চৌধুরী আবদুল হান্নান


২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরের কয়েকটি পত্রিকার মাধ্যমে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবুল বারকাতের মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছিল। দ্বন্দ্বটি ছিল সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতায় জনতা ব্যাংকের সি এস আর (কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা) তহবিল থেকে অর্থ বরাদ্দ না দেয়াকে কেন্দ্র করে।

প্রতিটি ব্যাংকের একটি আলাদা তহবিল সংরক্ষিত থাকে, যেখান থেকে প্রয়োজনে গরীব, মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দান বা যে কোনো মানবিক বিষয়ে বরদ্দ দেয়ার মাধ্যমে ব্যাংকগুলো সামাজিক কর্মকা-ে অংশ গ্রহণ করে থাকে। জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান অর্থমন্ত্রীর সুপারিশ মোতাবেক ব্যাংকের অর্থ বিনোদন মূলক কর্মকা-ে বরাদ্দ না দিয়ে সাহসীকতা ও নৈতিকতার পরিচয় দিয়েছেন।

আর একজন স্বাধীনচেতা মানুষের কথা বলি । মোঃ লুৎফর রহমান সরকার (এল আর সরকার) সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকা কালে (১৯৮৩-৮৫) একজন মন্ত্রীর নির্দেশে কাজ না করায় শেষ পর্যন্ত তাকে জেলে যেতে হয়েছিল।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করা ছাত্রদের জন্য সাময়িক কমসংস্থানের জন্য স্বল্প সুদে ও সুবিধাজনক মেয়াদে একটি প্রকল্প চালু করেছিলেন তিনি- বিশ্ববিদ্যালয় কর্মসংস্থান প্রকল্প (বিকল্প) নামে।

এরশাদ সরকারের শিক্ষামন্ত্রীর সুপারিশকৃত তালিভুক্ত ছাত্রদের কেবল এ ঋন মঞ্জুর করতে হবে- এমন নির্দেশনা তিনি মেনে নিতে পারেনি। তার পর যা হবার তইা হয়েছিল। অবশ্য পরবর্তী সময়ে হাসিনা সরকার এল আর সরকারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পদে (১৯৯৬-৯৮) নিয়োগ দিয়ে তার সম্মান ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। লুটপাটে অংশ গ্রহণ, দ্বারে দ্বারে উপটোকন বিলানো আর তোষামোদ, চাটুকারিতা উপরে ওটার মোক্ষম দাওয়াই। তারপরও সব মানুষ স্রোতে ভেসে যায় না, খড়কুটা ভেসে যায়।

বসের সাথে দ্বিমত পোষাণকারীর বড় দুঃসময়। ভ্রকুচকানো, দুর্ব্যবহার, সুযোগ পেলে শাস্তির আওতায় ঠেলে দেয়া নিত্য ঘটনা । দূর দূরান্তে বদলির ঘটনা তো আছেই। বিগত দিনে ব্যাংকে বড় বড় আর্থিক দুর্ঘটনায় যারা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বাধা দিয়েেিলন তারা কোথায় ছিটকে গেছে সে খবর কেউ রাখে না । অথচ তারাই প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি, জালিয়াতি বিরোধী শক্তি। বিস্ময়ের বিষয়, এদের সুরক্ষা দেয়ার দিকে কারও নজর নেই।

থাকবে কি করে?

অবৈধ টাকার ছড়াছড়ি দেখে কার মাথা ঠিক থাকে ? ব্যাংকের মালিক যখন কারসাজির মাধ্যমে অপরকে ঋনের নামে টাকা বের করে দেয়ার ধান্ধায় ব্যস্ত তখন কে রক্ষা করবে ব্যাংকের স্বার্থ? প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তিদের কেউ আছেন আখের গোছাতে ব্যস্ত, কেউ আছেন পদ আকড়ে রাখার নিরন্তর প্রচেষ্টার লিপ্ত। কত সুন্দর গালভরা পদবি- চেয়ারম্যান, গভর্নর, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা আরও কত কি? কত মর্যাদা, সম্মান। এ পদ কি হাতছাড়া করা যায়।

কাজে দক্ষতা, সততা সাহসীকতা নয়, তাদের ধ্যানজ্ঞান তোষামোদ আর চাটুকারিতায় সীমাবদ্ধ। তোষামোদের পুরষ্কার আছে, নগদ প্রাপ্তি আছে কিন্তু ভাল কাজের তাৎক্ষনিক মূল্য নেই।

ব্যাংকের সকল কাজই বিধিবদ্ধ নিয়মে বাঁধা, এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে যখন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার পরিবর্তে উপরের নির্দেশে কাজ করতে বাধ্য করা হয়, তখনই যত বিপত্তি । আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জনতা ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের বিষয়ে একটি মন্তব্য করে আর একবার সাড়া জাগিয়েছিল । তিনি বলেছেন, আবুল বারকাতই জনতা ব্যাংকটিকে শেষ করে দিয়েছেন ।

ব্যাংকটির দূরবস্থার জন্য সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবুল বারকাতকে দায়ী করে বক্তব্য দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী (সমকাল ৭ ফেব্রুয়ারি) ওই দিনের সমকাল পত্রিকার তথ্য বিশ্লেষনে দেখা যায়, জনতা ব্যাংকের মূলধনের ২৫ শতাংশ বিবেচনায় একক গ্রাহককে সর্বোচ্চ ৭৪৫ কোটি টাকা ঋণ দেয়া যায় কিন্ত জনতা ব্যাংক কোনো নিয়মনীতির তোরাক্কা না করে ইউনুস বাদলের মালিকানাধীন এনন টেক্স গ্রুপকে ঋণ দিয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকার ওপর ।

ধারনা করা যায়, ভয়ংকর আর একাটি আর্থিক দুর্ঘটনার খবর দৃশ্যমান হওয়া এখন কেবল সময়ের ব্যপার । যারা উপকারভোগী তারা এ ঘটনা চাপিয়ে রাখার চেষ্টা করবে তবে যোগসাজশ, জালিয়াতির মাধ্যমে পূর্বে সংঘটিত অর্থ কেলেংকারীর কোনো দুর্ঘটনাই চাপা থাকেনি। বেসিক ব্যাংকের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশ্যে আসতে সময় লেগেছিল তিন বছরের অধিক।

জনতা ব্যাংকেটিকে শেষ করে দেয়ার জন্য ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাতকে দায়ী করে অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য একটি বড় পশ্ন জন্ম দিয়েছে, তাকে কেনো আগেই চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়নি ?

জনতা ব্যাংকের এ ঘটনা নিয়ে নিশ্চয়ই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশদ তদন্ত হবে, প্রতিটি প্রস্তাবে যদি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সুপারিশ থাকে, তা হলে বোর্ড চেয়ারম্যনের তেমন কিছু করার থাকেনা । একজন সজ্জন ইমেজের মানুষের বিনা অপরাধে সম্মানহানী ঘটবে তা কারও কম্য নয় । তবে এখন আমাদের অপেক্ষার পালা ।

সৎ, স্বাধীনচেতা কর্মকর্তাদের সুরক্ষা আর অপরাধের মূল হোতাদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার মধ্যেই রয়েছে ব্যাংকিং খাতের ঘুরে দাড়ানোর মূলমন্ত্র।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার।