হবিগঞ্জ প্রতিনিধি : দুর্নীতি ও অনিয়মের মধ্য দিয়ে হবিগঞ্জের বানিয়াচঙ্গ ইকরাম, বাল্লা হয়ে কুমড়ী দুর্গাপুর রাস্তা নির্মাণ কাজ চলছে বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। 

সূত্র জানায়, এলজিইডির হাওর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় হিলিপ প্রকল্পের মাধ্যমে ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ইকরাম ও বালøা হয়ে কুমড়ী দুর্গাপুর রাস্তা নির্মাণ কাজ গত বছর শুরু হয়। নির্মাণের জন্য সড়কটিকে ৭টি প্রকল্পে ভাগ করা হয়। ওই ৭টি প্রকল্পের এলসিএস কমিটির সদস্যদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রকল্পের নির্মাণ কাজ করানোর কথা রয়েছে। কিন্তু প্রকল্পগুলোর সভাপতিকে ম্যানেজ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তূষি এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের জুলন রায়সহ কয়েকজনকে সাব ঠিকাদার নিয়োগ করে রাস্তাটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন।

রাস্তা নির্মাণ কাজে নামমাত্র এলসিএস কমিটির সদস্যদের রেখে তাদের পছন্দমতো শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। শুধু তাই নয়, অভিযোগ উঠেছে নির্মাণ কাজের শুরু থেকে এলসিএস কমিটির সভাপতিদের ম্যানেজ করে প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিম্নমানের বালু পাথর ব্যবহার করছেন। নিয়ম অনুযায়ী ঢালাই ৬ ইঞ্চি করার কথা থাকলেও সেখানে ২/৩ ইঞ্চি ঢালাইর কাজ করা হয়েছে এবং ৫টি ইটের মাধ্যমে ১৮ ইঞ্চি গাথুনী দেয়ার কথা থাকলেও কোন স্থানে ৩টি ও কোন স্থানে ২টি ইট দিয়ে ১০/১১ ইঞ্চি গাথুনী দেয়া হয়েছে।

ব্যাপক অনিয়ম হওয়ার কারণে বিগত বছর যে ২টি প্রকল্প নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন হয়েছে সেগুলোর ঢালাই বিভিন্ন জায়গায় ফেটে যাচ্ছে। বিগত বর্ষা মৌসুমে পানি আসার ফলে প্রকল্পের কাজ স্থগিত হয়ে যায়। ইদানিং স্থগিত হওয়া প্রকল্পের একটি অংশের কাজ শুরু হয়েছে। ঢালাই কাজে সাদা বালু ও নিম্নমানের মোটা বালু ও কম সিমেন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে। যার কারণে ঢালাই সম্পন্ন করা জায়গা কয়েকদিন পরই ফেটে যাচ্ছে।

এছাড়াও মাটির উপর ঢালাই কাজ করা হচ্ছে। রাস্তাটি নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে এলাকাবাসীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত বছর এ ব্যাপারে হবিগঞ্জ জেলা পরিষদের ৩নং ওয়ার্ডের সদস্য মোঃ আশিক মিয়া এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী ও হবিগঞ্জ জেলা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) উপ-পরিচালক বরাবর অভিযোগ দেন। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকরি কোন উদ্যোগ না নেয়ায় প্রকল্পের সাথে জড়িত সংশিøষ্টরা নির্ভয়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে রাস্তাটির নির্মাণ কাজ করে যাচ্ছেন।

এলসিএস কমিটির সদস্য হরিপুর গ্রামের বাসিন্দা জয় কুমার চৌধুরী জানান, আমরা শুধু নামেমাত্র এলসিএস কমিটির লোক। সব কাজ তারাই করে থাকে। এলাকার লোকজনদের প্রশিক্ষণ দেয়া হলেও প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তাদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন না। অথচ আমাদের মাধ্যমে তারা ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে নিয়ে যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, যেদিন ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করা হয় সেদিন হিলিপের আরিফ আহমেদ এলসিএসসি কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে হবিগঞ্জে আসা-যাওয়া বাবদ ৮০টাকা ও আরো দেড়শত টাকা দেন। বাকি টাকাগুলো আরিফ আহমেদসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা নিয়ে যান।

তিনি আরও বলেন, এলাকার মানুষ অনিয়মের অভিযোগ দিলে আমরা যখন ঘটনাস্থলে যাই তারা ৫ ইঞ্চি ও সাড়ে ৫ ইঞ্চি কাজ করান। আমরা আসার পরই অনিয়ম করা হয়। কাজে আমাদের এলাকার শ্রমিকদের নেয়ার কথা বললেও তারা অন্য স্থান থেকে শ্রমিক এনে কাজ করান। আবার কোন সময় আমাদের এলাকার দুয়েকজন শ্রমিক নেন।

সাবেক মেম্বার দয়ানন্দ দাস জানান, রাস্তার গাইড ওয়াল নির্মাণে ৫টি ইট দিয়ে ১৮ ইঞ্চি গাথুনী দেয়ার কথা থাকলেও তারা কোন কোন স্থানে ৩টি, আবার কোন স্থানে ২টি ইট দিয়ে গাথুনী দিয়েছেন।

ইউপি সদস্য রানু দাশ জানান, নির্মাণ কাজে কোন ধরণের বিট বালু ব্যবহার করা হয়নি। তবে সাংবাদিকসহ এলাকাবাসী রাস্তা পরিদর্শনে যাওয়ার পর হালকা একটু সাদা বালু ফেলে ঢালাই কাজ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা এর প্রতিবাদ করলেও তারা শুনছেন না, বরং কাজ ফেলে যাওয়ার হুমকি দেন।

ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি এলএসসি কমিটির সভাপতি হরভল্লব চৌধুরী জানান, ঢালাই কাজে মসলায় সিডিউল মোতাবেক সিমেন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে না। আমাদের যেভাবে ট্রেনিং দেয়া হয়েছে, সে অনুযাযী কোন কাজ হচ্ছে না। তারা চেক বইয়ে আমাদের স্বাক্ষর নিয়ে টাকা উত্তোলন করছেন। আমরা কোন ধরণের কথা বললে তারা শুনছেন না।

প্রকল্পের সভাপতি দ্বিজরাজ চৌধুরী জানান, বাল্লা থেকে কুমড়ী পর্যন্ত যে রাস্তাটি হচ্ছে, নিয়ম অনুযায়ী তার কাজ হচ্ছে না। প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ১০/১৫ ভাগ কাজ নিয়ম অনুযায়ী করছেন। সকল কাজ ইঞ্জিনিয়ারের মাধ্যমে করানো হচ্ছে। আমাদের লোকজনকে দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে না। তিনি বলেন- যে কাজটি রয়েছে, সে কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করা হোক এবং তা সঠিক হয়েছে কি না তা যাচাই করা হোক।

পৈলারকান্দি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি জয়নাল আবেদীন তালুকদার জানান, ‘প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নকারীরা আমাদের কোন কথাই শুনছেন না। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।’

প্রকল্পের শ্রমিকরা জানান, মনির মিয়া নামে এক ঠিকাদারের মাধ্যমে এখানে এসে কাজ করছি। আমাদের ৪/৫ শত টাকা বেতন দেয়া হচ্ছে।

ঠিকাদার মনির মিয়া জানান, আমরা এ রাস্তার নির্মাণ কাজ করছি। কোন প্রকার এলসিএস কমিটির সদস্যদের দিয়ে কাজ করানো হয় না।

হিলিপের প্রকল্প পরিদর্শক আরিফ আহমেদ জানান, আমরা নিয়ম অনুযায়ীই কাজ করে যাচ্ছি। রড, সিমেন্ট ও বালু পরিমাণ মত ব্যবহার করছি। আমাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা।

হবিগঞ্জ জেলা পরিষদের ৩নং ওয়ার্ডের সদস্য আশিক মিয়া জানান, এলাকাবাসীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে কাজ পরিদর্শন করে দেখেছি। এখানে সম্পূর্ণ অনিয়মের মাধ্যমে কাজ হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী ৬ ইঞ্চি ঢালাই দেয়ার কথা থাকলেও ৩ ইঞ্চি ঢালাই দেয়া হচ্ছে। ৬ ইঞ্চি বালু দেয়ার কথা থাকলেও বালু না দিয়ে মাটিকে গুড়ো করে দেয়া হচ্ছে। তিনি দাবি করেন, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নির্মাণ কাজটি পরিদর্শন করলে অনিয়মের সত্যতা পাবেন।

এ ব্যাপারে হবিগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ খান জানান, সাংবাদিকদের মাধ্যমে এ বিষয়টি আমি জেনেছি, বিষয়টি আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি।

(এমইউএ/এসপি/ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৮)