মোঃ আব্দুল কাইয়ুম, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি : বর্ষাকালে আবারো চলবে নৌকা। জেলে কিংবা কৃষাণ কৃষাণী আবারো মেতে উঠবে নানা প্রজাতির দেশীয় মৎস্য আহরণের উৎসবে। তিনটি ইউনিয়নের হাজারো মানুষের মনে এরকম সপ্ন এখন দিবালোকের মতো সত্য হতে চলেছে ঐতিহ্যবাহী কোদালীছড়া খাল খননের মধ্যদিয়ে। দীর্ঘ চার কিলোমিটার খননের ফলে এ অঞ্চলের মানুষ ফিরে পাবে তাদের শত বছরের ঐতিহ্যবাহী কোদালীছড়া খাল। নতুন ধানের ঘ্রানে পরিবারে ফুটবে হাসি আর কৃষকের ঘরে ঘরে অগ্রাহয়ন মাসে নানান জাতের আর নানান স্বাধের পিঠাপুলির উৎসব ।

বয়স্কদের কাছ থেকে জানা যায়, চির যৌবনে ভরপুর এক কালে এই কোদালীছড়া দিয়ে নৌকা চালিয়ে মৎস আহরন, গরু মহিষের খাবার সংগ্রহ আর এক গ্রামের মানুষের সাথে অন্য গ্রামের মানুষের মেলবন্ধন আর যোগাযোগের গল্পের কথা। এসব এখন শুধুই ইতিহাস।

দেখলে মনে হবে বর্তমানে খালটি তার অতীত যৌবন হাড়িয়ে ঢুকরে খাঁদছে । শুকনো মৌসুম কিংবা বুরো মৌসুম বলে কোন কথা নেই এ অঞ্চলের অবহেলিত হাজারো কৃষকের কাছে। গত কয়েকদশক ধরে সদর উপজেলার ১১নং মোস্তফাপুর ইউনিয়ন,নাজিরাবাদ ইউনিয়ন ও ১২নং গিয়াসনগর ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের কয়েক হাজার কৃষকের সপ্নভঙ্গের কষ্টের খবর কেউ রাখেনি।

কৃষি নির্ভর এসব পরিবারে খাবারও জোটেনি দুই বেলা ঠিকমত। বছরে দুইবার কষ্ট করে রোপন করা ক্ষেত ঘরে তোলার পূর্বেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন এনজিও থেকে টাকা ধার নিয়ে সনাতনি পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক পদ্ধতিতে ব্যয়বহুল কৃষিক্ষেত করে শুকনো মৌসুমে তীব্র পানির সংকট আর বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার ফলে তলিয়ে যাচ্ছে কৃষকের সপ্নের সোনালী ফসল।

এসব কৃষকের মুখে হাসি ফোটাতে এবার এঅঞ্চলের হাজারো কৃষকের সপ্নজয়ের হাতছানি দিচ্ছে কোদালীছড়া খনন । পৌর শহরের বর্জ আর খালের নাব্যতা সংকটের কারনে খালটি দীর্ঘদিন যাবত পার্শবর্তী কৃষি জমি আর খালের মধ্য অংশ সবই একাকার হয়েগেছে। কোদালীছড়া নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রকাশ করা সংবাদ গুগোল সার্চ দিলে একের এক বেড়িয়ে আসবে। মানববন্ধন আর স্মারকলিপীও কম দেয়া হয়নি বছরের পর বছর জুড়ে ।

জানা যায়, গত একযোগেরও বেশি সময় ধরে জগন্নাথপুরের খাইঞ্জার হাওরে ফলেনি কৃষকের সোনালী ধান । পানির তীব্র সংকট আর বর্ষা মৌসুমে মৌলভীবাজার শহরের জলাবদ্ধতার প্রভাবের কারণে এই হাওরে জমে থাকা পানিই কৃষকের ক্ষেত নষ্ট হবার মূল কারণ। প্রতি বছর তলিয়ে যায় কৃষকের ঘামঝরানো কষ্টের সোনালী ফসল । সময় বদলায় , সরকার বদলায়, জনপ্রতিনিধি পরিবর্তন হয় তবুও পরিবর্তন হয়নি এঅঞ্চলের কৃষকের ভাগ্য। তবে এবার বদলে যাবে এসব ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের হাজারো কৃষকের ভাগ্য।

এ অঞ্চলের হাজারো কৃষকের মুখে হাসি ফোটাতে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) সিলেট বিভাগ ক্ষুদ্রসেচ উন্নয়ন প্রকল্পের অধিনে বহুল আলোচিত কোদালিছড়া খালের ২য় অংশের পুনঃখনন কাজের উদ্বোধন করা হয় গত ১৭ জানুয়ারী বুধবার থেকে। এর পর থেকে খালটি খনন হচ্ছে দ্রুততার সাথে।

