জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল


আজ ১ জানুয়ারি। ইংরেজি নববর্ষ। নিউ ইয়ার। আমরা বাঙালিরা ১ জানুয়ারিকে পয়লা জানুয়ারি বলতে- লিখতে পারিনা; কেমন যেন উঁসখুস লাগে, বাঙালিত্বে আঘাত লাগার মতো। ১ জানুয়ারিতে প্রায় সব দেশেই জাঁকজমক উৎসব হলেও দিনটা কিন্তু সর্বত্র ‘নিউ ইয়ারস ডে’ নয়। মূলত খ্রিস্টান অধ্যুষিত এবং ইংরেজি ভাষাভাষি দেশ যেমন ইংল্যান্ড-আমেরিকায় ১ জানুয়ারি মানেই নিউ ইয়ারস ডে। কিন্তু আরব দেশে ১ জানুয়ারিতে হিজরি অর্থাৎ নববর্ষ শুরু হয় না। ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা কিংবা তিউনিসিয়ায় নতুন বছর শুরু আগস্ট থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে। নভেম্বরে এবং মার্চ মাসে যথাক্রমে চীন আর ইতালিতে নববর্ষ শুরু হয়। অথচ ১ জানুয়ারি অর্থাৎ ইংরেজি নববর্ষ মহাসমারোহে উদযাপিত হয় পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র।

ইংরেজি নববর্ষ বলে ১ জানুয়ারির সঙ্গে একটা খ্রিস্টান-খ্রিস্টান ব্যাপার- স্যাপার জড়িয়ে আছে। অথচ বিশ্বের তাবৎ ইতিহাসবিদরা অনেক খুঁজেও ১ জানুয়ারির সঙ্গে যিশু, বাইবেল বা ওই ধর্মের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাননি। যদিও সুনির্দিষ্ট তারিখ ছাড়া ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও রীতিনীতিগুলো পালন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং ভুলবশত ও মিথ্যাচারের জন্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। তাই ধর্মের সঙ্গে বর্ষপঞ্জির সম্পর্ক নতুন কিছু নয়। পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম থেকেই তা পরিলক্ষিত হয়। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও রীতিনীতিগুলো সুনির্দিষ্ট তারিখে পালিত হয় বলেই বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা নিজ ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে বর্ষপঞ্জি প্রণয়ন করেছেন। ওই বর্ষপঞ্জির সপ্তাহ বা মাস নির্ধারণ অথবা বছরের শুরু বা সমাপ্তি হিসাব করা হয় সাধারণত চন্দ্র ও সূর্যের পরিভ্রমণকে কেন্দ্র করে। এ জন্য সাধারণত বর্ষপঞ্জিগুলোকে চন্দ্র ও সৌর বছরে ভাগ করা হয়। মানুষের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিও ওই চন্দ্র ও সূর্যের পরিভ্রমণকে কেন্দ্র করে পালিত হয়। এ কারণেই প্রতিটি ধর্মের অনুসারীরা নিজেদের দিনপঞ্জিকা অনুযায়ী ধর্মীয় বিধিবিধান পালন ও উৎসবের আয়োজন করে।

ইতিহাস সাক্ষ দেয়, জগৎ জুড়ে সব দেশে ১ জানুয়ারি উদযাপনের পিছনে মজার-মজার গল্প আছে। কেন হঠাৎ এবং কি ভাবে ১ জানুয়ারিটাই ইংরেজি নববর্ষের প্রথম দিন হলো, বড় বড় হিসাব কষেও পন্ডিতরা এখনো তা নিয়ে একমত হতে পারেননি। নামে ইংরেজি নববর্ষ হলে কি হবে, মূলত ১ জানুয়ারির ‘জন্ম’ কিন্তু ব্রিটিশ বা মার্কিন মুলুকে নয়। রোম সাম্রাজ্যে। রোমের লোককথা মতে, রোমে তখন সভ্যতার ছোঁয়া তেমন লাগেনি বললেই চলে।

