চৌধুরী আবদুল হান্নান 


ঘরে আগুন লাগলে তাৎক্ষনিকভাবে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিতে হয়। আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধান জরুরি নয়। অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা রোগীকে স্বাস্থ্যকর সুষম খাদ্য খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া অর্থহীন। কারণ তার খাদ্য গ্রহণের স্বাভাবিক ক্ষমতাই নেই।

ব্যাংকিং খাতের শৃংখলা ফেরাতে, সংকট নিরসনে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের পক্ষে বিশেষ মতামত দিয়ে চলেছেন। মনে হবে চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ার মতো অথবা এত দিন কোথায় ছিলেন? তবে ব্যাংকিং কমিশনের ধারনা নতুন নয় এবং এ কথাও সত্য অর্থনীতি বা ব্যাংকিং বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যাক্তিরা ব্যাংক ব্যবস্থাকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য প্রতিনিয়ত নানা যৌক্তিক পরামর্শ দিয়েছেন কিন্তু তা আমলে নেওয়া। আসলে যেখানে অর্থের অবৈধ প্রবাহ বেশি সেখানে কেবল পরামর্শে কাজ হওয়ার সম্ভবনা কম। তাহলে এ প্রস্তাবিত কমিশনে কারা থাকবেন? বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে দক্ষ সৎ ব্যক্তিদের নিয়েই কমিশর গঠন হবে। কেউ হবেন কমিশনের চেয়ারম্যান, কেউ হবেন সদস্য। এ নিয়োগ কতটা স্বচ্ছ হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

বাংলাদেশে ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগে যেখানে কোনো নীতিমালা নেই, ব্যক্তির ইচ্ছা বা দলীয় ইচ্ছাতেই নিয়োগ। কমিশনের নিয়োগেও তো তাই হবে। তাছাড়া এখানে নিয়োগ পাওয়ার জন্য একটা নীরব প্রতিযোগিতাও থাকবে। আর তারা তো আমাদেরই লোক। চরিত্রে ব্যতিক্রম আশা করা যায় না। কারণ আমাদের অবস্থা ঘর পোড়া গরুর মতো। আর তাছাড়া প্রতিটি ব্যাংকেরই তো পরিচালনা পর্ষদ রয়েছে, তারাই তো এই ব্যাংকের জন্য এক একটা কমিশন হতে পারে।
কমিশনের কাজ কি হবে?

মূলত ব্যাংক সম্পর্কে রিপোর্ট পেশ করা, সুপারিশ করা কিন্তু প্রদত্ত মতামত কার্যকর করার ক্ষমতা তো কমিশনের থাকবে না। কারণ এ মতামত / পরামর্শ কার্যকর করার দায়িত্ব রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। আইনগতভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীন এবং ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক ক্ষমতা রয়েছে। যদিও তার ক্ষমতা প্রয়োগের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে? কেহ কেহ বলেছেন, খেলাপি ঋণ বন্ধে এই কমিশনের বিকল্প নেই। মনে হবে , এ মতামত ব্যাংকিং এর সাথে বাস্তব অভিজ্ঞতাহীন এবং পুথিগত বিদ্যায় পন্ডিত ব্যক্তিদের গতানুগতিক বক্তব্য এবং অনেকটা হাস্যকরও। খেলাপি, অবলোপনকৃত, বেনামি, ভূয়া,ভূয়া- আমানতের মান মোকাবেলায় ব্যাংকিং কমিশনের ধারনা বাদ দিয়ে বরং ‘স্পেশাল ব্যাংক ট্রাইবুনাল’ গঠন করা এখন বেশি জরুরি।

সাধারণ আদালতে দায়েরকৃত মামলার দুর্দশা প্রত্যক্ষ করলে এ প্রস্তাব আরও ঝুকি সংগত মনে হবে। বর্তমানে ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে অবকাঠামো রয়েছে তা যতেষ্ট, কেবল তা প্রয়োগ করার কৌশল ও সক্ষমতা চাই। যে অস্ত্র হাতে আছে তা ব্যবহার না করে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য নতুন অস্ত্র আমদানি করা যুক্তি সঙ্গত ভাবা যায় না ।

ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ রাখার সবচেয়ে বড় অস্ত্রটির নাম অডিট । বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন অডিট, অন্যান্য ব্যাংকের বা প্রতিটি ব্যাকের নিজস্ব অডিট , সরকারি অডিট এবং এ জাতীয় অসংখ্য অডিট কার্য পরিচালনা করা হয় । তারপরও রয়েছে বাংলাদেশ স্পেশাল ইন্সপেকশন, সারপ্রাইজ ইন্সপেকশন ইত্যাদি । এ সকল অডিট রির্পোট অনুসরণ করা হলে ব্যাংকের অর্থ লোপাট তো দূরের কথা কোনো অনিয়ম হওয়ারই আশংকা কমে যায় । ব্যাংকে সংঘটিত পূর্বের যে কোনো বড় অর্থ কেলেংকারির অব্যবহিত পূর্বের অডিট রিপোর্টের সুপারিশ/মতামত পরিচালন করা হলে এ রকম কোনো দুর্ঘটনা ঘটতো না ।

নিশ্চিত বলা যায়, ব্যাংক ব্যবস্থা রর্ক্ষাথে বহুস্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তা বলয় বিদ্যমান রয়েছে । এখন প্রয়োজন কেবল তা কার্যকর রাখা। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক /বোর্ড চেয়ারম্যানের শীর্ষ নির্বাহী পদে নীতিনিষ্ঠ ও স্বাধীনচেতা মানুষ চাই। যারা লাভজনক পদে নিরাপদে অবস্থান করার জন্য তোষামোদে ব্যস্ত থাকবেন না ।

কাজেই বাংলাদেশে ব্যাংকের হাতকে শক্তিশালী করা এবং বিদ্যমান বিধি-বিধান সঠিক প্রয়োগের মধ্যেই নিহিত রয়েছে ব্যাংক ব্যবস্থা সুরক্ষার মূলমন্ত্র।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার