কবীর চৌদুরী তন্ময়


ইদানিং স্যোশাল মিডিয়ায় দল-মত নির্বিশেষে সবাই পরিবেশ বান্ধব হয়ে দাঁড়িয়েছে। খুব চমৎকার ভাবে তথ্য-উপাত্ত এবং যুক্তিসহ কিছু অসাধারণ পরিকল্পনা দিয়ে যশোর রোডের ১৭০ বছরের পুরোনো গাছগুলো রক্ষার জন্য যাঁর যাঁর মতো করে মতামত প্রকাশ করছে। স্যোশাল মিডিয়ায় এ ব্যাপারটি অত্যন্ত সহজ। কারণ অনলাইন কিংবা প্রিন্ট মিডিয়ায় কোনও মতামত বা মুক্তমত প্রকাশ করার সময় সম্পাদক মন্ডলীর দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। আবার ওই প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা বহির্ভূত কীনা সেটিও মাথায় রাখতে হয়। কিন্তু স্যোশাল মিডিয়ায় সে ধরনের কোনও বাধ্যবাধ্যকতা নেই। তাই পোস্টে ক্লিক করার সাথে-সাথে ছবিসহ বিস্তারিত লেখা খুব দ্রুত এক বন্ধু হতে অন্য বন্ধু ও ফলোয়ারের হাতে-হাতে চলে যায়।

এমনি করে যশোর রোডের সেই পুরনো গাছগুলো রক্ষার ছবি ও বার্তা দ্রুত ছড়িয়ে গিয়ে বর্তমানে আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। তার কারণও আছে। একদিকে মুল মিডিয়ার চেয়েও বর্তমানে স্যোশাল মিডিয়া অত্যন্ত শক্তিশালী ও কার্যকর হয়ে উঠেছে। এই যেমন বিরল রোগে আক্রান্ত শিশু মুক্তামনির খবরটি ছড়িয়ে যাওয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই শিশুটির শুধু চিকিৎসারই ব্যবস্থা করেনি, শত কষ্ট হলেও মুক্তামনির হাত অক্ষত রেখে তাঁর অপারেশন করার জন্য ডাক্তারকে অনুরোধও করেছিল। আবার খুব সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরীর সংকটাপন্ন জীবন ব্যবস্থার কথা স্যোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে শুনে তাঁর উন্নত চিকিৎসা করার জন্যেও নির্দেশ প্রদান করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তিঁনি দেশের শুধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, একজন মানবতার মাতা বা ম্যাদার অব হিউম্যানিটির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে নতুন প্রজন্মসহ পুরো দেশবাসীর সামনে।

এখানেও সবাই শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করছে। এটা দোষের কিছু নয়। কারণ সাধারণ জনগণ এখন আর রাষ্ট্রযন্ত্রের কতিপয় মানুষের উপর বিশ্বাস রাখতে পারছে না। এই যেমন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সাহেব সশরীরে উপস্থিত হয়ে ননএমপিওভুক্ত শিক্ষকদের দাবির ব্যাপারে বিবেচনা করা হবে মর্মে আশ্বাস দিয়ে বাড়িতে ফিরে যেতে বললেও শিক্ষকরা রীতিমত শেখ হাসিনার আশ্বাসের প্রতি তাকিয়ে ছিল এবং সেই আশ্বাস পেয়ে শিক্ষকরা অশ্রুজলে আনন্দও প্রকাশ করে অবশেষে বাড়ি ফিরে গিয়েছে।

এটা মুলত রাষ্ট্রযন্ত্রের কতিপয় কর্তাব্যক্তির অযোগ্যতা, পরিকল্পনাহীনতা, আন্তরিকতার অভাব এবং তাঁদের দায়িত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হওয়ার কারণ। আর তাই ছোট্ট শিশু মুক্তামনি থেকে আরম্ভ করে সমাজ ও রাজনীতিবিদদের কাছ হতে অবহেলিত সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরীর দিকে এই শেখ হাসিনাকেই নিবেদিত হয়ে এগিয়ে গিয়ে কাজ করতে হয়। তাঁদের সুচিকিৎসার পাশাপাশি জীবন-যাপনের ব্যবস্থাও করতে হয়।

