রাজশাহী প্রতিনিধি : যে মাদকে ফুলে ফেঁপে ওঠা সে মাদকেই জিম্মি এখন রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানার মাদক ব্যবসায়ীরা। বাদ পড়েনি নীরিহ সাধারণ জনগণও। অভিযোগ উঠেছে, লোকজনকে জিম্মি করতে মাদক ফাঁদ পাতছেন গোদাগাড়ী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিপজুর আলম মুন্সি। গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর দায়িত্বভার নেয়ার পর থেকেই এ কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন তিনি।

ফাঁদে ফেলে প্রতি রাতেই আদায় করছেন ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। বড় বড় চালান ধরে মাদক ব্যবসায়ীদের আদালতে তুলছেন পুলিশ আইনের ৩৪ ও ২৬ ধারায়। ফলে নামমাত্র জামিনে বেরিয়ে এসে ফের দেদারছে কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন মাদক ব্যবসায়ীরা। এতে মুখ থুবড়ে পড়েছে সরকারের মাদকের জিরো টলারেন্স নীতি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাদক পাচার ও চোরাচালানের সবচেয়ে বড় ট্রানজিট গোদাগাড়ী। সীমান্তের ওপারের ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা থেকে প্রতিদিনই মাদকের বড় বড় চালন আসছে এখানে। ওপারের লালগোলা ছাড়াও ভগবানগোলা, রানীতলা, খেজুরতলা, মিঠাপুর, পিরোজপুর ও জঙ্গিপুরে তৈরি হচ্ছে হেরোইনের মত ভয়ংকর মাদক।

সহজলভ্য হওয়ায় এখানকার হাজারো বাসিন্দা জড়িয়ে পড়েছে অবৈধ এ কারবারে। স্বল্প সময়ে শূন্য থেকে কটিপতি হয়েছেন এখানকার হাজারের বেশি মানুষ। গোদাগাড়ী থানা পুলিশের সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে তাদের। এদের কাছ থেকে মাসিক মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে মাদক ব্যবসা চালানোর সুযোগ দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে।

গোপন সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতার ও হয়রানি এড়াতে মাদক ব্যবসায়ীরা ওসির সঙ্গে মাসিক চুক্তিতে যান। ৩০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা করে প্রতি মাসে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিচ্ছেন ওসি। অভিযোগ রয়েছে, ভারতীয় মাদক ডনদের সঙ্গেও রয়েছে ওসির সখ্যতা। নিয়মিত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন তিনি। দেশি মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তাদের পাওনা টাকাও তুলে দেন ওসি।

ওসির এসব কর্মকাণ্ড নিয়ে নভেম্বরের জেলা আইন-শৃংখলা কমিটির সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন গোদাগাড়ী পৌর মেয়র মনিরুল ইসলাম বাবু। গত ১০ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসকের দফতরে ওই সভা অনুষ্ঠিত হয়। এর চারদিন পর ১৪ ডিসেম্বর ওসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশ প্রধান, পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি ও জেলা পুলিশ সুপার বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন মেয়র।

দীর্ঘদিন ধরেই মাদক কানেকশনে বিতর্কিত ওসি হিপজুর। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনেও উঠে আসে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য। তারপরও বহাল তবিয়তে ওসি। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় পুলিশের কতিপয় শীর্ষ কর্মকর্তার মদদেই বেপরোয়া হিপজুর আলম। ফলে অভিযোগের পাহাড় জমলেও তাতে কান দেননি জেলা পুলিশ সুপার ও রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি। তবে সর্বশেষ লিখিত অভিযোগ পেয়ে তদন্ত শুরুর নির্দেশ দেন ডিআইজি।

তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত ডিআইজি নিশারুল আরিফ বলেন, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তির সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। তদন্ত শেষে শিগগিরই সুপারিশসহ ডিআইজি বরাবর প্রতিবেদন দেবেন তিনি। এরপরই ব্যবস্থা নেবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।

গোদাগাড়ী পৌর মেয়র মনিরুল ইসলাম বাবু বলেন, প্রতি রাতে মাদক ব্যবসায়ীদের থানায় ধরে এনে মামলার ভয় দেখিয়ে ওসি ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা আদায় করছেন। আবার সাধারণ নিরীহ মানুষকেও মাদক ব্যবসায়ী বানিয়ে বিপুল অর্থ আদায় করছেন। কেউ টাকা না দিলে তাকে ৩৪ ধারায় মামলা দিয়ে চালান করা হয়। নকল হেরোইন দিয়ে মাদকের মামলায় ফাঁসানো হয়। এ অবস্থা চলছে বছরখানেক ধরেই।