পাথর কেটে মানুষ ঘরবাড়ি বানায়, খাবার দাবার চলে শিকার করে- এভাবে বেশ চলছিল। হঠাৎ মোগাস নামে এক মাতব্বর গোছের এক ব্যক্তি লোকজন ডেকে বললো, সূর্য উঠে- অস্ত যায়, আবার উঠে। এ মাঝের সময়টুকুকে ধর এক দিন। আর পাথর দিয়ে পাথরের গায়ে একটা করে দাগ কেটে দিন বানাও; ব্যস, দিন যায়, দাগ বাড়ে। মোগাসের দিন-মাসের কাহিনী বাড়তে থাকে, মূলত মোগাসের নাম থেকে মেঘাস অর্থাৎ জ্ঞানী শব্দটা এসেছে- সেটাও কিন্তু খ্রিস্ট জন্মের ৬০০ বছর পরে।

আরও পাঁচটা রোম-শিশুর মতোই একদা বাল্যকালে বিকালের আলোয় বাগানে বসে গৃহশিক্ষকের কাছে মেঘাসের গল্প শুনছিলেন সিজার। তিনি ইতিহাসে সম্রাট জুলিয়াস সিজার নামে পরিচিত। অস্ত্রে যতটা পাকা, অঙ্কে ততটাই কাঁচা এই রোমান সম্রাট শুধু রাজ্য জয়ই করেননি, তিনি ক্যালেন্ডারের পাতাতেও তার নাম লিখে রেখেছেন। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের জুলাই মাস এসেছে তার নামানুসারেই। তার তৈরি ক্যালেন্ডার অনেকদিন টিকে ছিল। কিন্তু আরও পরে এই ক্যালেন্ডার নিয়েও অনেক সমস্যা দেখা দেয়। তাই জুলিয়াস সিজারের ক্যালেন্ডারও সংশোধনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। অনেক পরে তার ক্যালেন্ডার আবার সংশোধন করেন অ্যালোসিয়াস লিলিয়াস নামীয় এক ডাক্তার। কিন্তু সেই ক্যালেন্ডার সবাইকে ব্যবহার করার কথা বলেন পোপ গ্রেগরি।

তিনি ইতিহাসে ১৩ নাম্বার পোপ গ্রেগরি হিসেবে পরিচিত। ফাদার গ্রেগরি ছিলেন ইতালির লোক। ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু সংস্কারবাদী ছিলেন না। যিশু ছাড়া তিনি আর একটি জিনিসই বুঝতেন। তা হলো নিসর্গ। কারণ তার ধারণা ছিল, এ অসীম-অনন্ত প্রকৃতি যিশুর মহত্ত’র দান। তাই তিনি ক্যালেন্ডারের সঙ্গে ধাতুচক্রের ছন্দটাকে মিলান তিনি। একদিন প্রার্থনা সেরে বেরিয়ে গ্রেগরি অনুভব করেন, এতো বরফ- শীতল হাওয়াটা যেন একটু আঁচ পেয়েছে। গাছদের শাখা প্রশাখায় খানিক সবুজের আভা লেগেছে। শীত ঘুম ভেঙে উঠে পাখিরা গান গাইছে, যেমন বসন্তে হয়। গ্রেগরি ভাবলেন, এটাই হতে পারে নতুন দিন। এভাবেই শুরু করা যায় নতুন আবহাওয়ার লীলাখেলা!

