প্রান্ত সাহা : যদি বলতে যাই তবে সবথেকে সহজ এবং সর্বাধিক জটিল শব্দের কাতারে 'ভালোবাসা'। এরপর ভালোবাসি শব্দটিকে ঘিরেই যেন যত কৌতূহল। আর পৃথিবীর ঘূর্ণায়মান গতির পৃষ্টে এক সুপ্ত শান্তির ধ্বনি এই 'ভালোবাসা'। এর বিড়ম্বনাও আকাশচুম্বী। সহজ শব্দের জটিল ধাঁধাঁয় অনেক জ্ঞানী-গুণীই হয়েছেন বিকারগ্রস্থ, আবার কেওবা সমৃদ্ধ, কেউ কেউ হয়েছেন মহান।

একজন ভালোবেসে হাসে, অন্যদিকে কেউবা ফাঁসে। হাজার সমীকরণের ঊর্ধ্বে স্বমহিমায় দীপ্যমান এ ভালোবাসা। হাজারো না বলা কথার যোগফল এ অতিক্ষুদ্র বর্ণসমষ্টি। ব্যক্তি জীবনের সাফল্য বলুন কিংবা ক্ষতি পেছনের ইতিহাসটা শুধুই ভালোবাসা নির্ভর।

আর যদি আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণে যাই, তবে এর মাপকাঠি কেবলই গভীর থেকে গভীরতর। তাই সৃষ্টির আদি থেকেই এই শৈল্পিক শব্দের মধুপানে পিছ পা হন নি কেওই! সেই সুমিষ্ট তরল কারো কারো কাছে কর্মফলযোগে রূপ নেয় গরলে। তাই তো উচ্চারিত হয়, 'মধু হই হই, আরে বিষ হাওয়াইলা।'

তবে ভালোবাসি এটি নির্ণয় করার নানান উপায় ও মাধ্যম নিজে থেকে বিশ্লেষণ করা গেলেও 'কেন ভালোবাসি' এই শব্দের সঠিক উত্তর নির্ণয় করাটা যেন খানিক অসাধ্য। ভালো না লাগার হাজারো কারণ থাকতে পারে কিন্তু ভালোবাসার জন্য একটি কারণই যথেষ্ট। ভালোবাসার প্রকারভেদ হয় নানাভাবে, যার প্রভাব সর্বাধিক লক্ষ্য করা যায় সম্পর্কের বিভিন্নতায়। যেমনঃ একজন একুশ বছরের যুবক প্রেমিকার কাছে তার প্রেমিক অন্যদিকে মায়ের কাছে তার যক্ষের ধন। তাই বলা যায়, এই দুটি সম্পর্কে ভালোবাসার সরব উপস্থিতি তীব্রভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও এখানে একটি শব্দের আপেক্ষিক মূল্যায়নে বিপরীত অর্থ এবং ভাবের উদয় ঘটায়।

কেন ভালোবাসার গুরুত্ব এতোখানি অর্থপূর্ণ? কেনইবা ভালোবাসায় ভালোবাসাটাই সর্বাগ্রে?

আমি মনে করি, পৃথিবীতে প্রতিটি সম্পর্কের মাঝেই একটা নীরব 'গিভ অ্যান্ড টেক' পলিসি বিদ্যমান। আর সেই দেয়া নেয়ার আবদারই আমাদের চঞ্চল মনের গতিকে তরান্বিত করে। একটি স্বাভাবিক সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ভালোবাসাই বাঁধনকে আরো দৃঢ় করে তোলে। এই স্বার্থপর পৃথিবীতে প্রতিটি কাজেই একটি সুনির্দিষ্ট কারণ বিদ্যমান। আর আমরা সকলেই আত্মকেন্দ্রিক এবং যে ব্যক্তি নিজের আত্মাকে প্রকৃতরূপে ভালোবাসতে পারে তার নিকট হতে ভালোবাসা পাবার সম্ভাবনাও ততোধিক। কারণ যে নিজেকে সামলাতে পারে না তার নিকট হতে অপরের সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ কল্পনা করাও অবান্তর। আমরা যখন কোন কথা বলি, সে কথাটি তখনই বেশি আবেদন সৃষ্টি করে যখন ফার্স্ট পারসন রূপে তার বক্তব্য উপস্থাপন করি। নতুবা এর গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণতা আসে না। যেমনঃ যখন কোন বালিকাকে আপনি বলবেন, 'আমি তোমাকে ভালোবাসি।' তখন আপনি কিন্তু জানেন না অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি আপনাকে ভালোবাসে কি না! সেক্ষেত্রে 'আমি' আর 'তুমি' বর্তমান হলেও 'ভালবাসাটি' ভবিষ্যৎ। আর 'আমি' শব্দটির দ্বারা কিন্তু আপনি নিজেকেই কেন্দ্র করে আপনার ব্যক্তিসত্ত্বার এক আবেদনকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। অর্থাৎ নিজের জন্যই আমরা আমাদের জীবনের সঙ্গে অপর ব্যক্তির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। সেই আমিই যদি অনিশ্চয়তার দোলাচলে পেন্ডুলামের মত দুলতে থাকে তবে ভালোবাসাটি আপনার জন্য নয়, সেটাকে মোহ বললেই যথাযথ শব্দের প্রয়োজনীয়তা পরিপূর্ণতা পাবে।

আর ভালোবাসায় একপাক্ষিক কোন শব্দের অস্তিত্ব অর্থহীন। ভালোবাসার মানুষকে ভালো রাখতে চাইবার সুপ্ত বাসনার আস্ফালনই 'ভালোবাসি' শব্দটি। তাই বারংবার বলা হয়, ভালোবাসায় জোর চলে না। ভালোবাসা প্রকাশে পূর্ণতা পায়, এটি নিতান্তই ফেসবুক জেনারেশন ভিত্তিক প্রচারণা। একটি প্রবাদে লক্ষ্য করা যায়, 'যত গুপ্ত তত পোক্ত।' তাই সুপ্ত স্নেহ এবং ভালোবাসার পবিত্র সংবেদনশীল মনস্তাত্ত্বিক ইচ্ছের পুরস্কার একজন সঠিক সঙ্গী নির্বাচন। চতুরতা এবং মিথ্যাচার যেরূপ ভালোবাসার শিষ্টাচার পরিপন্থি সেরূপ জোরপূর্বক ভালোবাসার প্রকাশও নোংরামির সামিল!

লেখক : ছাত্র, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।