কবীর চৌধুরী তন্ময়


খুব ছোটকাল থেকেই মা-খালার মুখে শুনতাম, লেখা করে মানুষের মতন মানুষ হতে হবে। ভালো স্কুলে ভর্তি হতে হবে। ভালো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে। আর তাই প্রত্যেক বাবা-মা তাদের স্বাধ্যমত সন্তানদের ভালো স্কুলে ভর্তি করানোর চেষ্ঠা করে। অভিভাবকদের এতো এতো চেষ্ঠা আজ বিফলে যাচ্ছে শুধু শিক্ষা পদ্ধতি ও ভঙ্গুর শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে। শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় আজ মেরুদন্ডহীন হয়ে পড়েছে। যেখানে শিক্ষামন্ত্রণালয়ই মেরুদন্ডহীন, সেখানে শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড হবে কীভাবে?

কিছুদিন আগে পাঠ্যপুস্তকে এই জনের লেখা থাকবে না, আবার ঔজনের কবিতা থাকবে-এই বিতর্ক নিয়ে গোটা দেশের মানুষের মাঝে অস্বস্থিকর পরিস্তিতি বিড়াজ করেছিল। আমাদের মাঠ পর্যায় নেমে পাঠ্যপুস্তক সাম্প্রদায়িকমুক্ত করণের দাবি নিয়ে আন্দোলন পর্যন্ত করতে হয়েছে। নানা সমালোচনার মধ্যে কিছুটা উদ্যোগ নিলেও এখনো পাঠ্যপুস্তক সাম্প্রদায়িকতার অদৃশ্য ছোবল থেকে মুক্ত হতে পারেনি।

অন্যদিকে কওমী মাদ্রাসার অবস্থা আরও বেহাল। সেখানে তো সরকার ঠিকভাবে হাত পর্যন্ত দিতে পারছে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন জেলার কওমী মাদ্রাসার প্রতিনিধির সাথে মিটিং করে বুঝেছি, যে অন্ধকার-কুসংস্কার আর অপসংস্কৃতির সফটওয়্যার কিছু প্রতিনিধির মাথায় ইনস্টল হয়ে আছে, তা সহসায় রিমুভ করা সম্ভব নয়। খেলাধুলায় এই হারাম, সেই হারামের মাঝে বছরে প্রায় ১৪ লাখের বেশি শিক্ষার্থী আজ বড় হচ্ছে নানান কুসংস্কারের সফটওয়্যার মাথায় সেট নিয়ে। তাহলে ভবিষ্যত..? এটি সত্যিই সরকার ও সমাজ-রাষ্ট্রের সচেতন মহলের জন্য অত্যন্ত কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে!

আবার শিক্ষামন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রশ্নবিদ্ধ পরিক্ষার পদ্ধতি ও একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস আদৌ রোধ করা সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে স্যোশাল মিডিয়াতে অনেকে ব্যঙ্গ করে বলেছে, বই খুলে পরিক্ষা গ্রহণ করে নিলেই তো হয়! শুধু-শুধু শিক্ষার্থী কষ্ট করে কী শিখেছে তার ব্যাখ্যা বা প্রমাণ দেওয়ার কী প্রয়োজন?

প্রশ্নপত্র ফাঁস শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি এখন প্রাথমিক স্তর হতে শুরু হয়েছে। এই যে নাটোর সদর উপজেলার আগদিঘা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির গণিত পরীক্ষা বাতিল, এর আগে দ্বিতীয় শ্রেণির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস! আবার এটি জানাজানি হবার পর বরগুনার বেতাগী উপজেলার ১৪০টি বিদ্যালয়ের পরীক্ষা স্থগিত-এই ধরনের সংবাদগুলো জাতির জন্য সত্যিই লজ্জার এবং ভয়াবহ অবস্থা। আর এটি ছড়িয়ে আজ চাকুরি নিয়োগ পরিক্ষার ক্ষেত্রেও সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু এই প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা যাচ্ছে না কেন? যারা এই ফাঁসের সাথে জড়িত তারা কী শিক্ষামন্ত্রণালয় বা সরকারের চেয়েও বেশি শক্তিশালী? নাকি মন্ত্রণালয়ের লোকবল এই অপকর্মের সাথে জড়িত? আমার প্রশ্নটা উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ আছে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ একের পর এক শিক্ষামন্ত্রণালয় ও সরকারের নাকের ডগায় আঙ্গুল রেখে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ও চাকুরির নিয়োগ পরিক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে যাচ্ছে। আইন আদালত বা জেল-জরিমানা কোনো কিছু মানা-অমানা বা ভয়-ভীতির তোয়াক্কা করছে না প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে সম্পৃক্ত মহল। আর সে কারণেই মাঝে মাঝে ভাবি, তারা না জানি কত্ত বড় শক্তিশালী!

