চারণ গোপাল চক্রবর্তী


কোথায় আছি! বাংলাদেশ না পাকিস্তান? প্রশ্নটা শুনে যে কেউ বলবে পাগল এর প্রলাপ। তবুও রাষ্ট্রের কর্তাদের কাছে বিনত ভাবেই জানতে চাই এর উত্তর।

তারিখটা ২০১৭ সালের ২১ ডিসেম্বর। বৃহস্পতিবার দিন। বন্ধুমনা মিজানএর ফোন বেজে উঠলো বিকাল ৩ টা ৫০ মিনিট এর দিকে, ফোন ধরলাম। মিজান বললো, ভাই চলো আজ বিকালটা ঘুরে আসি পাহাড় থেকে। পাহাড় এর কথা শুনলে কেন জানি না দেখার লোভ সামলাতে পারিনা। আমি রাজি হয়ে যাই । ও বললো চলো তাহলে। ১০ মিনিটের মাঝে বাড়ি থেকে বের হও। আমি জানি ওর সময়জ্ঞাণ সম্পর্কে।লেখাপড়ার জন্য লন্ডনে কেটেছে ওর ৫ বছর। তাই ১০ মিনিট মানে ওর কাছে ১০ মিনিটই। আমি ফোন রেখে বের হলাম ৬ মিনিটের মাঝেই। মিজানও চলে এলো।ওর বাইকে চড়ে ছুটলাম পাহাড়ের দিকে। গন্তব্য বিজয়পুর। স্থানটি ভারতের মেঘালয় ঘেষা।

আমি নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার পৌর শহরেই বসবাসকরি।অনেকে এই এলাকাকে চিনেন সুসং নামে। আবহমান কাল থেকেই সুসং অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ।সমৃদ্ধির পিছনে সুসং এর প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদ।রাজা-মহারাজা, ইংরেজ, পাকিস্থানী সহ সকলেই এই সম্পদ কে নানাভাবে আহোরণ করেছে। আজ আর ওরা কেউ নেই।আজ স্বাধীন বাংলাদেশ ।আসলেই কি বাংলাদেশ?

মিজান ও আমি চলে আসি পশ্চিম বিজয়পুর। কারণ গতকালই মিজান বলছিলো ভাই তোমাকে একটা সীমানা পিলার দেখাবো। ক্ষোভে সে বলছিলো আমরা আজও কোথায় আছি। এক আদিবাসীর বাড়িতে বাইক রেখে আমরা খোঁজ করতে শুরু করলাম সেই সীমানা পিলার এর। আমরা হাঁটতে হাঁটতে উঠে পড়লাম একটি পাহাড়ের চূড়ায়। আগাছা ঢাকা পাহাড়।নেমে পরলাম পিলার এর সন্ধানে। দুজনেই কিছুটা ভীত। কারণ আমরা যে পাহাড়ে তার অপরদিকের পাহাড়েই বিএসএফ ক্যাম্প। এর মাঝেই মিজান বলে বসলো, ভাই, যদি গুলি করে। শুধুই সাহস দেবার জন্য আমি বললাম আরে গুলি করবে না। অনেকক্ষণ পর মিজান এর চোখেই পড়লো সেই পিলার। মিজান মাস তিনেক আগে ঘুরতে এসে প্রথম দেখা পায় এই পিলার এর। এগিয়ে গেলাম পিলারের দিকে।চোখ পড়তেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। একি দেখছি আমি!পিলার নাম্বার ১১৫০।‘ টি-ফাইভ’ লোহার পিলারটির একপ্রান্তে লেখা ‘আইএনডি’ (ইন্ডিয়া), অন্যপ্রান্তে লেখা ‘পিএকে (পাকিস্তান )!

বিষন্নতা নিয়ে পাহাড় থেকে নামলাম।পথে কথা হয় সেই গ্রামের প্রানেশ রিছিল এর সাথে।তিনি জানান, “এখানে আরো অনেক এই রকম পিলার আছে যা আগাছায় ঢাকা’। এই পিলারগুলা দেখলে খারাপ লাগে।”

