মাদারীপুর প্রতিনিধি : চোখের সামনেই সন্তানদের মৃত্যুর পথযাত্রা ভেবে বিরল রোগ আর দারিদ্রতার কাছে মা-বাবা অসহায় হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া সামান্য জমিজমা সর্বস্ব বিক্রি করে একমাত্র ছেলেকে বাঁচাতে চেষ্টা করলেও সেই প্রিয় সন্তান ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে। এমনই এক নির্মম বাস্তবতার মুখে বিরল রোগে আক্রান্ত মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার রাজ্জাক শেখের পরিবার। বিরল রোগে আক্রান্ত একমাত্র ছেলে আব্বাসের একটি পা অস্বাভাবিক আকার ধারণ করেছে। শরীর জুড়ে আঁচিলে ভরা।

এছাড়াও ঐ পরিবারে ২৪ বছর ধরে বড় মেয়ে বিছানায় প্রতিবন্ধী। আর বোন ৪০ বছরের প্রতিবন্ধী জীবন কাটাচ্ছে জরাজীর্ণ বিছানায়।

পরিবারিক ও প্রতিবেশিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মাদারীপুর জেলার রাজৈর পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ডের আলমদস্তার গ্রামের রং মিস্ত্রী আ. রাজ্জাক শেখের ৩ সন্তান ও বোন জন্ম প্রতিবন্ধী। ৪০ বছর বয়সী বোন ইসমত-আরা শারীরিক ও বাক প্রতিবন্ধী। এই ৪০ বছর ধরেই বিছানায় জীবনযাপন তার। ২৪ বছর বয়সী বড় মেয়ে শারমিন আক্তারের একই দশা। সেও বিছানায় শুয়ে কাটাচ্ছেন দূর্বিসহ জীবন। ১৭ বছর বয়সী ছোট মেয়ে আদুরী আক্তার প্রতিবন্ধী জীবন কাটিয়ে এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় মারা যায় ৩ বছর আগে।

১৩ বছর বয়সী একমাত্র ছেলে আব্বাস শেখ জন্মের পর ডান পা মোটা ছাড়া প্রায় স্বাভাবিক ছিল। বংশের প্রদীপ নিভে যাওয়ার আশঙ্কায় মোটা পায়ের চিকিৎসা করাতে শুরু থেকেই আপ্রাণ চেষ্টা করে মা-বাবা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়সহ দেশের নামী-দামী সকল হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করেছেন। কিন্তু উন্নতির পরিবর্তে দিনদিন অবনতির হয়ে ডান পা ফুলে হাতির পায়ের মতো হয়েছে। নির্গত হচ্ছে এক ধরণের রস। ছেলেটির সারা শরীর জুড়েই হয়েছে ছোট বড় হাজারো আঁচিল সদৃশ। বয়সের চেয়ে শারীরিক গঠন ছোট। চিকিৎসার ব্যয়ভার বহণ করতে গিয়ে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমিজমা সবই গেছে। আছে শুধু বাড়িটুকু। তাই পরিবারটির প্রিয় সন্তানসহ সদস্যদের মৃত্যু চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর যেন কিছুই করার নেই।

প্রতিবেশি হালিমা শেখ বলেন, ‘এই পরিবারের তিন ভাই-বোন ও তাদের এক ফুফু শারিরিক প্রতিবন্ধী হয়েই জন্ম নেয়। এক বোন চিকিৎসার অভাবে ৩ বছর আগে মারা গেছে। একমাত্র ছেলে আব্বাসের যে কি রোগ হয়েছে তা কেউ বলতে পারছে না। ওর চিকিৎসার জন্য ওর বাবা অনেক টাকা খরচ করতে গিয়ে জমিজমা হারিয়ে এখন নিঃস্ব।’

আরেক প্রতিবেশি ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘ছোট্ট আব্বাসের ডান পা ফুলে অস্বাভাবিক আকার ধারণ করেছে। সারা শরীরে ঘায়ের মত হয়েছে। শরীরে দূর্গন্ধ শুরু হয়েছে। আগে ছেলেটি স্কুলে গেলেও এখন আর যেতে পারছেনা। ওর সুচিকিৎসা দেওয়া এই গরীব পরিবারের পক্ষে সম্ভব না। এ জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। আমরা চাই প্রধানমন্ত্রী আব্বাসকে চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনে বিদেশ পাঠানোর ব্যবস্থা করুক।’

আব্বাসের বাবা রাজ্জাক শেখ বলেন, ‘আমার দুই মেয়ে জন্ম থেকেই হাঁটতে পারে না। এক বোনেরও একই অবস্থা। বিছানায় রেখেই ওদের লালন পালন করছি। তার মধ্যে ছোট মেয়েটি চিকিৎসার অভাবে প্রায় তিন বছর আগে মারা গেছে। একমাত্র ছেলে আব্বাস জন্মের সময় ডান পা তুলনামুলক মোটা ছিল। কিন্তু দিন দিন আব্বাসের বয়স বাড়ার সাথে সাথে পা ফুলে হাতির পায়ের মত মোটা হয়ে গেছে। সারা শরীরে ঘায়ের মত হচ্ছে। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। কোন পরিবর্তন হয় নাই। জমিজমা সব গেছে। এখন পরিবারের সবার খাবার জোটানোই আমার পক্ষে কষ্ট হচ্ছে চিকিৎসা করাবো কিভাবে।’

আব্বাসের মা আল্পনা বেগম বলেন, ‘ঘরে তিনটি মানুষ মরণব্যাধিতে আক্রান্ত। আমার স্বামী রং মিস্ত্রির কাজ করে সংসার চালাতেই হিমশিম খায়। ওদের চিকিৎসার জন্য জমিজমা বিক্রি করেছি। অনেক টাকা ধারকর্জ করেছি। এহন এই বাড়িটুকুই আছে। আমরা এহন কি করবো জানি না। সরকার যদি আমাগো সাহায্য করতো তাইলে আমাগো একমাত্র ছেলে আব্বাস মনে হয় সুস্থ হইয়া যাইতো।’

বিরল রোগে আক্রান্ত আব্বাস শেখ বলেন, ‘আমার পা দিন দিন ফুলে মোটা হচ্ছে আর সারা শরীরে গোটা গোটা হচ্ছে। আবার পা থেকে দূর্গন্ধ রস বের হচ্ছে। তাই স্কুলেও যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। আমার অনেক ইচ্ছা হয় লেখা-পড়া করার। অন্য সবার মত খেলা-ধুলা করার। কিন্তু আমার দিন দিন যে অবস্থা হচ্ছে জানি না কি হবে। আমার বাঁচতে খুব ইচ্ছা করে। আমি সুন্দরভাবে বাঁচতে চাই।’

রাজৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার মন্ডল বলেন, ‘আব্বাস নামের কিশোরটি যে জটিল রোগে আক্রান্ত হয়েছে এটাকে আসলে এ্যালিফেন্ট ডিজিজ রোগ বলা হয়। তার পা দেখতে অনেকটা হাতির পায়ের মত। এই রোগটি যদিও জটিল, কিন্তু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বড় হাসপাতালে বিশেষ ধরণের অপারেশন ও ঔষুধের মাধ্যমে এর চিকিৎসা সম্ভব। আমি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কর্তপক্ষকে আব্বাস ও ওদের পরিবারের আরো দুই জনের শারিরিক অবস্থা দেখাবো। কর্তৃপক্ষের সাথে ওদের চিকিৎসার ব্যাপারে কথা বলবো।’

(এএসএ/এসপি/ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৮)