প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধকরণে সরকারের মহল থেকে নানামুখী উদ্যোগের কথা বলা হলেও বাস্তবতা আমাদের সবার অজানা নয়। আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যখন প্রথম শ্রেণি থেকেই ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্র দিয়ে পরিক্ষা সম্পন্ন করে তখন ভবিষ্যত সত্যিই কঠিন হুমকির মুখে; এটা জাতির দুশ্চিন্তার বিষয়। আর বার বার কারা সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে এবং সরকার প্রধানকে বিতর্কিত করার লক্ষে একের পর এক পরিক্ষা-চাকুরির প্রশ্নপত্র ফাঁস করার মত রাষ্ট্রীয় অপরাধের সাথে জড়িত, তাদের খুজে বের করা এবং দৃষ্টান্ত শাস্তি নিশ্চিত করা এখন সরকারের প্রায়োরিটি ভিক্তিক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের শিক্ষা সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক দলের অনুসন্ধানী এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ সরকারি প্রেস (বিজি প্রেস), ট্রেজারি ও পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে কোচিং সেন্টার, প্রতারক শিক্ষক ও বিভিন্ন অপরাধী চক্রও যুক্ত থাকতে পারেন বলে দুদকের তদন্তকারীদের ধারণা বলে উল্লেখ করেছে।

এবং দুদকের ওই প্রতিবেদন দেওয়া হয় সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে, যেখানে প্রশ্ন ফাঁস, নোট-গাইড, কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণ, এমপিওভুক্তি, নিয়োগ ও বদলির ক্ষেত্রে দুর্নীতি রুখতে ৩৯ দফা সুপারিশও করা হয়েছে।

আবার দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন টিআইবির একটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় ৪০টি ধাপে প্রশ্ন ফাঁস হয়। যেমন প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশন, বিজি প্রেসে কম্পোজ, প্রুফ দেখা, সিলগালা করা ও বিতরণ এবং পরীক্ষার দিন কেন্দ্রে অসাধু শিক্ষকের মাধ্যমেও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। আর এ কারণেই শুধু প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে শিক্ষাবোর্ড, মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি, কোচিং সেন্টার, গাইড বই ব্যবসায়ী ও সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের অনেকে সরাসরি জড়িত। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে আকারভেদে ২০ টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থের লেনদেন হয় বলে টিআইবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ নিয়ে শিক্ষামন্ত্রণালয় ও সরকারের নানা কথা, বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের পরেও এগিয়ে যাচ্ছে প্রশ্নপত্র ফাঁসকৃত ব্যক্তি-মহল। সেই সাথে সুকৌশলে পাঠ্যপুস্তক সাম্প্রদায়িককরণও হচ্ছে সমান তালে...! সাম্প্রদায়িক আর মৌলবাদ অপশক্তি শিক্ষামন্ত্রণালয়কে কীভাবে গিলে ফেলেছে তার কিছুটা নমুনা দেখা গেছে গত ১৮ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকার আদলে তৈরি করা একটি কেক কাটার মতন ঘটনার মাধ্যমে।

ঘটনাটি-বিজয় দিবস উপলক্ষে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। পুরো অনুষ্ঠান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট ঢাকার সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীর উপস্থিতিতে ওই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। নির্ধারিত অনুষ্ঠান শেষে উপস্থিত সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে করতে চা চক্রে হাজির হন মন্ত্রী। ঠিক এসময় অনুষ্ঠানস্থলে হাজির করা হয় জাতীয় পতাকার আদলে তৈরি করা বিশাল আকারের একটি কেক। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পূর্তি উপলক্ষে কেকটি আনা হয়েছে উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রীকে এটি কাটার অনুরোধ করেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশি’র কর্মকর্তারা। কিন্তু কেকটি দেখেই প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হন শিক্ষামন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমাকে জাতীয় পতাকার আদলে কেক কাটতে বলছেন? আমি জাতীয় পতাকা কাটবো?’

