শিতাংশু গুহ


শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে ধন্যবাদ। তিনি একটি সত্য ভাষণ দিয়েছেন। সত্য কথা সবাই বলতে পারেন না, শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, এজন্যেই তিনি ধন্যবাদার্হ। অনেকেই এখন তার পদত্যাগ চাইছেন, সেটা স্বাভাবিক। আসলে তার পদোন্নতি চাওয়া দরকার। কিছুদিন আগে পাঠ্যবই হেফাজতীকরণ নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে আমার যত রাগ ছিলো এবারকার বক্তব্যের পর তা 'অনুরাগে!' পরিণত হয়েছে? অনেকে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের অনেক রকম ব্যাখ্যা করছেন। মূলত: তার কথার একটিই তাৎপর্য, সেটি হচ্ছে, 'ঘুষ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়'। প্রবাদ আছে, 'যা ঠেকানো যায়না, তা মেনে নেয়াই ভালো'। সূতরং ঘুষের  সরকারিকরণ হউক। তবে সহনীয় পর্যায়ে, যেমনটি শিক্ষামন্ত্রী পরামর্শ দিয়েছেন। ধরুন, পোশাকের ওপর ট্যাক্স আছে ৮%, তেমনি ঘুষও ৮-১০% করে দিলে কেমন হয়? আর ঘুষ শব্দটি শুনতে ভালো লাগেনা। হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, সাম্প্রদায়িকতাকে ভদ্রজ্বনিত করার জন্যে 'বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ' আমদানি হয়েছে, ঠিক তেমনি ঘুষকে ডিজিটাল করে এর নুতন নাম দেয়া যায়, 'সার্ভিস চার্জ'।  

শিক্ষামন্ত্রী দেখলাম মিডিয়ার ওপর দোষ চাপিয়ে কিছুটা পার পেতে চাচ্ছেন। আজকাল টেকনোলজির কারণে সেই সুযোগ নেই, মিডিয়া ভিডিও-তে সব ফাঁস করে দিচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী অন্যায় করেছেন, তিনি সবাইকে ঢালাওভাবে 'চোর' বলেছেন। প্রথমত: সবাই চোর নন, দেশে এখনো কিছু ভালো মানুষ আছেন, যদিও তাঁদের দুর্দশার কোন কমতি নেই? তদুপরি দেশে এখন ছিচ্কে চোর অপেক্ষা ডাকাতের সংখ্যা বেশি, শিক্ষামন্ত্রী ডাকাতদের চোর বলে তাদের মর্যাদায় আঘাত হেনেছেন। এটা অন্যায়। ডাকাতরা এতে দু:খ পেয়েছেন। ডাকাত-কে চোর বললে দু:খ পাবারই কথা। তদুপরি তিনি কাউকে 'দস্যু' বলেননি? অথচ দেশে ভূমিদস্যু বা অর্থদস্যূর কোন ঘাটতি নেই? তবে শিক্ষামন্ত্রী যে নিজেও 'চোর' এই সত্য স্বীকার করার জন্যে আবারো ধন্যবাদ। আগে বাম-দের একটা মান-ইজ্জত ছিলো, ইনু-দিলীপ-নাহিদ বা এমনকি 'অগ্নিকন্যা' মিলে সেটা ধূলিসাৎ করে দিয়েছেন। সদ্য বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক ঘেরাও কর্মসূচী পালন করেছে বলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, সিপিবি-বাসদকে 'ননসেন্স' বলেছেন।