নিজের ঘরে ফিরে এসে সিজারের ক্যালেন্ডারকে রেখে গ্রেগরি বসলেন সপ্তাহ, পক্ষ আর মাসের হিসাব মিলাতে। একেবারে শীতের শেষ বা বসন্তের সূচনার জন্য অপেক্ষা করে লাভ নেই। শীত-বসন্তের এ পরিবর্তনের জন্য বরং কিছুটা সময় ধরে রাখা যাক। আজকের দিনটাই হোক বছরের শুরু। সিজারের ক্যালেন্ডার ধরলে এ আবিষ্কারের দিনটা নাকি দাঁড়ায় ১ জানুয়ারি। এখন যে ‘নিউ ইয়ারস ডে’ উৎসব হয়- তা ইংরেজদেরই কীর্তি। কারণ চতুর ইংরেজরা গ্রেগরির যুক্তিবাদী ক্যালেন্ডারটা মেনে নিয়ে ১ জানুয়ারিকে ইংরেজি নববর্ষে পরিণত করেছিল। তার নামেই এই ক্যালেন্ডারের নাম হয় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। গ্রেগরিয়ান ক্যালন্ডারে জানুয়ারি মাসকে প্রথমে আনা হয়। তারপর থেকেই অর্থাৎ ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকের কোনো একটা সময়ে মূলত ১ জানুয়ারিকে নতুন বছরের প্রথম দিন হিসেবে পালনের রেওয়াজ শুরু হয়। এই হলো ইংরেজি নববর্ষ বা ক্যালেন্ডারের কথা।

যুক্তরাষ্ট্রে এ দিনটি উদযাপিত হয় ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে। নানা ধরনের রঙিন পোশাক ও মুখোশ পরে নৃত্যের তালে তালে উৎসবের আমেজে দিনটিকে বরণ করে নেয়া হয়। ঘড়ির কাঁটায় ১২টা বাজার ১ মিনিট আগে একটি আলোকিত বলকে একটি দন্ডের ওপর থেকে ধীরে ধীরে নিচে নামিয়ে আনা হয়। যে মুহুর্তে আলোর বলটি মাটি ছুঁয়ে ফেলে তখন নববর্ষের আলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সবাই একসাথে গান গেয়ে মুহুর্তটিকে স্মরণ করে রাখে। এ গানটি মূলত একটি লোকসঙ্গীত, তবে পরবর্তীকালে কবি বানর্স গানটি সংশোধিত করে লিখেছিলেন এবং সব ইংরেজই এই গান নববর্ষে গেয়ে থাকে। মূলত: এটাকে অনুসরন করেই বাঙালি সংস্কৃতিতে প্রবেশ করেছে তথাকথিত থার্টি-ফার্স্ট নাইট। বাঙালিরা বিজাতীয় সংস্কৃতি অনুসরন করতে গিয়ে যে বেলেল্লাপনা করেন তা নিবারনে আজকাল পুলিশ মোতায়েন করতে হয়- আগাম সতর্ক বার্তা ঘোষণা করতে হয়।

এ উপমহাদেশীয় ভূ-খন্ডে নববর্ষ এলেই বাঙালি সংস্কৃতিতে দেনা-পাওনার হিসেব চলে আসে। সেটা হোক ইংরেজি বা হিজরী, বাঙলা হলে তো কথাই নেই- রীতিমতো উৎসবে মাতে। কি পেলাম আর কি হারালাম তা নিরূপনে মত্ত হয়। কেউ কেউ আবার আগামীর পাওয়া- না পাওয়া নিয়েও চিন্তিত হয়ে ওঠে। ইংরেজি ভাষা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হলেও বাঙালি সমাজে ইংরেজি নববর্ষ পালনে একটা বিজাতীয় ভাব আছে ‘কেমন যেন উড়ে এসে জুড়ে বসার মত’। বাঙালি সংস্কৃতির সাথেও যায়না ব্রিটিশের এ উৎসব। বাঙালিরা দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বাঙলা ও হিজরী নববর্ষে অনেকটাই স্বাচ্ছন্দ বোধ করে, বিশ্বায়নের যুগেও তা অমলীন। তবে, বাঙালির একটা শ্রেণি ইদানিং বেশি বেশি ঝুঁকছে ওই সংস্কৃতিতে।

