরো ৬-৭ জনকে আসামি করা হয়েছে।

এদিকে ঘটনার সাথে জড়িত অন্য আসামিদের ধরতে খুঁজছে পুলিশ। তাদের ধরিয়ে দিলে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কারের ঘোষণাও করা হয়েছে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে।
মৌলভীবাজার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুহেল আহম্মদ জানান, গ্রেফতারকৃতদের ঘটনায় জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছ। তাদের কাছ থেকে বেশ আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। অন্যান্য জড়িতরা পলাতক রয়েছে। তাদের গ্রেফতারে পুলিশ কাজ করছে।

(একে/অ/ডিসেম্বর ১১, ২০১৭)