সেই পুরানো দিনের গান, 'দুনিয়া মে সব চোর হ্যায়' অনেকের মনে থাকার কথা। অর্থাৎ সব চোর খারাপ না? চোরের মধ্যেও ভালো-খারাপ আছে, যেমন রবীন হুড, চুরি করেই তিনি বিখ্যাত। আবার যেমন দাগী চোর সিলেটের রাগীব আলী? হিন্দু'র সম্পত্তি চুরি করে উনি দাতা 'হাজী মোহসীন' সেজেছিলেন? পুলিসহ তাকে সেলাম করে। আগে চোরেরা পুলিশ দেখলে ভয় পেতো, এখন রাগীব অলিদের পুলিশ ভয় পায়! আগে চোরেরা ছিলো এনালগ, এখন বড় বড় চোরেরা সবাই ডিজিটাল। আগে চোরেরা চুরি করতো গৃহস্থের বাড়িতে, এখন চুরি হয় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে, ব্যাঙ্কে বা ষ্টক মার্কেটে। আগে চুরি হলে গৃহস্তের ক্ষতি হতো, এখন ক্ষতি হয় রাষ্ট্রের। তবে আশার কথা, অর্থমন্ত্রী বলেছেন, '৪হাজার কোটি টাকা কোন টাকাই নয়'? মনে পড়ে জিয়া বলেছিলেন, 'মানি ইজ নট এ প্রবলেম'। আসলে বাংলাদেশে এখন টাকা কোন সমস্যা নয়, সবাই ধনী? তবে কিভাবে ধনী, সেই হিসাব দেয়ার যোগ্যতা অধিকাংশের নেই? কিন্তু ধরবে কে? সর্ষের মধ্যেই তো ভুত?

স্কুলে থাকতে 'চোর' রচনা পড়েছিলাম। চুরি করে ধরা পরে এক চোর বেদম মার্ খায়। বাবার কোলে ছোট্ট একটি মেয়ে চোর দেখতে এসে বলে, 'ওমা, চোর তো মানুষ'। চোর তার আত্মচরিতে বলে, 'এত মার্ খেয়েও চোখে জল আসেনি, কিন্তু বাচ্চা মেয়েটির কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ি'। আগেকার দিনের চোরেরা মানুষ ছিলো, এখনকার চোরেরা অ-মানুষ? আগে চোরেরা চুরি করতো পেটের দায়ে, এখন চুরি করে বড়লোক হবার জন্যে বা নির্বাচন করতে? আগে চোরের বাড়িতে লোকে আত্মীয়তা করতো না, এখন চেয়ারটা এগিয়ে দেয়। আগে চোরেরা কথা বলতো না, এখন চোরেরা নির্লজ্জ্ব, দেদার কথা বলে, অন্যকে উপদেশ দেয়? প্রবাদ ছিলো, চোরের বাড়িতে দালান উঠে না' এখন চোরদের বাড়ি অট্টালিকা! একদা এক পত্রিকা বিশাল হেডিং করেছিলো, 'দেশের অর্ধেক মানুষ চোর'। এতে হৈচৈ পরে যায়, প্রতিবাদ ওঠে। পত্রিকা পরদিন হেডিং করে, 'দেশের অর্ধেক মানুষ চোর না'। কথাই একই, স্বীকার করুন আর না করুন, 'দেশে ধার্মিকের সংখ্যা বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চোরের সংখ্যা'? সবাই হালাল ফুড খোঁজে, কিন্তু হালাল রোজগারের কথা ভাবেনা?

শিক্ষামন্ত্রীর কথায় আমাদের মন্ত্রীরা কিন্তু তেমন উচ্চ্যবাচ্য করছেন না? তারা বুদ্ধিমান। অনেকদিন আগে এক নির্বাচনী এলাকায় মানুষ একবার এক চোরকে নির্বাচিত করে। পাঁচ বছর চোর তার নিজের জন্যে, পরিবারের জন্যে, আত্মীয়-স্বজনদের জন্যে চুরি করে বিশাল সম্পদের মালিক হন। নুতন নির্বাচন এলে চোর আবার প্রার্থী হন? সবাই একটু অবাক হয়? নির্বাচনী প্রচারণাকালে চোর সবাইকে বোঝায় যে, "গত পাঁচ বছর আমি আমার জন্যে সবকিছু করেছি, জনগণের জন্যে কিছু করি নাই, এবার আমি নির্বাচিত হলে জনগণের জন্যে কাজ করবো'। তিনি জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, ভোটাররা যদি তার প্রতিদ্ধন্ধী ছককু মিয়াকে নির্বাচিত করেন, তাহলে ছককু মিয়া আগামী পাঁচ বছর নিজের জন্যে সবকিছু করবেন, জনগণ কিছু পাবেন না? তাই জনগণের উচিত চোরকেই নির্বাচিত করা, কারণ তার আর কিছুর প্রয়োজন নেই, তিনি শুধু জনতার জন্যে কাজ করবেন। বলা বাহুল্য, চোর পুন্:নির্বাচিত হন? পাঠক, ছককু মিয়া নামে এক ব্যক্তি সম্ভবত: ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিলেন। তিনি জেতেননি।

