সিরাজী এম আর মোস্তাক

 

আরবী মাসের ১৪ তারিখ। আইয়্যামবিজের ২য় রোজা পালনের পর শেষ রোজার জন্য প্রস্তুত। যথারীতি বই পড়তে পড়তে ঘুমে পড়েছি। স্বপ্নে দেখি, গ্রামের পরিবেশে শীতের সকালে মিষ্টি রোদে ঘরের বারান্দায় বসে কোরান পাঠ করছি। তাকিয়ে দেখি, সামনে বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে। স্বাভাবিক বেশভূষা। সাদা পাঞ্জাবি, পাজামা ও কালোকোট। ঠিক যেন ৭ই মার্চের পোশাকে। আমি তো অবাক। ভালো করে নজর করলাম, দিব্যি বঙ্গবন্ধু। আমি অস্থির হয়ে উঠে পড়লাম। তাড়াতাড়ি বারান্দা থেকে নামতে লাগলাম। বঙ্গবন্ধু শান্ত গলায় বললেন,
থাম! এতো অস্থির হবার দরকার নেই।

বঙ্গবন্ধুর ‘তুই’ সম্বোধনে হৃদয়টা জুড়ে গেল। মনে হল, কত যে কাছের মানুষ! আমি বারান্দা থেকে নামতেই তিনি হাত এগিয়ে দিলেন। আমি আস্সালামু আলাইকুম বলেই বুকে জড়িয়ে ধরলাম। এতোটাই আবেগাপ্লুত হলাম, হাউমাউ করে কান্না শুরু করলাম। বঙ্গবন্ধু আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। এরপর দেখি, একটি সুন্দর চেয়ারে উঠানে মিষ্টি রোদে তাঁকে বসিয়েছি। তখনও হাত ধরে আছি।

আমি বললাম, পিতা! কেমন আছেন?

বঙ্গবন্ধু হাত ছেড়ে (ধমকের সুরে) বললেন, এই! তুই আমাকে পিতা বললি কেন?

আমিঃ আপনি তো বাঙ্গালি জাতির পিতা।

বঙ্গবন্ধুঃ সাবধান! আমাকে জাতির পিতা বলবিনা।

আমিঃ আমিতো শুধু জাতির পিতা বলিনি। বাঙ্গালি জাতির পিতা বলেছি।

বঙ্গবন্ধুঃ (কিছুক্ষণ থেমে) ও....! তাহলে ঠিক আছে।

বঙ্গবন্ধুঃ শোন, অল্প সময়ের জন্য তোর সাথে দেখা করতে এসেছি।

বঙ্গবন্ধুঃ তুই রোজা আছিস না?

আমিঃ জ্বি পিতা (স্বপ্নে মনে হচ্ছে রোযা আছি)।

বঙ্গবন্ধুঃ আমি একটি কষ্টের কথা বলবো।

আমিঃ জ্বি পিতা, বলেন।

বঙ্গবন্ধুঃ প্রতিবছর আমার জন্য কয়েকদিন বিশেষভাবে পালন হয়। তাতে কোরানখানি, পুস্পস্তবক অর্পণ, আলোচনা অনুষ্ঠানসহ অনেক কিছু হয়। এবছর ১৫ই আগষ্টের রাতে হাফেজ সাইফুল নামে একজনকে হত্যা করা হয়েছে।নিহতের হাফেজ পিতাকেও নির্যাতন করা হয়েছে। আমার কী যে কষ্ট হয়েছে, বুঝাতে পারবনা।

আমি কান্না করছি।বারবার চোখ মুছছি।

বঙ্গবন্ধুঃ তুই কাঁদিস ক্যান?

আমিঃ পিতা! আপনি কারো সাথে দেখা করে এ কষ্টের কথা বলেননি?

বঙ্গবন্ধুঃ আমার দেখা করার পারমিশান নাই।

আমিঃ পিতা! তাহলে আমার সাথে..?

বঙ্গবন্ধুঃ শুধু তোর সাথে অল্প সময়ের জন্য দেখা করার পারমিশান পেয়েছি।

বঙ্গবন্ধুঃ সেদিন তোর দোয়ায় আমি শান্তি পেয়েছি।

আমিঃ আল্লাহর কাছে দোয়া করছি, আপনার যেন স্থায়ী শান্তি হয়।

আমিঃ আচ্ছা পিতা! একজন কোরানের হাফেজকে হত্যা করলো কেন?