এদিকে কোদালীছড়া খনন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে অল্প বৃষ্টিতে মৌলভীবাজার শহরের জলাবদ্ধতার দীর্ঘদিনের সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে শহরবাসী। শহরের জলাবদ্ধতা থেকে শহরবাসী মুক্ত হলে তার ফল ভুগ করবে মৌলভীবাজার শহরের পৌর এলাকার বাসিন্দারা ছাড়াও খালের দুই পাড়ের পার্শবর্তী গ্রামের বাসিন্দারাও।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ৪০ ফুট প্রসস্ত্র ও ১০ ফুট গভীরে খাল খনন করছেন এর সাথে যুক্ত শ্রমিকরা। জগন্নাথপুর খাইঞ্জার হাওর এর মধ্য অংশ দিয়ে প্রবহমান কোদালীছড়া খালের খনন কাজ শুরু হয়ে তা শেষ হবে এই হাওরের শেষ সিমানার ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত। খাল পূর্ণখননের ফলে এই হাওরের জলাবদ্ধতা দূর হয়ে যাবে বলে ধারনা প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের।

কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুল হক জানান, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে শহরের জলাবদ্ধতা দুর হবার পাশাপাশি এই অঞ্চলের কৃষকের মুখে ফুটবে হাসি। তবে ৪ কিলোমিটার জুড়ে খাল খনন হলেই কি কোদালীছড়ার আশপাশের জলাবদ্ধতা দুর হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে প্রকৌশলী আরিফুল হক জানান, বাকি অংশ সরেজমিনে গিয়ে দেখে তার পর খাল খনন করা হবে।

এ বিষয়ে জগন্নাথপুর গ্রামের তরুন কৃষক জুনেদ আহমদ বলেন, চার কিলোমিটার খাল খনন হলেও জলাবদ্ধতা দূর হবেনা যতক্ষননা বাকি অংশ অর্থাৎ গিয়াসনগর ইউনিয়নের আনিকেলীবড়, নয়ানছিড়ি ও মারকোনা গ্রামের পাশ দিয়ে যাওয়া অংশ খনন হবেনা।

তিনি বলেন, অনেক কষ্ট করে বুরো ও অগ্রাহায়ন মাসে ধানের চাড়া রোপন করলেও বুরো মৌসুমে পানির সংকট আর বর্ষা মৌসুমে পুরো হাওর জুড়ে জলাবদ্ধতা সহ বিভিন্ন ধরনের পোকার আক্রমনের কারনে নষ্ট হয়ে যায় ফসল, ফলে কাংঙ্খিত ফসল ঘরে তুলা সম্ভব হয়না।

তিনি আরও বলেন, এবার কোদালীছড়া খননের কারনে বুরো মৌসুমে যেভাবে পানির সংকট দেখা দিত সেটি থেকে মনে হচ্ছে আমার মতো আরো অনেক কৃষক মুক্তি পাবে। খাল খনন কাজ দেখতে গিয়ে দেখা যায় খালের দুই পাড়ে খনন কাজ দেখছেন জাবেদ এর মতো আরো অনেক কৃষক। তাদের চোখেমুখে বুরো ধানের অগ্রিম হাসি দৃশ্যমান। সবার আশা এবার অন্তত কাঙ্খিত ফসল ঘরে উঠবে। ফীরে পাবে কোদালীছড়া তার হারানো যৌবন।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বর্তমান প্রকল্পটির ব্যয় ৫৪ লক্ষ টাকা ধরা হলেও ই-টেন্ডারের মাধ্যমে হবিগঞ্জের ঠিকাধারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স চৌধুরী এন্টারপ্রাইজ ৪৬ লক্ষ টাকা ব্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ পেয়েছে।

কোদালীছড়া খনন কাজ নিয়ে সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ভিপি মিজানুর রহমান এর সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এই প্রকল্পটি সদর উপজেলার প্রকল্প, পৌরসভার ভিতর দিয়ে কোদালীছড়ার যে অংশটি গেছে তা আমাদের প্রকল্পের অংশনা তার পরেও আমরা সেগুলোর খনন কাজ করে দেবো । তিনি আরো বলেন, চার কিলোমিটার খনন কাজ শেষে খালের পরবর্তি অংশ সরেজমিন দেখতে ঐ এলাকায় আমি যাবো।

কোদালীছড়া খাল নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা করে আসছেন বাংলাদেশ টেলিভিষন (বিটিভি) এর মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি ,সমাজকর্মী ও সাংবাদিক হাসনাত কামাল। মুঠোফোনে এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে তিনি জানান, কোদালীছড়া খাল হলো একটি অব্যাহত প্রকল্প। পূর্বে ৪-৫ পাঁচকিলোমিটার খনন হয়েছে। বর্তমানে ভাটি অঞ্চলে এর কাজ অব্যাহত থাকবে ।

তিনি বলেন, মৌলভীবাজার পৌরসভা তাদের নিজস্ব এস্কালেটারে কাজ পেয়েছে এবং খনন কাজ শুরু করেছেন। সুতরাং এটি অব্যাহত প্রসেস। গত বছর তুলনা মূলক কম কাজ হয়েছে আর এবার বেশি কাজ হবে।

তিনি আরো বলেন, কোদালীছড়ার সব জায়গা খনন হলে মানুষ এর ফল ভুগ করবে তবে সময় লাগবে, বিষয়টাকে আমি পজেটিভ দৃষ্টিতে দেখছি।

(একে/এসপি/জানুয়ারি ৩১, ২০১৮)