শিক্ষামন্ত্রী ক্ষিপ্ত হয়ে এও বলেন, ‘কেকে কেন জাতীয় পতাকা? আমি কি জাতীয় পতাকা কাটতে এসেছি? এই আইডিয়া কার? কে অর্ডার দিয়ে এই কেক বানিয়েছেন? একজন মন্ত্রী হয়ে আমি কি জাতীয় পতাকা কাটতে পারি? এই কাজের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের শাস্তি পেতে হবে বলে যারা এই কাজের সাথে সম্পৃক্ত তাদের খুঁজে বের করতে মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখার অতিরিক্ত সচিব আমিনুল ইসলামকে নির্দেশও দিয়েছেন।

পাঠাক! একবার চিন্তা করে দেখুন, শত সহস্র অপচেষ্টা করেও স্বাধীনতাবিরোধী ও তাদের দোসর মহল দেশটাকে দ্বিখন্ডিত করতে পারেনি। কারণ বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতায় ও নেতৃত্বে। তাই সুকৌশলে দেশের পতাকা দ্বিখন্ডিত করার মাধ্যমে তারা তাদের মনের খায়েশ পুরণ করার চেষ্ঠা করেছিল। আরও একটু গভীর ভাবে ভেবে দেখুন, আজ যদি তাদের পাকিস্তানী প্রেতাত্মা শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকতো তাহলে দেশ ও জাতির কী ভয়াবহ পরিণতি হতো?

না! এখানে শিক্ষামন্ত্রী অসহায় নয়। সরকার ও দেশের জনগণ তার পাশে আছে। শিক্ষাই যদি জাতির মেরুদন্ড হয় তাহলে সবার আগে শিক্ষামন্ত্রীর মেরুদন্ড শক্ত করতে হবে। তাহলে শিক্ষামন্ত্রণালয় আর মেরুদন্ডহীন হয়ে পড়বে না। সাম্প্রদায়িক অপশক্তির কালো ছায়া থেকে শিক্ষার পরিবেশ রক্ষা করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকসহ পুরো মন্ত্রণালয়কে সাম্প্রদায়িকমুক্ত করতে হবে। আর যারা সুকৌশলে দেশের পতাকা দ্বিখন্ডিত করার মাধ্যমে দেশটাকে মনে-মনে দ্বিখন্ডিত করার চেষ্ঠা করেছিল তাদের দৃষ্টান্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে বর্বর পাকিস্তানীদের পরাজয় নিশ্চিত; এটি জানার পর স্বাধীন পরবর্তী বাংলাদেশ যাতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে তাই পরিকল্পিতভাবে রাজাকার, আলসামস, আলবদর বাহিনী দেশের বুদ্ধিজীবীদের খুজে বের করে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যখন বিশ্ব জয়ের কাছাকাছি; এখন আবার শুরু হয়েছে দেশের মেধা বিকাশের ক্ষেত্রকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরিক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, চাকুরির নিয়োগ পরিক্ষা পশ্নপত্র ফাঁসসহ সুকৌশলে পতাকা কাটার মাধ্যমে দেশকে দ্বিখন্ডিত করার মনবাসনা।

যত দ্রুত সম্ভব সরকারের উচিত হবে প্রায়োরিটি ভিত্তিতে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের প্রতি নজর দেওয়া। ব্যক্তি ধরে ধরে তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক অবস্থা ও শিক্ষাকতাযোগ্যতা যাচাই-বাচাই করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। অন্যথায় ষড়যন্ত্রকারীরা ষড়যন্ত্র করবে, লুটপাটকারীরা নিজেদের পকেট ভারী করবে, দলীয় ও সরকারের নাম বিক্রিয়কারীদের আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হবে। বেলা শেষে শেখ হাসিনা হবে বিতর্কিত। আর তাঁর অর্জন হবে ভিতর থেকে ঘুণে খাওয়া নড়বড়ে। ধ্বংস হবে জাতি ও তার মেরুদন্ড!

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিষ্ট ফোরাম (বোয়াফ)।