বঙ্গবন্ধুঃ তাকে জঙ্গি হিসেবে হত্যা করেছে।

আমিঃ জঙ্গিদের হত্যা করতে দোষ কোথায়? কোরআনের হাফেজ হোক, আর যেই হোক।

বঙ্গবন্ধুঃ তোরা বুঝবিনা। তোকে একটা দায়িত্ব দিচ্ছি, ১৫ই আগষ্টে আমার কষ্টের বিষয়টি সবাইকে জানিয়ে দিস।

আমিঃ কাকে জানাবো? কিভাবে জানাবো?

বঙ্গবন্ধুঃ লেখার মাধ্যমে সবাইকে জানাবি।

আমিঃ আমার লেখা কেবা প্রকাশ করবে, আর কয়জনইবা পড়বে?

বঙ্গবন্ধুঃ সে চিন্তা তোর নয়। তোকে দায়িত্ব দিয়েছি, জানাবি।

আমিঃ পিতা! কেউ আমার ক্ষতি করবে নাতো?

বঙ্গবন্ধুঃ ইনশাল্লাহ, কেউ ক্ষতি করবেনা।

আমিঃ ইনশাল্লাহ, অবশ্যই জানাবো।

বঙ্গবন্ধুঃ শুকরান। তবে সাবধান।

আমিঃ কেন পিতা?

বঙ্গবন্ধুঃ এখন রাজনৈতিক অবস্থা ভালোনা।

আমিঃ যেমন?

বঙ্গবন্ধুঃ যেমন এখন চলছে- জঙ্গি অভিযান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অবৈধ স্বার্থ হাসিল ইত্যাদি।

আমিঃ এসবে আবার রাজনীতি কি?

বঙ্গবন্ধুঃ এ যে জঙ্গি অভিযান। এটি সম্পুর্ণ রাজনীতির খেলা। যেমন- গুলশান হলি আর্টিজানে হামলা।

আমিঃ জ্বী পিতা, তাই নাকি?

বঙ্গবন্ধুঃ হলি আর্টিজানে হামলার পর সেনাবাহিনীর প্রেসব্রিফিং শুনিসনি? তারা বললো, মাত্র ৬/৭ জঙ্গি হামলা চালিয়েছে। তাদের আক্রমণেই ২পুলিশ নিহত ও ৪০পুলিশ আহত হয়েছে। তারপর তারা হোটেলে প্রবেশ করে ১৫/১৬ বন্দিকে নিরাপদে ছেড়েও দিয়েছে। দেশের সুদক্ষ প্রতিরক্ষাবাহিনী তাদেরকে সারারাত অবকাশ দিয়েছে। এসুযোগে জঙ্গিরা ২০ বন্দিকে নিরবে হত্যা করেছে। সকালে অপারেশন থান্ডারবোল্ট শুরু হলে, তারা যুদ্ধ করে নিহত হয়েছে। এঘটনার পর এখনও উক্ত হামলায় অভিযুক্তদের পাওয়া যায় কিভাবে? এটা কি রাজনীতির খেলা নয়?

আমিঃ পিতা! আপনি কি বর্তমান ঘটনাও দেখেন এবং জানেন?

বঙ্গবন্ধুঃ আমি সাধারণ মৃতদের মতো নই। আমি জীবিত। তোরা বুঝবিনা। আমি সবই দেখতে পাই, সবই

বুঝি। শুধু প্রকাশ করতে পারিনা।

আমিঃ ও আচ্ছা। পিতা আপনি ভালভাবেই জানেন, জঙ্গি হামলা নিয়ে আপনার মতো এভাবে বলার দুঃসাহস কি কারো আছে?

বঙ্গবন্ধুঃ ঠিকই। বাঙ্গালি আর সাহসী ও বীর জাতি নয়, তারা এখন ভীরু ও কাপুরুষ জাতিতে পরিণত হয়েছে।

আমিঃ তাই।

বঙ্গবন্ধুঃ তুই বিসিএসে ২বার ভাইভা দিয়েছিস; তোর চাকরি হয়নি কেন, জানিস?

আমিঃ পিতা, আমি জানিনা।

বঙ্গবন্ধুঃ তোর মুক্তিযোদ্ধা কোটা নেই, তাই চাকরি হয়নি।

আমিঃ জ্বী পিতা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও রাজনীতি?

বঙ্গবন্ধুঃ জ্বি। আরো জঘন্য রাজনীতি।

আমিঃ তার মানে?

