শরীয়তপুর প্রতিনিধি : শরীয়তপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বি,এম মোজাম্মেল হকের ভয়ে আতংকিত হয়ে দিন কাটাচ্ছেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তার পরিবার। সম্প্রতি একজন মুক্তিযোদ্ধা সাংসদ মোজাম্মেল হককে রাজাকার প্রতিপালনকারী বলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেই ওই মুক্তিযোদ্ধাকে নানা ধরনের হুমকি প্রদান ও অশালীন ভাষায় গালাগালি করেন সাংসদ। সাংসদের এই অমার্জিত আচরনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছরিয়ে পরার পর বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠে শরীয়তপুরের মুক্তিযোদ্ধা-জনতা।

একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি ও হুমকি দেয়ার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার শরীয়তপুর জেলা সদরে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান করেছেন জেলার মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ, শ্রমিকলীগ ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানসহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ।

জানা গেছে, গত ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে জেলার জাজিরা উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে জাজিরা মোহর আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে ৩ শত জন মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা প্রদানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে শরীয়তপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বি,এম মোজাম্মেল হক প্রথমইে সকল মুক্তিযোদ্ধাকে রজনীগন্ধা ফুলের ষ্টিকার দিয়ে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানানো শুরু করেন।

এক পর্যায়ে জাজিরা পৌরসভাধীন খোসাল শিকদার কান্দি গ্রামের মৃত শব্দর খানের ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী হোসেন খানের কাছে ফুল নিয়ে গেলে তিনি সাংসদকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “ আপনি রাজাকার লালন করেন, আপনি রাজাকারের সন্তানকে মূলনা ইউপি নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন দিয়েছেন, আমি আপনার হাত থেকে এই ফুল নিতে পারিনা”।

সাংসদকে মুখের উপর এমন উচিৎ কথা বলে দেয়ায় তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেন মোজাম্মেল হক। তিনি মুক্তিযোদ্ধা আলী হোসেনকে উত্তেজিত হয়ে বলেন, “ আপনি বাজে কথা কথা বলবেননা, রাখেন, বসেন আপনে, ফালতু কথা বলেন কেন, আপনি কি সার্টিফিকেট দেন নাকি মুক্তিযোদ্ধাদের, আপনার থেকে আমার বয়সটা কি কম নাকি, ফালতু করেন, রাখেন, ফালতু কথা বলেন, আর কোনদিন বলবেন না কিন্তু, কোন দিন বলবেননা, বেয়াদ্দপ, খবরদার আর কোনদিন বলবেননা, তাইলে খুব-খুব ক্ষতি হয়ে যাবে আপনার, বেয়াদ্দপ, ও সার্টিফিকেট দেওয়ার ক্যাঠা, সব রাজাকার বানায়া ফেলতেছে, ও বালের মুক্তিযোদ্ধা হইছে, বেয়াদ্দপ, আর একদিন যদি শুনি একটা বাজে কথা, তাইলে কিন্তু খবর আছে, আমি তোমার সম্পর্কে জানি কিন্তু, তুমি খুব বাজে বাজে কথা বলো, খবরদার আর একদিন কিছু শুনি যদি...” ইত্যাদি। মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধিত করার সময়ে এভাবে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে ভৎসনা করায় হতবিহবল হয়ে পরেন শত শত মুক্তিযোদ্ধা। এ সময় উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সভাপতি সামসুল হক খান সাংসদের পাশে দাড়িয়ে থাকলেও আলী হোসেনকে অপমান করার কোন প্রতিবাদ না জানানোয় বিস্মিত হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা।