সেখান থেকে চলে যাই বিজয়পুর বিজিবি ক্যাম্প। কোম্পানি কমান্ডার ছুটিতে থাকায় ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার নুরুল হক বেশি কিছু বলতে রাজি হলেন না। তবে তিনি স্বীকার করলেন এই সব পিলার এর অস্তিত্ব।বললেন দুই দেশের কর্মকর্তারা একত্রে এই সব পিকে পিলার অপসারণ এর কাজ করছে। অনেক পিলার অপসারণ করা হয়েছে। যখন জানতে চাইলাম, স্বাধীনতার এত বছর পরেও কেন সম্ভব হয়নি এগুলো অপসারণ করা। তিনি নীরব থেকেছেন । উত্তর পাইনি। নিজেই নিজের সাথে কথা বলতে শুরু করলাম।

দেশভাগ হয়েছিলো ৭০ বছর পূর্বে। তার চিহ্ন আজও রয়েগেছে। বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে ৪৬ বছর । এইতো গেলো ডিসেম্বর। মহাসমারোহে পালন করা হলো বিজয়ের ৪৭ বছরে পদার্পণ। এত বছরেও এই পিলারগুলো অপসারণ করা হয়নি। তাহলে কি শংকা আছে যে দেশ আবারও পাকিস্তান হয়ে যাবে?

বাংলাদেশ জন্ম নেওয়ার পর অনেক দেশপ্রেমিকগণ দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। দেশকে অনন্য মর্যাদার আসনে নিয়ে যেতে কাজ করেছেন এবং করছেন। কিন্তু দেশের পরিচয়কে পাকাপোক্ত করার ব্যাপারে উনাদের হয়তো আগ্রহ নেই। অত্যাধুনিক অস্ত্র, প্রযুক্তিতে উন্নত করা হচ্ছে আমাদের বিভিন্ন বাহিনীকে।কিন্তু কোথাও রয়ে যাচ্ছে একটা বিরাট ভুল।

আমাদের ভূমি আইন মোতাবেক ১২ বছর এর দখল নাকি ডিক্রির চেয়েও বেশি কিছু।আমরা আমাদের ব্যাক্তিমালিকানা জমিতে পিলার দিয়ে নাম লিখে রাখি।তা থেকেই সবাই বুঝে নেয় যে জমির মালিক কে।এখানে তো ৭০ বছর হলো নাম ফলক লেখা পাকিস্তান !যা যে কাউকেই ভাবতে ফেলে দিবে।

ব্রিটিশ আইনজীবি রেডক্লিফ সাহেবের খামখেয়ালীপনা সীমানা নির্ধারণে তৈরি হয় ইন্ডিয়া-পাকিস্তান সীমান্ত। মাত্র ৬ সপ্তাহে এই বিতর্কিত সীমানা তৈরি করে তিনি নাইটহুড উপাধি পান। নেহেরু, জিন্নাহ ও লর্ড মাউন্ট বেন্টেন এর হাত ধরে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের মাধ্যমে জন্ম নেয় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান ।ভাষা নিয়ে বিরোধের জেরে দূরত্ব বাড়ে পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে। তারপর নানা বৈষম্য থেকে ক্ষোভে পূর্বের জনতা স্বপ্ন দেখে একটি স্বাধীন ভূখন্ডের ।

বহু প্রাণের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় পায় বাংলাদেশ। আজ যা ইতিহাস। পাকিস্তানিদের জুলুম-নির্যাতনের শিকার এই অঞ্চল। আজ স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও যখন এই বাংলার মাটিতে চোখে পরে পাকিস্তান নামের সীমানা পিলার তখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হতে হয়।জন্ম হয় নানা প্রশ্নের । এত বছর পরেও কেনো এই সীমানা পিলারগুলো উঠিয়ে নেওয়া হয়নি! এই ভুলের মাসুল কি দিবেনা বাংলাদেশ? তার প্রজন্মের কাছে কি কালের স্বাক্ষী হিসেবে এইগুলো রেখে যাচ্ছে! নাকি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের উদাসিনতাই এর জন্য দায়ী।

আগ্রহ থেকে জানতে পারি শুধু আমার দুর্গাপুর সীমান্তে নয় এই সব অসংখ্য পিলার আছে বাংলাদেশে যা আজও অপসারণ করা হয়নি। । এগুলো যদি এভাবেই থাকে তাহলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে কি বার্তা বহন করবে! কেউ আমাদের মত ঘুরতে ঘুরতে যদি চলে আসে এইসব সীমানা পিলার এর কাছে । সে কি থমকে যাবেনা তার অবস্থান নিয়ে!?

লেখক : সাংবাদিক, দুর্গাপুর (নেত্রকোনা)।