বঙ্গবন্ধুঃ দেশ স্বাধীনের জন্য আমি কতইনা সংগ্রাম করেছি। অথচ মাত্র ২লাখ তালিকাভুক্ত ব্যক্তি এখন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বার্থ ভোগ করছে।

আমিঃ জ্বী পিতা! আপনি কি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করেননি? অসহায়, দুস্থ ও পঙ্গু যোদ্ধাদের ভাতা দেননি?

বঙ্গবন্ধুঃ শুধু ৬৭৬ যোদ্ধাকে খেতাব দিয়েছিলাম। এছাড়া দেশের সবাইকে মুক্তিযোদ্ধা ও লাখো শহীদ পরিবারের সদস্য স্বীকৃতি দিয়েছিলাম। তখন মুক্তিযোদ্ধাভাতা ও কোটার প্রয়োজন ছিলনা। আমি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় করিনি। আমি কি জানতাম, ওরা ৩০লাখ শহীদ নিয়ে প্রশ্ন তুলবে? ৩০লাখ শহীদদের বাদ দিয়ে মাত্র ২লাখ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা করবে? আমি মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ আলাদা করিনি।

বঙ্গবন্ধুঃ তুই কি এখনও বিসিএস নিয়ে হতাশ? এখনও কি ঐ বৈষম্যের চাকরি চাস?

আমিঃ পিতা! আমি ধন্য। আমি আপনার কাছ থেকে সান্ত¦না পেয়েছি। তবে আমার মতো আরো বহুজন যে এ বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, এর কি কোনো প্রতিকার নেই?

বঙ্গবন্ধুঃ অবশ্যই আছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ও কোটা বাতিল করতে হবে। তখন কেউ মুক্তিযোদ্ধা পদবি ব্যবহার করে অবৈধ স্বার্থের জন্য বাড়াবাড়ি করবেনা। তখন ৩০লাখ শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেনা। ৩০লাখ শহীদ পরিবার বঞ্চিত হবেনা। সবাই খাঁটি দেশপ্রেমিক হবে।

বঙ্গবন্ধুঃ আমার সময় শেষ। ঐ দেখ, ডাকতে এসেছে।

আমিঃ (আবার হাউমাউ করে কান্না করছি আর বলছি) কোথায়? কাউকে তো দেখছিনা।

বঙ্গবন্ধুঃ তুই দেখতে পাবিনা। যা দায়িত্ব দিলাম, ঠিকমতো পালন করিস।

আস্সালামু আলাইকুম বলে হাত এগিয়ে দিলেন। আমি বঙ্গবন্ধুকে আবার জড়িয়ে ধরলাম। অঝোড়ে অশ্রু ঝড়ছে।

এসময় ঘুম ভেঙে গেল। দেখি, চোখের পানিতে বালিশ ভিজে গেছে। মনে হলো, কি মহান সম্পদ হারালাম। হায় আবার যদি বঙ্গবন্ধুর দেখা পেতাম! খুবই অস্বস্তি লাগল। রাত তখন তিনটা বাজে। নফল নামাজ পড়ে বঙ্গবন্ধুর জন্য দোয়া করলাম। তারপর সেহরী সেরে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে শোনা ঘটনা যাচাই করার জন্য ‘নিহত হাফেজ সাইফুল’ লিখে গুগলে সার্চ দিলাম। দেখলাম, সম্পুর্ণ সঠিক। আমি জানতাম না, ১৫ই আগষ্টে হাফেজ সাইফুল নামে কারো হত্যার ঘটনা। আবার হাফেজ সাইফুলের বাবা হাফেজ কিনা, তা জানার প্রশ্নই আসেনা। বঙ্গবন্ধু স্বপ্নে আমাকে তাঁর এ কষ্টের কথা বলার অর্থ কি, ভেবে পাচ্ছিলামনা। স্বপ্নের এ কথাগুলো লেখা উচিত কিনা, অনেক চিন্তা করলাম। বিবেকের তাড়নায় লিখতে বাধ্য হলাম।

আমি পেশাদার লেখক নই। তাই ভূল-ভ্রান্তি অস্বাভাবিক নয়। এটা একান্তই স্বপ্নের বিষয়। এ নিয়ে রাজনীতি করার কিছু নেই। তবু আশংকা হয়, বিষয়টি কে কিভাবে নেয়। আমি স্বপ্নেপ্রাপ্ত বঙ্গবন্ধুর মহান নির্দেশ পালন করেছি; শুধু এ আশায়, যদি আবার তাঁর দীক্ষা পাই।

লেখক : শিক্ষানবিস আইনজীবী, ঢাকা।