যাহোক, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, দেশ স্বাধীন করে আমি পেয়েছি, 'চোরের খনি' বা 'চাটার দল সবকিছু খেয়ে ফেলে' অথবা আমার কম্বলটি কই'? অর্থাৎ চুরি আগেও ছিলো, এখনো আছে। চুরি আমাদের মজ্জাগত। গত দশ বছরে নাকি সাড়ে তিন লক্ষ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। যারা করেছেন, তারা চোর না ডাকাতও না, দস্যু? তাই, শিক্ষামন্ত্রীর কথায় সরকারের ভাবমুর্ক্তি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বলে যারা মন্তব্য করছেন, তা ঠিক নয়? চুরি করলে যদি সরকারের ভাবমুর্ক্তি ক্ষুন্ন না হয়, চুরির কথা বললেও হবেনা। শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ করার দরকার নেই? হাসানুল হক ইনুও করেননি? সুপ্রিমকোর্টে দণ্ডিত দুই মন্ত্রীও না! পদত্যাগ আমাদের ঐতিহ্য নয়? কারণ পদত্যাগ করলে নুতন যিনি আসবেন, তিনি যে 'ধোঁয়া তুলসীপাতা' হবেন, এর গ্যারান্টি কোথায়? মনে পড়ে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে, তাকে ছাড়া সবাইকে কেনা যায়? কথাটা কি খুব অসত্য? কথা হলো, ঘুষ খায় না কে? কত টাকা খায় না?

একটি গল্প দিয়ে শেষ করি, গল্প নয় সত্যি। বাংলাদেশে একদা 'সোর্ড ব্লেড' ছিলো, এখন আছে কিনা জানিনা। স্বাধীনতার পর তা বিক্রী হতো সম্ভবত: ১০পয়সা। এর মালিকানা ছিলো আজিজ মোহাম্মদ ভাইদের। সম্ভবত: ১৯৭৩ সালে মালিকের ইচ্ছা হলো সোর্ড ব্লেডের দাম বাড়িয়ে ১টাকা ১০ পয়সা করার। হামিদ সাহেব (নামটা সঠিক নাও হতে পারে) তাদের জেনারেল ম্যানেজার, গল্পটা তার মুখ থেকেই শোনা, কেননা পরে তিনি আমাদের জেনারেল ম্যানেজার হন? দাম বাড়াতে যা যা করা দরকার সবই করা হলো, সর্ব-মহলে তা পাশ হলো। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সেক্রেটারী রাজি হলেন না? তিনি সৎ, ঘুষ খান না? আজিজ মোহাম্মদ ভাই বললেন, কত টাকা খান না? তিনি জানতে চাইলেন, ব্লেডের দাম ১টাকা বাড়লে এক বছরে কত টাকা লাভ হবে? একাউন্টস হিসাব দিলো ২৫লক্ষ টাকা। আজিজ মোহাম্মদ ভাই বললেন, ২৫ লক্ষ টাকা নিয়ে সেক্রেটারীর সাথে দেখা করুন। হামিদ সাহেব তাই যান, সেক্রেটারীকে বলেন, যত টাকা চান তাই দেবো। উনি রাজি হন, ব্লেডের দাম বাড়ে।

লেখক : কলাম লেখক