বিদায়ী ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে জাতীয় পর্যায়ে নানা দেনা-পাওনার মাঝে স্থানীক একটা হিস্যা থাকে; এ পাওনার খাতাটা নেহায়েত কম নয়।

এ বছরের সবচেয়ে বড় সাফল্য জঙ্গি দমনে। রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজেন রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলার পর দেশের জঙ্গিবাদ নিয়ে পুরনো ধারণা থেকে বের হয়ে আসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর সারাদেশেই চলতে থাকে জঙ্গিবিরোধী অভিযান। একে একে নির্মূল হতে থাকে জঙ্গি ও জঙ্গি আস্তানা। বিদায়ী বছর ২০১৭ সালের শুরু থেকেই বিচ্ছিন্নভাবে চলে আসছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এ কার্যক্রম। কিন্তু মার্চে হঠাৎ করেই ঘটনা মোড় নেয় অন্যদিকে। যার শুরু ঢাকার পাশের টঙ্গীতে। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের শীর্ষনেতা মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নিতে ৬ মার্চ টঙ্গীতে প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে প্রশাসনকে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছিলো জঙ্গিরা।

এরপর থেকে মার্চের শেষদিন পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে ছিল নানামুখী আক্রমণ, জঙ্গি আস্তানার সন্ধান লাভ, অভিযান আর হতাহতের ঘটনা-দুর্ঘটনায় ঠাসা মুহুর্ত। বছরের সবচেয়ে বড় জঙ্গিবিরোধী অভিযান সিলেটের আতিয়া মহলে পরিচালিত ‘অপারেশন টোয়েলাইট’, মৌলভীবাজারের বড়হাটে ‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস’, নাসিরপুরে ‘অপারেশন হিটব্যাক’ ও কুমিল্লার কোট বাড়িতে ‘অপারেশন স্ট্রাইক আউট’ ইত্যাদি।

সাফল্য রয়েছে অবকাঠামো উন্নয়নে, দৃশ্যমান হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু, স্বাস্থ্য খাতে গতি এসেছে। চাল-পিয়াজ-কাঁচা মরিচ সহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য বৃদ্ধির সাথে বজার অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণহীন ছিল দীর্ঘ সময়। সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে বছরের শেষ দিকে শিক্ষামন্ত্রীর ‘ঘুষ’ আর ‘চোর’ সমাচার। তারপরও সময়ের চলমানতায় এসেছে ইংরেজি নববর্ষ- যা নিয়তির নিয়মেই এসে থাকে।

বিগত বছরের সকল ভুল, ত্রুটি, চাওয়া, না পাওয়া সবকিছু পিছনে ফেলে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের রাজনীতি, সমাজনীতি ও উন্নয়নের গতিশীলতা স্থির করতে হবে ক্ষুদ্র স্বার্থ জলাঞ্জলী দিয়েই। নতুন বছরে ইতিবাচক না নেতিবাচক পথ বেছে নেবে বাংলাদেশ, এমন কঠিন প্রশ্নে সঠিক সিদ্ধান্তটি খুঁজে বের করতে হবে রাজনৈতিক এলিটদেরকেই। ঞড়মবঃযবৎহবংং ড়ভ ঢ়ড়ষরঃরপং ধহফ ফবাবষড়ঢ়সবহঃ আমাদের করতেই হবে।

এ কথা সত্য যে, গণতন্ত্র ও সুশাসনের যৌথ শপথে বিশ্বের অগ্রগতি ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশকেও এগিয়ে যেতে হবে। এ অগ্রগমনের রথে চলতি দশকেই বাংলাদেশ পৌঁছে যাবে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির মাহেন্দ্রক্ষণে। এমনই গৌরবের যাত্রাপথে সংঘাত ও সংঘর্ষকে পরিত্যাগ করে গণতন্ত্র ও সুশাসনকে সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার জাতির ঐক্যবদ্ধ প্রতীতি। ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর অবিমৃষকারিতার দ্বারা রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবক্ষয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশকে জাতীয় অঙ্গীকারের মহাসড়ক থেকে অন্য কোন দুষ্টচক্রের ঘূর্ণাবর্তে যেন কোনভাবেই ঠেলে দেয়া বা বিচ্যুত করা না যায়, সেটার প্রহরা দেয়াই সকলের জন্য ২০১৮ সালের প্রধান কর্তব্য।