একটু চিন্তা করলে আপনিও অবাক হবেন, রাজনীতির এই স্বর্ণযুগে ছিচকে নেতার গাড়ি-বাড়িসহ ব্যাংক ও ব্যাংক ভর্তি টাকার মাঝখানে সাকা চৌধুরী মত লোককে পরাজিত করা সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী আজ চিকিৎসার অভাবে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছে। আবার এই সামান্য টাকার অভাবে এক সময়ে মাঠ কাঁপানো আওয়ামী লীগ নেতা হাসেম আলী (৬৫) দিনাজপুরের পার্বতীপুর রেলওয়ে স্টেশনের ১নং প্লাটফরমে শুয়ে-শুয়ে ভিক্ষা করেছে। অথচ সমাজের উচ্চবিত্ত, স্থানীয় নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধি থাকার পরেও এই ধরনের অবহেলিত মানুষের আস্থা ও শেষ ঠিকানা হয়ে উঠেছে শেখ হাসিনা।

আর তাই মানুষ কিংবা যশোর রোডের ইতিহাসবহনকারী শতবর্ষী এই গাছগুলোকে রক্ষার জন্য সবাই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করছে। কারণ রাষ্ট্রযন্ত্রের অনেক গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তি-মহলসহ স্বয়ং যশোর স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধি স্যোশাল মিডিয়ায় সব সময় অ্যাক্টিভ থেকেও না দেখার ভান করে শেষ পর্যন্ত গাছ কাটার পক্ষে ঐক্যমতে পৌঁছেছে। আর শেখ হাসিনা স্যোশাল মিডিয়া ব্যবহার না করেও স্যোশাল মিডিয়ার খবরা-খবর রাখেন। অবহেলিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে কুন্ঠাবোধ করেন না। হয়তো যশোরের এই গাছগুলো মানুষের মত কথা বলতে পারলে আমাদের মতই চিৎকার করে বলত, ‘‘হে! বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা! আমাদের রক্ষা করুন। আমাদের সাথে মিশে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরব গাথা ইতিহাস। আমাদের সাথে মিশে আছে লাখ-লাখ শরনার্থীর আত্মচিৎকার। প্লীজ! আমাদের রক্ষা করুন। আমরা আগামী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাব! গল্প শোনাব কী ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব। গল্প শোনাব কী অসাধারণ আপনার কৃতিত্ব!’’

এখানে একটি কথা আমার কাছে সত্যিই অবাক লেগেছে। আবার খুব ভালোও লেগেছে। আমাদের দেশের জনগণ সত্যিই অনেক সচেতন হয়েছে। স্যোশাল মিডিয়ায় ছোট্ট-ছোট্ট স্ট্যাটাস, কমেন্টগুলো নোট করে নিয়ে আমি ব্যক্তিগত ভাবে অনেক পরিবেশবিদ ও পরিকল্পনাবিদের সাথে আলোচনা করে দেখেছি- উভয় পাশের গাছগুলো রেখেই ফোর-লেন সড়ক করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু আন্তরিকতা। আর যাঁরা গাছগুলো কেটে রাস্তা প্রশস্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তাঁদের ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষার চিন্তা-ভাবনা নিয়েও কেউ-কেউ প্রশ্ন তুলেছে। অনেকে আবার ঢাকা-চট্টগ্রামের ফোর-লেন-এর রাস্তা দেখিয়ে বলল, বাঁকা রাস্তাকে সোজা এবং বিভিন্ন বাজারকে আগের জায়গায় রেখে ওয়ান ওয়ে অনেক রাস্তাই তৈরি করা হয়েছে। আর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যশোর ফোর-লেন সড়ক প্রকল্পের পরিকল্পনাবিদের এই পরিকল্পনা যে দূর্বল ছিল; এটা একজন পরামর্শক যশোর রোডের ভারতের অংশের রাস্তার ছবি আমার হাতে ধরিয়েই যেন স্পষ্ট দেখিয়ে দিল!

এদিকে যশোর রোডের দুইপাশে ১৭০ বছরের পুরনো এই বৃক্ষগুলো ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে কী কী স্বাক্ষী বহন করে চলেছে তা আমার চেয়েও ওই প্রকল্পের পরিকল্পনাবিদসহ স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা পরিষদ ও সড়ক বিভাগের কর্তাব্যক্তি ও কর্মকর্তা বেশ ভালো করেই জানেন বলে আমার বিশ্বাস। আবার এই গাছগুলো রেখে ফোর-লেন রাস্তা করার পক্ষে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মতের আলোকে অনেক লেখালেখি ও টক’শোগুলোতেও পর্যালোচনামুলক প্রতিবেদন প্রকাশ এবং আলোচনাও হয়েছে।

