শামীম হাসান মিলন, চাটমোহর (পাবনা) : পাবনার চাটমোহর হানাদার মুক্ত দিবস আজ বুধবার (২০ ডিসেম্বর)। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হলেও আজকের এই দিনে হানাদার মুক্ত হয় চাটমোহর। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সারাদেশে বিজয় উৎসব পালন হলেও পাবনার প্রাচীন জনপদ হিসেবে পরিচিত চাটমোহরে তখনও হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। অবশেষে বিজয় দিবসের চারদিন পর ১৯৭১ সালের এই দিনে (২০ ডিসেম্বর) হানাদারমুক্ত হয় চাটমোহর। চাটমোহরবাসীর বিজয় উল্লাসের দিন আজ।

বুধবার চাটমোহর হানাদার মুক্ত দিবসটি পালন ও মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন উদ্বোধন উপলক্ষে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড দিনব্যাপী ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে পতাকা উত্তোলন, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পন, বর্নাঢ্য র‌্যালী, কোরআনখানি, বিশেষ দোয়া মাহফিল, বিচিত্রানুষ্ঠান, ম্যাজিক শো ও গানের অনুষ্ঠান। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমপ্লেক্স চত্বরে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন কৃষি মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আলহাজ্ব মোঃ মকবুল হোসেন এমপি।

দিবসটি উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের পক্ষ থেকে সকাল ৯টায় জাতীয় ও সাংগঠনিক পতাকা উত্তোলন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুস্পমাল্য অর্পণ এবং র‌্যালী ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার গাজী এসএম মোজাহারুল হক জানান, একাত্তরের এপ্রিল মাসে হানাদার পাকিস্তানি সেনারা পরপর দু’দফায় পাবনায় প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু ছাত্র-জনতা ও এলাকাবাসীর প্রবল প্রতিরোধের মুখে তারা ব্যর্থ হয়। পরে তারা মে মাসে আবারও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাবনা দখল করে নেয় এবং ১ মে চাটমোহর দখল করে।

শুরুতেই হানাদাররা হিন্দু অধ্যুষিত প্রাচীন জনপদ চাটমোহরের বিভিন্ন এলাকা আগুন দিয়ে ঝলসে দেয়। এরপর তারা ব্যাংক ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ ও ক্যাশিয়ার শামসুল ইসলামসহ দুজন গার্ডকে গুলি করে হত্যা করে ব্যাংকের টাকা লুট করে। এরপর তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃৃস্থানীয় ব্যক্তি রঘুনাথ কুন্ডু, অশ্বিনী কুন্ডু, যতীন কুন্ডুু ও কৃষ্ণ চন্দ্র অধিকারী ঝর ঠাকুরকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে।

তিনি জানান, শান্তিপূর্ণ চাটমোহরে পাকিস্তানি হানাদারদের বীভৎসতা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। এলাকায় শান্তি কমিটির সভাপতি ফয়েজ আহম্মেদ খান ও সেক্রেটারী নূরুজ্জামানের নেতৃত্বে¡ রাজাকারা চালাতে থাকে অত্যাচার-নির্যাতন। ফয়েজ খান সংখ্যালঘুদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করেন। এভাবেই সাড়ে ৭ মাস চাটমোহর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের কবলে থাকে। এরপর ডিসেম্বর মাসে মুক্তিযোদ্ধারা ছোট ছোট আক্রমণ চালিয়ে চাটমোহর শহরকে ঘিরে ফেলেন।

১৩ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা থানা আক্রমণ করেন। কমান্ডার মোজাম্মেল হক ময়েজ, ইদ্রিস আলী চঞ্চল ও আমজাদ হোসেন লালের নেতৃত্বে¡ মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে হানাদাররা থানার ভেতরে আটকা পড়েন।
১৫ ডিসেম্বর রাতে এক আক্রমণে বেশ কয়েকজন হানাদার নিহত হয়। পরদিন সকালে হানাদাররা রাজাকার আজ্জের আলী সহ বেশ কয়েকজন রাজাকারের সহায়তায় সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা দুই সহোদর মোসলেম ও তালেবকে প্রকাশ্যে দিবালোকে গুলি করে হত্যা করে। অবস্থা বেগতিক বুঝে হানাদাররা ১৪ ডিসেম্বর থেকে গোলাগুলি বন্ধ রাখে এবং থানায় সাদা পতাকা উড়িয়ে মিটিংয়ের আহ্বান জানায়।

১৮ ডিসেম্বর হানাদারদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা থানায় প্রবেশ করে আলোচনায় বসেন। হানাদাররা মুক্তিবাহিনী নয়, মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের শর্ত দেয়। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা আক্রমণ বন্ধ রেখে ২০ ডিসেম্বর পাবনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রফিকুল ইসলাম বকুলকে মিত্রবাহিনীর পোশাক পরিয়ে নকল মিত্রবাহিনী সাজিয়ে চাটমোহরে নিয়ে আসেন। এদিন সকাল ১১টায় তার কাছেই ২২ জন হানাদার বাহিনীর সদস্য আত্মসমর্পণ করে। এভাবেই বিজয় দিবসের ৪ দিন পর আজকের এই দিনে হানাদারমুক্ত হয় চাটমোহর। সেই থেকে ২০ ডিসেম্বর চাটমোহর মুক্ত দিবস পালন হয়ে আসছে।

(এসএইচএম/এসপি/ডিসেম্বর ২০, ২০১৭)