আশা ও শঙ্কার দোলাচলে যে নতুন বছর আসছে, তাকে মেঘমুক্ত করে আলোকিত ঠিকানায় পৌঁছে দেয়াই নতুন বছরের দিক্দর্শন। আমাদের রাজনৈতিক কন্ডারিরা যদি বাস্তবতার এই সঙ্কেত অনুধাবনে ভুল করেন, তাহলে অনেক চড়া মাশুল দিতে হবে তাদের। কেননা, রাজনৈতিক ব্যবস্থা এখন আর সরকারের একচ্ছত্র শাসন নয়; ব্যাপক অর্থে গভর্নেন্স। যেখানে সরকার একটি পক্ষ মাত্র। অন্য পক্ষগুলো হলো বিরোধী দল, প্রাইভেট সেক্টর, এনজিও, সিভিল সোসাইটি এবং উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও রাষ্ট্রসমূহ। সুশাসন মানে সকল পক্ষের সম্মিলিত ও সমন্বিত প্রয়াসে জনগণের সেবার মান বৃদ্ধি, জীবনযাত্রা, নিরাপত্তা ও আয়-রোজগারের প্রবৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈশ্বিক যোগসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা।

ক্ষমতাসীনদের শাসনের কালে জনগণ অবশ্যই তাদের সামগ্রিক কার্যক্রম প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির নিরিখে নিরীক্ষণ করছে। বিরোধীসহ অপরাপর রাজনৈতিক শক্তিসমূহের কার্যক্রমকেও মূল্যায়ন করছে। এটা মনে করার সঙ্গত কোন কারণ নেই যে, জনগণ অতীতের মতো বার বার একতরফাভাবে রাজনৈতিক সংঘাতের করুণ শিকারে পরিণত হতে চাইবে। মানুষ অবশ্যই বিপদ থেকে মুক্তি চাইবে। অনিশ্চয়তা থেকে সুস্থির রাজনৈতিক জীবনের সন্ধান করবে। ফলে গণতন্ত্র, সুশাসন, উন্নয়ন, নিরাপত্তা, আইনের শাসন, মানবাধিকার ও শান্তির প্রশ্নে জনঐক্যের ভিত রচনা করতে হবে এ বছরেই। এভাবেই স্খলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির অন্ধচক্রের গহ্বর থেকে মুক্তির ধ্বনি নিয়ে ২০১৭ সাল জাতিসত্তার প্রবল উত্থানে রচনা করতে পারবে গণতন্ত্র ও সুশাসনভিত্তিক কল্যাণকর সমাজ এবং সমৃদ্ধির উজ্জ্বলতম নব ইতিহাস। যে ইতিহাস মুখর করতে হবে নাগরিকগণের সরব কণ্ঠস্বরে; দলগুলোকে দলীয় স্বার্থচিন্তার গন্ডি থেকে জাতীয় স্বার্থের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার মাধ্যমেই শুরু করতে হবে গণঅধিকার প্রতিষ্ঠার নবঅভিযান।

আমরা বাঙালিরা সাধারনত ভুলো জাতি। অতীতকে সহজেই ভুলে যাই। মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদদের ভুলে গেছি, ভুলে গেছি দু’লাখ মা-বোন সম্ভ্রমহানি, ভুলে গেছি জাতির জনকের স্বপরিবারে হত্যাজজ্ঞ, প্রিসিডেন্ট জিয়া, মেজর মঞ্জুরদেরকেও ভুলে গেছি; মনে রাখিনি স্বৈরাচার এরশাদ, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন, চারদলীয় জোট সরকারের ‘হাওয়াভবন’, ওয়ান-ইলেভেন। অচিরেই ভুলে যাব ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, বিগত সময়ের বেফাঁস কথাবার্তা, ইতিহাস বিকৃতির নীল নক্শা।