মেয়রের অভিযোগের সত্যতা মিলেছে ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৭ সালের ১৬ আগস্ট পর্যন্ত পুলিশের হাতে গ্রেফতারকৃত ২৬ ও ৩৪ ধারায় আদালতে চালানকৃত আসামীদের তালিকায়। তথ্য অধিকার আইনে করা আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ২১ সেপ্টেম্বর ওই তথ্য সরবরাহ করে জেলা পুলিশ।

ওই তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, ওই সময় গোদাগাড়ী মডেল থানায় গ্রেফতার হয়েছে ১১৯ জন। আইনত এরা প্রকাশ্যে মাতলামির দায়ে গ্রেফতার হয়েছেন। কিন্তু আসলে তারা মাতাল নন, মাদক কারবারী। এদের মধ্যে অন্তত ২০ জন বড় মাপের মাদক ব্যবসায়ী। এছাড়া ২০ জন মাঝারি ও ১০ জন খুচরা মাদক ব্যবসায়ী রয়েছেন। বাকিরা বাহক।

অভিযোগ রয়েছে, থানা পুলিশকে অন্তত তিন লাখ টাকা করে দিয়ে ‘মাতাল’ হয়েছে এসব ব্যবসায়ী। এছাড়া দুই লাখ টাকা দিয়ে ১০ গ্রাম এবং এক লাখ টাকা দিয়ে ২০ গ্রাম হেরোইনসহ আদালতে গেছেন এমন মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যাও কম নয়। বিপুল পরিমাণ মাদকসহ গ্রেফতার হয়েছেন এরা।

কেবল গ্রেফতারই নয়, মোটা অংকের অর্থ নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে এমন মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যাও কম নয়। নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র বলছে, এ বছরের ১৭ জানুয়ারি রাতে উপজেলার আঁচুয়াভাটা এলাকার শহীনের বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। এসময় বাড়ির ছাদ টপকে পালিয়ে যান শাহীন। ওই সময় তার বাড়িতে ছিলো ১২ প্যাকেট হেরোইন। ধরাপড়ার আগেই ৯ প্যাকেট শৌচাগারের ঢেলে দেন শাহীনের স্ত্রী। তাকে আটক করা হয় ৩ প্যাকেটসহ। জব্দ করা হয় হেরোইন বিক্রির ৮ লাখ টাকা। পরে আরো ৫ লাখ টাকা নিয়ে শহীনের স্ত্রীকে তখনই ছেড়ে দেয় পুলিশ।

এদিকে, গোদাগাড়ী মডেল থানা পুলিশের আটক বাণিজ্য নিয়ে এবছরের ১৩ মার্চ পুলিশ প্রধান বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন এলাকাবাসী। গোদাগাড়ী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিপজুর আলম মুন্সি, উপপরিদর্শক আহসান হাবিব, আব্দুল করিম, আব্দুর রাজ্জাক ও নূর ইসলাম এ অর্থ বাণিজ্যে জড়িত বলে উল্লেখ করা হয় ওই অভিযোগে। এতে থানার দালাল রফিকুল ইসলাম রফিক, মোফাজ্জল হোসেন মোফা, মোত্তাসিন, কাজল ও রানার বেপরোয়া চাঁদাবাজির অভিযোগ করা হয়।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন ওসি হিপজুর আলম মুন্সি। তিনি বলেন, বিধি মেনেই তারা অভিযান চালিয়েছেন। মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পুলিশের কোনো সখ্যতাও নেই। একটি পক্ষ তার উপর ক্ষুদ্ধ হয়ে এসব অভিযোগ করছেন।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ওসি হিপজুর আলম মুন্সির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে তা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নজরে এনেছেন তারা। তারাই ব্যবস্থা নেবেন।

যদিও শুরু থেকেই ওসির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন রাজশাহীর পুলিশ সুপার মোয়াজ্জেম হোসেন ভূঁইয়া।

তিনি বলেন, আমরা গোদাগাড়ীর মাদককে জিরো টলারেন্সে নিয়ে আসতে কাজ করে যাচ্ছি। তবে শীর্ষস্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীরা এখনো গ্রেফতার না হওয়ায় সেটি করতে গিয়ে অনেকটা বেগ পেতে হচ্ছে। তারপরও আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

(ওএস/এসপি/ডিসেম্বর ২২, ২০১৭)