অনেকে আমার চেয়েও অনেক বেশি যশোর রোডের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে অবগত আছেন। আবার সশরীরে যাতায়াতরত অনেকের যশোর রোডের শতবর্ষী গাছগুলো নিয়ে পর্যবেক্ষণমুলক অবিজ্ঞতাও রয়েছে। তাই আমি সেদিকে না গিয়ে প্রকল্পটি নিয়ে নতুন করে কিছু ভাবা কিংবা দুই পাশের গাছগুলো রেখে ফোর-লেন সড়কটি নির্মাণ করতে কোথাও সংযোজন-বিয়োজন করা যায় কীনা ভেবে দেখার আহ্বান জানাবো।

কারণ ইতোমধ্যেই ৩১ ডিসেম্বর প্রকল্পটির উদ্বোধনও করা হয়েছে এবং বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে গাছ কেটে রাস্তা বানানোর পক্ষেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এখানে সকল পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, গাছ কাটার বিকল্প যে নেই, তা কিন্তু নয়। ভুল শুরুতেই হয়েছে। যখন প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল অর্থাৎ পরিকল্পনাটি গ্রহণের সময় এই গাছগুলোর কথা চিন্তা করলে ভারতের অংশের মতই গাছ রেখে ফোর-লেন রাস্তা প্রশস্ত করার প্রকল্প তৈরি করা যেত। ৩২৯ কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ ২০১৯ সালের মধ্যেই করতে হবে এই ধরনের তাড়াহুড়ো না করে এখনো ভেবে দেখার সময় আছে বলে আমি মনে করি। কারণ বাংলাদেশে অনেক প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরেই বাস্তবায়ন করার রেকর্ড আছে।

এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হতে যশোর রোডের প্রায় আড়াই হাজার বৃক্ষের মাঝে অধিকাংশ শতবর্ষী পুরনো বৃক্ষের জীবন বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রকল্পটির জন্য প্রায় ৫ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করতে হতে পারে। সময়ও লাগবে। জমি অধিগ্রহণে অনেকের ঘর-বাড়ি বা জমি পড়লে সে জমির মুল্যও পরিশোধ করতে হবে। এখানে প্রকল্পটির কিছু সংযোজন এবং কিছু বিয়োজন হতে পারে। তারপরেও আমাদের সবার দাবি- আগামী প্রজন্মকে তাঁর ইতিহাসের স্বাক্ষীর খুব কাছাকাছি যাওয়ার জন্য, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য এবং সর্বপরি প্রায় আড়াই হাজার গাছের নিঃস্বার্থ বিলিয়ে দেয়া ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষার জন্য প্রকল্পটি পূণর্মূল্যায়ন করা হোক।

এখানে হয়তো অনেকেই টাকার অজুহাত তুলতে পারেন। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের তিক্ত কথার স্বাদ গ্রহণে বাধ্য করব মর্মে বলতে চাই- দেশের রাজনীতিবিদ, এমপি-মন্ত্রীসহ দেশের সুশীল সমাজ অকপটে স্বীকার করেন দেশের কতিপয় লোকের দুর্নীতির কারণে অনেক ভালো কাজও ভালোভাবে করা হয় না। তাই অনুরোধ করব- লুট হওয়া ব্যাংকের টাকা ফিরিয়ে আনুন! দুর্নীতিবাজদের খুজে-খুজে বের করুন। বিভিন্ন প্রকল্পের কমিশন পাওয়া-খাওয়া লোকদের ধরুন। তখন শুধু যশোর রোডের শতবর্ষী এই গাছগুলোই বাঁচবে না; আরেকটা পদ্মা সেতু করা সম্ভব হবে।

আবার অনেকে গাছগুলোর প্রতিস্থাপনের কথা বলতে পারেন বা সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই তা করার কথা বললেও আমার মনে হয় অনেকেই এটা ভুলে গেছেন (!) ইতিহাস-ঐতিহ্য কখনো প্রতিস্থাপন করা হয় না। ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হয়, ধারণ করতে হয়।

আর এই ইতিহাস-ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য শুধু আমাদেরই নয়; শতবর্ষী এই গাছগুলোও তাদের শেষ ভরসা নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দিকে তাকিয়ে আছে। কামনা করছে দেশের প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ। একটু বাঁচার আশায়। মহান মুক্তিযুদ্ধের সেইসব শরনার্থীদের অসহায় পথ চলার করুণ ইতিহাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে, ইতিহাসের স্বাক্ষী হতে শতবর্ষী গাছগুলোকে রেখেই রাস্তা প্রশস্ত করার উন্নয়নের কাজ এগিয়ে যাবে এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিষ্ট ফোরাম (বোয়াফ)।