বাংলাদেশের মানুষ অপেক্ষমাণ অতীতের গ্লানি ও অক্ষমতা ঝেড়ে ফেলে নতুন বছরের কাঙ্খিত অর্জনের জন্য সব ভুলে যায়। মানব সমাজের আশা কখনোই কোনও শঙ্কার কাছেই পরাভব মানে না। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে আশা ও শঙ্কার ২০১৭ সালে শঙ্কার অবসান ঘটুক; আশার বিজয় কেতন উড়–ক বাংলাদেশের সর্বত্র; প্রতিটি দলে, জোটে, ঘরে এবং প্রত্যেকটি নাগরিকের অন্তরের গহীন-গভীরে। তবেই রোপিত হবে ন্যায্যতা ও সাম্যতার গরিবহীন গণতন্ত্রের, অঙ্কুরিত হবে শান্তির বাংলাদেশের চারা-গাছ, দিবে ফল, যা পাবে সবজন।

যা বলছিলাম, প্রতিটি উৎসবই আসে আনন্দের বার্তা নিয়ে, হোক তা জাতীয় কিংবা বিজাতীয়। সকল উৎসবের মূল বাণীতে থাকে কল্যাণ নিহিত। গ্রেগিরিয়ান ক্যালেন্ডার উপহার দিয়ে ধর্মের মানুষ হয়েও ইতালিতে ইংরেজি নববর্ষের মতো একটা সামাজিক অনুষ্ঠানের শিরোমণি হয়ে রয়েছেন গ্রেগরি। ইতিহাস বিখ্যাত বিপ্লবের দেশ ফ্রান্সেও ইংরেজি নববর্ষের যথেষ্ট কদর, কারণ সে দেশের গ্রামগুলোতে এদিনে এখনো রাজা হেনরি লুইয়ের স্মরণে প্রার্থনা বসে।

১ জানুয়ারি দিনটায় শহুরে ফরাসিরা কেক ফেস্টিভ্যালে মেতে থাকেন। গ্রিস কিংবা ইন্দোনেশিয়ায়ও ব্যতিক্রম নয়। ইংরেজি নববর্ষের সাহেবি উৎসবের সঙ্গে সঙ্গে তারা লোককথার গল্পগুলো ভুলে যায় না। ১ জানুয়ারিতেই গ্রিসের বড় বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনো মেষপূজা হয়। আর ইন্দোনেশিয়ায় গৃহস্থরা ১ জানুয়ারিতে সন্তান-সন্তুতির মঙ্গল কামনায় আলোর আরাধনায় বসেন। নববর্ষ শুরুর দিনটা এর থেকে বেশি কী পেতে পারে সারা দুনিয়ার কাছে! ইংরেজি ক্যালেন্ডারের

আন্তর্জাতিকতার কল্যাণেই ১ জানুয়ারির দিনটায় সারা পৃথিবীর মানুষ এক সঙ্গে উৎসবের আনন্দ অনুষ্ঠানে মেতে উঠে। বৈচিত্র্যেরর মাঝে ঐক্য, বিবিধের মাঝে এমন মহান মিলন বছরের আর কোনদিন খুব একটা দেখা যায় না। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, অসাম্প্রদায়িকতার শৌর্য-বীর্যে উন্নত বিশ্বের সুরঙ্গে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। সে সুরঙ্গের শেষ প্রান্তে রয়েছে বিশ্বের উন্নত জাতির ‘তকমা’। আগামীর দিনগুলো হোক অনাবিল সুখ, সমৃদ্ধি আর শান্তির- এটাই ইংরেজি নববর্ষের প্রত্যাশা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।