ঘটনার একমাস দুইদিন পরে বিক্ষোভ কেন করা হলো জানতে চাই বিক্ষোভকারি মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধকালিন কমান্ডার আব্দুল রহমান খান, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক, আবুল জলিল, আবুল হোসেন, আবুল কাশেম ফকির বলেন, আমাদের হাতে এতদিন যথাযথ প্রমান ছিলনা। আমরা সংগঠিত হতে সময় নিয়েছি। ভিডিও ফুটেজটি আমাদের হাতে আসার পর আমরা আন্দোলনে নেমেছি। আমাদের এই আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। ২০০৮ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই মোজাম্মেল হক রাজাকার পরিবারের সন্তানদেরে, ৭১ এর চিহ্নিত শত্রুদের প্রতিপালন করে আসছেন। তিনি আলী হোসেন খান নামে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছেন এবং তাকে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করেছে। আমরা এর বিচার চাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের দাবি বি,এম মোজাম্মেল হককে আওয়ামীলীগ থেকে বাদ দিতে হবে।

লাঞ্ছিত-আতংকিত মুক্তিযোদ্ধা আলী হোসন খান বলেন, আমি ১৯৭১ সনের ১০ জানুয়ারী পাকিস্তান আর্মিতে যোগদান করি। ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষন শুনে অনুপ্রানিত হই এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি। দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে ২ নং সেক্টরে কর্নেল শওকত আলীর অধীনে ৯ মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। একজন মুক্তিযোদ্ধা ও বঙ্গবন্ধুর আদশের সৈনিক হিসেবে আওয়ামীলীগের একজন এমপি ও কেন্দ্রীয় নেতা কর্তৃক রাজাকার লালন করাটা আমি কখনই মেনে নিতে পারিনি। তাই গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে এমপি মোজাম্মেল সাহেব আমাকে ফুল দিতে এগিয়ে এলে আমি তাকে রাজাকারের পালনকারি হিসেবে মন্তব্য করলে আমার উপর চড়াও হন। এ সময় আমাকে কিভাবে অপমান করেছে তা আপনারা ভিডিও চিত্রে দেখেছেন। এখন আমি খুব ভয় ও আতংকে আছি। কখন কি করে ফেলে জানিনা। তার কথায় ডিসি, এসপি, ওসি সব ওঠে বসে। আমাকে পাহারা দেওয়ার তো কেউ নেই। সাংসদ মোজাম্মেল হক কি ভাবে রাজাকার লালন করেন জানতে চাইলে আলী হোসেন বলেন, ২৮ ডিসেম্বর জাজিরার মূলনা ইউনিয়নের নির্বাচনে আমাদের এমপি মোজাম্মেল সাহেব সেলিম শিকদার নামে একজন রাজাকারের পূত্রকে নৌকা মার্কার মনোনয়ন দিয়েছে। আমি সেই কথাটিই তাকে বলতে চাইলে তিনি আগুনের মত জ্বলে উঠে অমাকে বকাঝকা, অপমান ও হুমকি প্রদান করেন।

জাজিরা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সামসুল হক খান বলেন, ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সংসদ সদস্য ফুল দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বরণ করার সময় আলী হোসেন সাংসদকে বলেন, আপনি টাকা পয়সা খাইয়া রাজাকারকে মনোনয়ন দিয়েছেন। এ কথা শুনার পর মোজাম্মেল হকের সেন্টিমেন্টে লাগায় সে উত্তেজিত হয়। আমি ওই মুহুর্তে আমি বিব্রত বোধ করতেছিলাম, কি করবো ভেবে পাচ্ছিলামনা, সব মুক্তিযোদ্ধারা আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, আমি দোদুল্যমান ছিলাম, দ্বিধাদ্বন্দে ছিলাম। মোজাম্মেল আমার বন্ধু, সংসদ সদস্য, সাংগঠনিক সম্পাদক সবকিছু মিলিয়ে অপমান হজম করে নেই। পরবর্তিতে আমি এমপি সাহেবকে ব্যক্তিগতভাবে কঠোর সমালোচনা করেছি। আমি মোজাম্মেল হককে বলেছি আপনার মাফ চাইতে হবে, এতে সে রাজি হন। কিন্তু ঘটনা এখন ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে।

(কেএনআই/এসপি/জানুয়ারি ১৯, ২০১৮)